জেবা সামিহা তমা, (রংপুর):
আদিম যুগ থেকেই মানুষ যেকোনো বিপদ আঁচ করেই নিজেদের মতো করে প্রতিরোধ করেছে। ধীরে মানুষ যতটা সভ্যতার দিকে এগিয়েছে ততটাই উন্নত হয়েছে তাদের বিপদ এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলোকেও করতে হয়েছে বিপদের থেকেও শক্তিশালী। বর্তমানের একটি বড় বৈশ্বিক বিপদ হলো করোনা ভাইরাস , যার প্রতিরোধ ব্যবস্থা হলো করোনার টিকা।
টিকার ইংরেজি শব্দ হলো Vaccine (ভ্যাক্সিন) । ল্যাটিন শব্দ ভ্যাক্কা থেকে এসেছে 'ভ্যাক্সিনেশন' শব্দটি। ভ্যাক্কা অর্থ গরু। কিন্তু প্রশ্নটা হলো গরু থেকে কেনো অসুখের প্রতিরোধ ব্যবস্থার নাম হলো? তাহলে এবার জেনে নেয়া যাক টিকা অর্থাৎ ভ্যাক্সিনের ইতিহাস সম্পর্কে।
টিকা শরীরে ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে এবং জন্মগত, অভিযোজিত উভয় প্রতিরোধমূলক প্রতিক্রিয়াকে প্ররোচিত করে অ্যান্টিবডি তৈরির দিকে পরিচালিত করে। একটি হিউমারাল প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে বা মেমরি কোষের প্রজন্ম যা একই অ্যান্টিজেনকে চিনতে পারে, যদি পরবর্তী এক্সপোজার হয় তবে পর্যায়ক্রমিক পুনরাবৃত্তি ইনজেকশনগুলি ইনোকুলেশনের কার্যকারিতা এবং স্থায়িত্ব উন্নত করতে পারে। আবার কখনো কখনো কার্যকারিতা এবং স্থায়িত্ব উন্নত করতে ভ্যাকসিন বা টিকার একাধিক বুস্টার ডোজেরও প্রয়োজন হয়।
পৃথিবীতে বেশ কয়েক ধরনের টিকা বা Vaccine রয়েছে। যেমন : Live-Attenuated Vaccines ; Inactivated Vaccines ; Subunit Vaccines ; Conjugate Vaccines ; Toxoids.
ইতিহাস থেকে জানা গেছে যে, আধুনিক চিকিৎসার জনক হিপোক্রেটিস খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দে মাম্পস, ডিপথেরিয়া, এবং মহামারী জন্ডিস বর্ণনা করেছেন এবং নিজের মতো করে চিকিৎসা ব্যবস্থা দিয়েছেন। তবে তখনো কোনো রোগের পূর্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়নি।
এখানে একটু জানিয়ে রাখি ‘ইনোকুলেশন’ হলো — সংক্রামিত ব্যক্তির পুস্টুলস থেকে তরল অপসারণ করা এবং পরবর্তীতে এটি একটি সুস্থ ব্যক্তির ত্বকের আঁচড়ে ঘষে দেওয়া।
‘ভেরিওলেশন’ হলো — গুটিবসন্ত থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তির ফুস্কুড়ির শুকিয়ে যাওয়া চামড়া গুড়ো করে সুস্থ মানুষকে নাক দিয়ে টেনে নিতো। এর ফলে শরীরে নিয়ন্ত্রিত সংক্রমণ ঘটাতো। তখন ওই ব্যক্তির শরীরে মৃদু সংক্রমণ ঘটে তিনি সুস্থ হয়ে উঠতেন এবং শরীরে প্রকৃতিক প্রতিরোধ গড়ে উঠত। ভেরিওলেশনের পর সাধারণ মানুষের দেহের চমড়ায় কোথাও কোথাও সাদাটে হয়ে যেত।
ইনকোকুলেশনের জন্ম বোধহয় চীনে। কারণ শোনা যায় যে, প্রায় ১০০০ খ্রিস্টাব্দে একজন চীনা রাষ্ট্রনায়কের ছেলের নাকের মধ্যে গুঁড়ো গুটি বসন্ত ঘা ফুঁকিয়ে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে টিকা দেওয়া হয়েছিল। তখনকার ঐ ব্যবস্থাকে অবশ্য টিকা বলা যায় না। কিন্তু আবার এটাও শোনা যায় যে বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও সাপের থেকে বিষ নিয়ে অল্প অল্প করে পান করতেন যাতে সাপের কামড়ে কোনো ক্ষতি না হয়। বোধহয় চীনেই পদ্ধতিটি আগে জন্ম নিয়েছে কিন্তু এরকম একই ধরনের ব্যবস্থা কিভাবে তখনকার সময়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছে পৌঁছালো নাকি এটা বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এই ব্যবস্থা নিজেরাই আবিষ্কার করেছেন এটা এখন পর্যন্ত কোথাও স্পষ্ট করে লেখা নেই।
ইনোকুলেশন পদ্ধতি ইউরোপে পৌঁছানোর অনেক আগে ১৬৭২ সালের দিকে তুরস্কে চালু করা হয়েছিল।
