লেখা: ইশরাত জাহান ইশিকা, (রংপুর)।
অলঙ্করণ: জুলকারনাঈন তাহসীন, (ঢাকা)।
আজ তোমাদের একটা সুন্দর গল্প বলব। হ্যাঁ,গল্পটা সত্যিই খুব সুন্দর। গেল বছরে লকডাউনের কথা নিশ্চয় মনে আছে! তখনকার একটা মেয়ের গল্প বলি আজ। তাহলে শোনো-
লকডাউনের কোনো একদিন একরাশ অভিমান নিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে পিউ। চোখ দুটি তখনো টলমল করছে পানিতে।ওকে কেউ বোঝে না! খুব কি অন্যায় কিছু করেছিলো ও? ও তো এখন বড় হয়েছে,বোঝালেই বোঝে,এত বকাঝকা কেন তাহলে?
ঘটনা খুলেই বলা যাক। পিউ ক্লাস টেনে পড়া টিনটিনে একটা মেয়ে।অন্য সবার মতো বেচারিও এখন ঘরে বন্দী।স্কুল নেই,আর্টের ক্লাস নেই,বান্ধবীদের নিয়ে আড্ডা নেই,ভাইবোনদের সাথে ঘুরতে যাওয়াও নেই। ঘরে বসে থাকতে কার আর ভালো লাগে? মা-বাবাও তো সময় দেন না ওকে। রোজকার মতোন আজও সকাল ৮ টায় স্কুলের ক্লাস করলো পিউ,ক্লাস শেষ হতে হতে ৯ টা বেজে গেল। এখন প্রায় সারাদিনই মোবাইল হাতে থাকে ওর। তাই ক্লাস শেষে অনলাইনের দুনিয়ায় ঢুকে ঘুরছিলো ও,তখনি বাবা এসে বেশ কড়া কিছু কথা শুনিয়ে হাতটা থেকে ফোন নিয়ে নিলেন। কি হলো এটা? ফোনটা তো ওর,মোবাইল ছাড়া কিভাবে সময় কাটাবে ও? সারাদিন নিশ্চই বই নিয়ে বসে থাকবে না।মোবাইলে কত্ত কিছু করা যায়! সময় এমনিতেই কেটে যায়। এবার চোখ থেকে পানির বিন্দু বেড়িয়েই পড়ল। এখন কিভাবে ও সময় কাটাবে ভেবে পারে না! মা-বাবা তো দুজনেই অফিসে চলে গেছেন। আর্ট করতেও ইচ্ছা হচ্ছে না, ওদিকে বুক শেলফে থাকা সব বই ওর পড়া। বিষণ্ণ মুখে জানালা ছেড়ে বারান্দায় যায় ও। গ্রিল ধরে আকাশটাকে দেখে বহুক্ষন। মনে মনে ভাবে আকাশ কি কখনো পুরোনো হয়?
ওর ঘর লাগোয়া বারান্দাটা বেশি বড় না,মাঝারি টাইপ।সেখানে এককোনে জায়গা করে নিয়েছে একটা লাল জবার গাছ। একটা ফুল ফুটে আছে ওখানে।এই একটামাত্র গাছ জায়গা পেয়েছে ওর বারান্দায়। গাছটার কাছে গিয়ে কয়েকটা হলুদ পাতা ফেলে দিল। টবের গজানো দুর্বাঘাসগুলোও ফেলে দিল। গাছটাকে এবার বেশ গোছালো লাগছে। এবার এক মাগ পানি এনে ঢেলে দিল গাছের গোড়ায়। একটা ভেজা কাপড় দিয়ে পরিস্কার করে নিল সাদা টবটা। হঠাৎ ওর মনে হলো আরও বেশ কিছু গাছ লাগানো যায় বারান্দায়। তাহলে বেশ সবুজ সবুজ একটা ভাব আসবে বারান্দায়।
বাজি দিয়ে বলতে এর ২ সপ্তাহ পর তুমি যদি পিউএর বাসায় যাও তাহলে ওর বাসাটা কিন্তু একদম চিনতে পারবে না তুমি।কিন্তু কি পরিবর্তন হলো মাত্র ২ সপ্তাহে?
