“হ্যাঁ রে, ভালো হয়েছে না?”
“হুমমম, দারুণ। চল ট্রিট দে।”
সোহেল এর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে শোভন এর কথা শুনে ওর মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেছে।
“জুতা কিনলাম আমি, টাকা গেল আমার, আর তোকেও খাওয়াব আমি!! তোমাকে জুতিয়ে ঠিক করব, দাঁড়াও....”
আচ্ছা, থামুন এবার,,, জুতা নিয়ে তো এমন জুতোজুতি প্রতিদিনই হচ্ছে কোথাও না কোথাও। বর্তমান বিশ্বে জুতার দামও এখন ১০০ থেকে ১কোটি! দড়ি-চামড়া-খড় দিয়ে শুরু হয়ে জুতা এখন প্লাস্টিক-রাবার, আর্টিফিশিয়াল চামড়া, সিন্থেটিক কাপড়, সোনা কত কিছু দিয়েই না কত ধরনের ও আকরের তৈরি হচ্ছে! তাই দামও বিভিন্ন রকম, কোয়ালিটিও আর আসল-নকলও,,,।
তাহলে আজকে এই জুতোর ই আদ্যন্ত কাহিনী জেনে নেওয়া যাক:
অন্যান্য সকল বস্তু বা প্রযুক্তির মতো জুতোও মানুষের চাহিদার ফসল। মানুষ তার পা কে বিভিন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্যই জুতার আবিষ্কার করে। তখন অবশ্য মানুষ জুতাকে কি হিসেবে জানত বা ব্যবহার করত তা বলা মুশকিল। তবে পায়ের নিরাপত্তা ও আরামের জন্যই পাদুকার প্রচলন করেছিলেন ৪০ হাজার বছর আগের মানুষেরা।
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাশ্ম-নৃবিজ্ঞানী ‘এরিক ট্রিনকাস’(জন্ম:১৯৪৮) তুষার যুগের মানুষের দৈহিক গড়ন ও সে যুগের নিদর্শনের ওপর গবেষণা করে, প্রমাণ হাজির করে বলেছেন,‘মানুষ জুতা পড়তে শুরু করেছিল প্রায় ৪০,০০০ বছর আগে।’
জুতার ব্যবহারের তেমন কোনো প্রমাণ বা নিদর্শন এর পরের মধ্যবর্তী সময়ের পাওয়া যায়নি। প্রাচীন “স্পেনের গুহা আলতামিরা” তে ১৫,০০০ বছর আগের কিছু গুহাচিত্র দেখতে পাওয়া যায়। সেই গুহাচিত্রে দেখা যায় আদিম মানুষদের পায়ে পশুর চামড়া জড়ানো ছিল। এ থেকে বোঝা যায় সেই সময়ের মানুষ পা রক্ষার জন্য জুতার মতোই বস্তু ব্যবহার করত।
এরপরে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন অঙ্গরাজ্যের ফোর্ট রক গুহায় পাওয়া সেইজব্রাশ গাছের বাকলের তৈরি জুতা থেকে ধারণা করা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৭ হাজার বছর আগেই যুক্তরাষ্ট্রের গুহাবাসীরা জুতা পরত। যা থেকে বোঝা যায় সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষ পরিবেশের সাথে আরো সাচ্ছন্দের সাথে বসবাস করার জন্য জুতার ব্যবহার শুরু করে ও তার প্রসার ঘটায়।
স্পেন থেকে পাওয়া নব প্রস্তরযুগের পাদুকা জোড়া এ সময়ে(৫,০০০-৭,০০০ বছর পূর্বে) জুতা ব্যবহারের প্রমাণ দিয়ে থাকে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি অঞ্চলের একটি প্রাচীন গুহায় হদিস মেলে চামড়ার তৈরি জুতার, যা এ সময়ের।