১৭১৫ সালে একজন ইংরেজ অভিজাত নারী যার নাম ‘লেডি মেরি ওয়ার্টলি মন্টেগ’ তিনি ব্যক্তিগতভাবে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এরপর ভেরিওলেশন পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর ১৭১৮ সালে লেডি মেরি ওয়ার্টলি মন্টেগ তুরস্কের দূতাবাসের সার্জন চার্লস মেটল্যান্ডকে তার ৫ বছর বয়সী ছেলের উপর পদ্ধতিটি পরীক্ষা করতে একপ্রকার বাধ্যই করেন। ১৭২১ সালে, ডঃ চার্লস মেটল্যান্ড লন্ডনে ফিরে আসার পর লেডি মন্টেগের ৪ বছর বয়সী কন্যার উপর আবার নীরিক্ষা চালিয়েছিলেন। মূলত এভাবেই ইংল্যান্ডে এই বৈচিত্র্যের প্রচলন হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এটি জনরোষের সম্মুখীন হয় কারণ তখন ২-৩% মানুষ টিকা দেওয়ার পরে মারা গিয়েছিলো এবং আরও প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল।
ইনোকুলেশনের পরবর্তী পুনরাবৃত্তি হলো ভ্যাক্সিন যা ভেরিওলেশনের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিভাবে? বলছি তাহলে — হঠাৎ করেই এটা পরিলক্ষিত হয় যে দুগ্ধ খামারিদের গুটিবসন্ত হয় না। ১৮ শতকের ইংরেজ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার অনুমান করেছিলেন যে কাউপক্স(এটি অনেক আগের একটি সংক্রমণ) গবাদি পশু থেকে ছড়ানো একটি হালকা রোগ এবং এটা গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে সুরক্ষা হিসেবে কাজ করতে পারে। কিন্তু তিনি এই বিষয়টি নিয়ে সন্দিহান ছিলেন তাই ১৭৯৬ সালে ডাঃ জেনার দুধের কাজে নিয়োজিত একটি মেয়ের হাতে হওয়া কাউপক্সের ক্ষত থেকে পুঁজ নিয়ে একটি আট বছর বয়সী ছেলের বাহুতে ডাঃ জেনারের তৈরি একটি কাটার মধ্যে তরল প্রবেশ করান। ছয় সপ্তাহ পরে ডাঃ জেনার ছেলেটিকে গুটিবসন্তের সংস্পর্শে আনেন কিন্তু ছেলেটি সংক্রমিত হয়নি। এরপরের বছর আরও ২৩ জনের উপর এই পরীক্ষা চালানো হয় এবং ডাঃ জেনার সফল হন। এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা কাউপক্স থেকে আবিষ্কৃত বলে গাভীর ল্যাটিন শব্দ 'vacca' থেকেই vaccine শব্দটার উৎপত্তি হয়।
ডাঃ জেনারের এইধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা গুলো এখন ইমিউনোলজি, ভ্যাকসিন থেরাপি এবং প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যের জন্ম হিসাবে বিবেচিত। তাই ডাঃ এডওয়ার্ড জেনারই হলো ভ্যাক্সিনের জনক। এরপর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ডাঃ জেনারের ভ্যাক্সিন এবং অনেক দেশে তো গুটিবসন্তের ভ্যাক্সিন নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিলো।
ডাঃ জেনারের ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের প্রায় এক শতাব্দী পরে ১৮৮৫ সালে ফরাসি জীববিজ্ঞানী লুই পাস্তুর উন্মাদ কুকুর দ্বারা কামড়ানো একটি নয় বছর বয়সী ছেলের জীবন রক্ষা করেছিলেন। লুই পাস্তুর টানা ১৩ দিন ছেলে টিকে জলাতঙ্ক ভাইরাসের একটি দুর্বল রূপ দিয়ে ইনজেকশন দিয়েছিলেন। এরপর ছেলেটির আর কখনোই জলাতঙ্ক রোগ হয়নি এবং এই চিকিৎসা সফল হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। যদিও এটা বোধহয় পূর্ব পরিকল্পিত কোনো পরীক্ষা ছিলো না। তবুও লুই পাস্তুর তার তৈরি ‘র্যাবিস ভ্যাকসিন’ এর মাধ্যমে ভাক্সিন শব্দ কিংবা পদ্ধতিটির একটি নতুন অর্থ দিয়েছিলেন।
লুই পাস্তুরের এই আবিষ্কার বিশ্বব্যাপী একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তার পরীক্ষা থেকে এটা প্রমাণ হয় যে সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা তৈরির জন্য জীবিত, দুর্বল বা নিহত ভাইরাস ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া যাবে।
পাস্তুরের সফল লাইভ ভ্যাকসিনের পর, উনিশ শতকের শেষ কয়েক বছরে একটি নতুন ধরনের ভ্যাকসিন চালু করা হয়েছিল। এগুলো ‘মেরে ফেলা ভ্যাকসিন’ নামে বিজ্ঞানীরা বিভাগ করেছেন যেগুলো মানুষের অসুস্থতার তিনটি প্রধান ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল: কলেরা, টাইফয়েড এবং প্লেগ।