সেদিন রাতে বাবা - মা বাসায় আসার পর পিউকে ফোনটা দিয়ে দিয়েছিলেন।কিন্তু সেদিন আরেকটা কাজ করেছিলো ও।ওর সবুজ রঙের মাটির ব্যাংকটা ভেঙেছিল।যদিও সে কথা মা বাবা জানতেন না। পরদিন মা-বাবাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে ওর বান্ধবী সুহার বাসায় যায় পিউ।যথাসম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনেছিলো ও।শুনেছিলো সুহাদের বাসায় নাকি অনেক গাছ।গাছ দেখতেই ওদের বাসা যাওয়া। সুহাদের বাসায় গিয়ে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল পিউএর মাথায়।কারও বাসায় এতো গাছ থাকতে পারে? কি সুন্দর সুন্দর সব গাছ।বাসার উঠানটাকে ওর মনে হলো যেন ছোট খাটো একটা বন।কিন্তু পিউদের দুই রুমের বাসায় কি বড় বড় জাম-কাঠগোলাপের গাছ লাগানো যায়? সমাধান করে দিলেন সুহার বাবা।এখানকার একটি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক তিনি।পিউকে বললেন, "মা তুমি কিছু গাছ নিয়ে যাও।যেগুলো টবেও সুন্দর হয়।হ্যাঁ,যত বড় টবে গাছ লাগাবা তত ভালো।" বড় বড় টবে তুমি অনেক সুন্দর সুন্দর গাছও লাগাতে পারো।" আরও কিছু বলেছিলেন অধ্যাপক সাহেব, "উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনার কারণে তাঁর গাছ নিয়ে জানাশোনা প্রচুর।সবসময় পরিক্ষার জন্য " ট্রি প্লান্টেশন" রচনায় পড়ে এসেছে,গাছ কেন গুরুত্বপূর্ণ।এর বাইরেও যা কিছু জেনেছে তাও খুব বেশি নয়।কিন্তু সুহার বাবা তাকে ভিন্ন ভিন্ন কিছু কথা বলেছিলেন যা পিউকে গাছের প্রতি অনেক দূর্বল করেছিল। " এই যে এই গাছটা এটা হচ্ছে ঘৃতকুমারী,কি সুন্দর না? আমাদের ঢাকায় তো বিশুদ্ধ অক্সিজেনের অনেক অভাব,কিন্তু এই গাছ প্রচুর অক্সিজেন দেয় মা।একটা গাছই ৯ টা বায়োলজিকাল এয়ার পিউরিফায়ারের মতো কাজ করে।যত রোগ আছে,তার বেশিরভাগেরই প্রতিরোধ উপাদান এখানে থাকে।এর মতো উপকারি গাছ অনেক কম আছে।
বনসাই গাছের ছবি দেখে খুব ভালো লেগেছিলো পিউএর। কিন্তু এতো অনেক গাছে থাকলেও কোনো বনসাই খুঁযে পেল না ও।প্রশ্নটা সুহাকে করলেও উত্তর দিয়েছিলেন ওর বাবা।বলেছিলেন, "দেখ বনসাই গাছ সবাই লাগায় সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য, গাছের বয়স হয়ে যায় কিন্তু গাছ বাড়ে না, তোমাকে যদি অল্প লম্বা হওয়ার পরই তোমার বৃদ্ধি আটকায় রাখা হতো,ব্যাপারটা কি ভালো হতো মা?
তারচেয়ে ঐ গাছটা যদি বদ্ধ ঘরে না রেখে সঠিক বৃদ্ধিতে বেড়ে উঠত, কি উপকারই না হতো!
মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো পিউ।সুহাদের বাসা থেকে বেশ কিছু গাছ নিয়ে এসেছিলো সেদিন।বাসায় এসে বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলো টব কিনতে।সেদিনের পরে একটু একটু করে বদলাতে শুরু করেছিলো পিউএর বাসা।ওর বারান্দায় জায়গা করে নিয়েছে চন্দ্রমল্লিকা গোলাপ, বেলি,হাসনাহেনা,কাঠগোলাপ সহ কত্ত ফুল!
এরপ ঘরে আছে ঘৃতকুমারী,মানিপ্যালন্ট,লিলি সহ ছোট ছোট গাছ গুলো।গাছের প্রতি ভালোবাসা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে অনেক বেশি।ওর মা-বাবাও খুশি এখন। মোবাইল খুব প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করে না ও।যখন খুব মন খারাপ হয় বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে। খোলা আকাশটাকে দেখে মন ভরে।গাছগুলোকে আদর করে দেয়।দীর্ঘ রাতে হাসনাহেনার গন্ধ ওর মন ভালো করে দেয়।ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে গাছের সংখ্যা। ব্যাংকের টাকা গুলো দিয়ে কিনে আনে গাছ।এখন পুরো বাসা যেন গাছময়।
এখন যদি তুমি ওদের বাসায় যাও, মনে হবে যেন গাছবাড়ি।কি কি সুন্দর সুন্দর গাছ! সবুজময় বাসাটা মন ভালো করে দিতে বাধ্য।সুহার বাবা ওদের বাসায় গাছ দেখতে এসে খুশি হয়েছিলেন অনেক।গাছের যত্নের কৌশলও বলে দিয়েছিলেন।
তোমরাও কিন্তু মোবাইল ফোনটা রেখে এবার গাছ লাগানো মিশনে নামতে পারো।বাসার মধ্যেই তৈরি হয়ে যাবে ছোট্ট এক সবুজ রাজ্য!