ইউরোপ-এশিয়ার সীমান্তে অবস্থিত আর্মেনিয়ার এরেনিয়া-১ নামক গুহায় এক জোড়া জুতা পাওয়ার পর গবেষণা করে জানা গেছে এই জুতা খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ - ১২০০ শতকে তৈরি করা হয়েছিল এবং বলা হয়, জুতা আবিষ্কারের প্রথম দিকে দুই পায়ের জুতা এবং ছেলে-মেয়ের জুতা এক ছিল। এই জুতা পৃথিবীতে প্রায় অক্ষত একমাত্র চামড়ার জুতা, যা প্রায় ৫,৫০০ বছরের পুরনো।
গবেষকেরা ধারণা করেন যে, “পৃথিবীর প্রথম জুতা আবিষ্কার করা হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যে। কোনো কোনো গবেষক বলছেন, ইরানের সীমান্তবর্তী পাহাড়ে বসবাসকারী বাসিন্দাদের পায়ের নিরাপত্তার কারণে প্রথম জুতা তৈরি করা হয়।“
এছাড়াও ৫,০০০ বছর আগে বরফ যুগের সময়ে তৎকালীন মানুষেরা খড়যুক্ত চামড়ায় মোড়া জুতা পরিধান করতো বলে জানা যায়। এছাড়া, এশিয়াতে এযাবৎ যত চিত্রকর্ম দেখা যায়, তাতে এশিয়ায় যে কাঠের জুতার প্রচলন ছিল তা জানা যায়। এমনকি জাপানের প্রাচীন মিথ সাহিত্যেও কাঠের জুতার ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
অস্ট্রীয় আল্পস পর্বতমালা থেকে ১৯৯১ সালে ওৎজি দ্য আইসম্যানের ৫,৩০০ বছরের পুরোনো যে মমি উদ্ধার করা হয়েছিল, তাঁর পায়ে পাওয়া গিয়েছিল, একটি ফিতা দিয়ে বাঁধা জুতা। এ থেকে ধারণা করা যায় যে, খ্রীষ্টের জন্মের ৩,৩০০ বছর আগেই আল্পস পর্বতমালার আশপাশের অধিবাসীরা জুতা ব্যবহার করতেন।
তবে যতদূর জানা যায়,ইতিহাস বলে, সেন্ডেল জাতীয় জুতা প্রথম আবিস্কার হয়েছিল মিশরে। পেপাইরাস নামক এক গাছের পাতা দিয়ে সেন্ডেল বানানো হত। ইতিহাসের অনেক সমালোচক ধারণা করেন যে, মিশরীয়রাই প্রথম পেশাদার জুতা তৈরি শুরু করেন। মিসরের ফারাও রাজারা স্যান্ডেল পরিধান করে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। এবং রাষ্ট্রে ফারাও ব্যতীত অন্য কেউ স্যান্ডেল পরিধান করতে পারতো না। মিসরের সমাজে স্যান্ডেলকে সম্মানীয়ের পরিধানযোগ্য উপাদান হিসেবে গণ্য করা হতো।এরপর পার্সিয়ানরা নরম চামড়া দিয়ে জুতা তৈরি করেছিলেন। আবার অনেকে ধারণা করেন যে, ঠিক একই ধরনের জুতা একই সময় ব্যবহার করত গ্রীস, রোমান ও মেসোপটেমিয়ানরা। সে সময়কার জুতার কোন ডান-বাম পার্থক্য ছিল না এবং নারী পুরুষেরা একই রকম জুতা পরত।
জুতার মানের উপর নির্ভর করত সামাজিক মান মর্যাদা। এমনও ইতিহাস আছে যে, ইউরোপের কিছু অঞ্চলে জুতা ছিল শুধুমাত্র রাজাদের পরিধানযোগ্য। কোনো প্রজা যদি জুতা পরত তাহলে তাকে রাজার আদেশে হত্যা পর্যন্ত করা হতো। এশিয়াতেও রাজন্যবর্গের রাস্তায় জনসাধারণের জুতা পায়ে হাঁটা নিষিদ্ধ ছিল। জুতা বহন করার জন্য সে সময় অনেকে ক্রীতদাস রাখত। নানান অনুষ্ঠানে এসব দাস-দাসীদের কাজ ছিল জুতা সংরক্ষণ করা ও মনিবের পা ধুয়ে দেয়া। আবার নিষেধ ছিলো যে, ক্রীতদাসরা জুতা ব্যাবহার করতে পারবে না।অন্যদিকে শাস্তি দেওয়ার জন্য দুষ্কৃতকারীদেরকে পরানো হত কাঠের তৈরি এক প্রকার অতি-ওজনের বড় জুতা, যাতে তারা পালাতে না পারে।