এরপর আসি অন্যান্য ভ্যাক্সিন বা টিকা নিয়ে।
প্রথম কলেরা ভ্যাকসিন যা মানুষকে টিকা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল তা আসলে জেইম ফেরান এর দ্বারা তৈরি একটি লাইভ ভ্যাকসিন যা স্পেনে ১৮৮৪ সালের মহামারীর সময় উচ্চ স্তরের সুরক্ষা প্রদান করেছিল। এছাড়াও ১৮৯৬ সালে কলেরার জন্য প্রথম যে নিহত ভ্যাকসিনটি তৈরি করেন উইলহেম কোলে তা ১৯০২ সালে জাপানে যখন ব্যবহার করা হয়েছিলো তখন টিকা টি তার ৮০% দক্ষতার সাথে নিজের কাজ করেছে।
১৮৯০ এর দশকে নিহত টাইফয়েড ভ্যাকসিন তৈরির কৃতিত্ব কিন্তু রিচার্ড ফাইফার এবং অ্যালমরথ রাইট উভয়ের কাছে যায়। তারা দুজনেই দুর্দান্ত অবদান রেখেছিলেন।
এরপর প্লেগের জন্য নিহত ভ্যাকসিনটি প্রথম ১৮৯৬ সালে হাফকাইন দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। তখন এটি একটি মহামারী রূপে বোম্বেতে আঘাত করেছিল।
১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে টিটেনাস টক্সয়েড প্রবর্তন করা হয়েছিলো যা পের্টুসিস ভ্যাকসিন দ্বারা অনুসরণ করা হয়েছিল।
১৯৭৪ সালে ব্যাসিল ক্যালমেট-গুয়েরিন, পোলিও, ডিটিপি, হাম, হলুদ জ্বর, এবং হেপাটাইটিস বি-এর জন্য ডব্লিউএইচও-এর মধ্যে ইমিউনাইজেশনের সম্প্রসারিত প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
১৯৯৬ সাল অবশ্য আন্তর্জাতিক এইডস ভ্যাকসিন ইনিশিয়েটিভের প্রবর্তনের সাক্ষী ছিল।
ডব্লিউএইচও ১৯৮৮ সালে তৈরি করা জরায়ু মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধে প্রথম ভ্যাকসিন ২০০০ সালে এবং ২০০৬ সালে পোলিও নির্মূল করার জন্য একটি প্রস্তাব পাস করে।
এবার কথা বলি বর্তমান সময়ের একটি যুগান্তকারী টিকা নিয়ে। ২০১৯ সালে চীনে চিহ্নিত হওয়া ‘কোভিড১৯’ সারা বিশ্বে অতিমারীর রূপ ধারণ করে। এটা একটা নতুন ভাইরাস তাই এর সাথে লড়তে গিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান বলতে পারি পুরো মানবজাতি একটা বড় সড় ধাক্কা খায়।
কোভিডের টিকা তৈরির চেষ্টায় দ্রুত পৃথিবীর প্রায় সব বিজ্ঞানীরা কাজে লেগে পরে। প্রায় সাত মাস পর করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রথম সফল টিকা উদ্ভাবন করেন তুর্কি বংশোদ্ভূত মুসলিম জার্মান দম্পতি উগুর শাহিন ও ওজলেম তুরেসি। জার্মানির বায়ো এনটেক প্রতিষ্ঠান ও যুক্তরাজ্যের ঔষধ কোম্পানি ফাইজার এই দুইটা প্রতিষ্ঠান মিলে টিকা আবিষ্কার করায় করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্বের প্রথম টিকার নাম ‘ফাইজার-বায়োএনটেক’। দেশ হিসেবে প্রথম টিকা আবিস্কারের কৃতিত্বটাও যুক্তরাজ্য নিয়েছে। এখন অবশ্য কোভিড ১৯ এর অনেক টিকা আবিষ্কার হয়েছে।
উপরে টিকার কয়েকটি ধরণের কথা বলেছি। তার মধ্যে যে দুইটি ধরণ বাদ পড়েছে তা পরবর্তী প্রজন্মের টিকা হিসেবে পরিচিত। যেগুলো কোভিড ১৯ এরই টিকা।
এরমধ্যে একটি হলো —
ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্নার টিকা যেগুলো তৈরি করা হয়েছে মেসেঞ্জার বা বার্তাবাহী আরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এমআরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বে প্রথম এই দুটি টিকাই আবিষ্কৃত হয়েছে।
অন্যটি হলো — অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা যা ডিএনএভিত্তিক টিকা। অর্থাৎ এটা তৈরি করা হয়েছে ভাইরাল ভেক্টর প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এই ভিত্তিতে আরও কিছু টিকা আবিষ্কার করা হয়েছে অবশ্য।
এই ছিলো টিকা অথবা ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের গল্প। আমরা সচেতন থাকবো যথাসময়ে টিকা নিবো।