খ্রীষ্টপূর্ব ১৬০০-১২০০ অব্দ মধ্যে ইরানের সীমান্তবর্তী মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের বাসিন্দারা পর্বতে চড়ার সময় একধরনের আরামদায়ক জুতা ব্যবহার করতেন বলে জানা গেছে গবেষণায়।
মধ্যযুগে মানুষ শুধুমাত্র পা ঢাকতে পেরেই থেমে থাকেনি। নানা রকমারি ডিজাইনের জুতা তৈরির কায়দাও রপ্ত করেছিল। কিছু মানুষ সেন্ডেল পরিত্যাগ করে বুট জাতিয় জুতা পরা শুরু করে। মধ্যযুগের শেষের দিকে জুতার উপর বিভিন্ন কারুকাজ করে অলংকারের কাজ শুরু করেন। আমেরিকার আদিবাসি রেড ইন্ডিয়ান এবং এস্কিমোরা বুট জাতিয় জুতা ব্যবহার করত।
৪০,০০০ বছর আগে জুতা বানানো হলেও ডান-বাম পায়ের জন্য আলাদা জুতা তৈরি করা হয় মাত্র ১,৮৫০ বছর আগে। এবং এর সাথে ধীরে ধীরে শুরু হয় এর পরিবর্তন ও পরিমার্জন। তাই জুতা আবিষ্কারের কোনো সঠিক ইতিহাস কেউ বলতে না পারলেও এর আধুনিকায়ন যে ৪০০ বছর আগে হয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। জুতার আধুনিকায়ন শুরুর পরে কাঁদা, বরফ ও ছেলে-মেয়েদের জন্য আলাদা জুতা তৈরি হয়।
জুতা আধুনিকায়নের প্রথম দিকে কাঠের তৈরি জুতা তৈরি করা হতো এবং স্থান ভেদে এর বিভিন্ন নামকরণ করা হয়।
১৮০০ শতকের দিকে কাঁদা থেকে বাঁচার জন্য ‘ওকাবো’ নামের এক ধরনের জুতা বানানো হয়। এর পরিমাপ ছিল ১৪ সেন্টিমিটার ও জুতাটি ছিল কাঠের তৈরি। এই জুতা বের হওয়ার পর বেশি ব্যবহার করেছিল নারীরা। এছাড়াও জানা যায়, এই জুতার ফিতা ছিল লাল। তবে, পাদুকা আধুনিকায়নে প্রথম হাত দেয় ইউরোপীয়ানরা। ক্রমে পৃথিবীর অন্যান্য দেশও এতে অংশগ্রহণ করে।
ছেলে এবং মেয়ে উভয় ব্যবহারের জন্য পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইতালিতে এক ধরনের কাঠের জুতা তৈরি করা হয়। এর নাম রাখা হয়েছিল ‘চোপিনস’। এই জুতার ২টি বিশেষত্ব ছিল। প্রথমত এই জুতা ছিল ক্ষুদ্রাকৃতির এবং মেয়েদের ব্যবহারের জন্য। যা তৈরি করা হয়েছিল, তা ছিল ৫ ইঞ্চি পরিমাপের।
বর্ষায় কাদা পানি থেকে বাঁচার জন্য আমরা নানা ধরনের জুতা ব্যবহার করে থাকি। কাদা থেকে বাঁচার জন্য লেবানিজরা খ্রিস্টীয় ১৪০০-১৭০০ শতাব্দীতে এক ধরনের উঁচু কাঠ দিয়ে তৈরি “কাবকাবস” নামের জুতা ব্যবহার করতো। এর ধারণা নেওয়া হয়েছিল মধ্য যুগের জুতা থেকে।
বরফের পাহাড় কিংবা বরফ আচ্ছাদিত এলাকায় যারা বসবাস করেন, তারা জেনে অবাক হবেন যে, বরফে হাঁটার প্রথম জুতা তৈরি করা হয়েছিল গাছের ছাল দিয়ে। বিংশ শতাব্দীতে ফিনল্যান্ডে প্রথম তৈরি করা হয়েছিল সেইরকম জুতা। যা ছিল গাছের ছাল দিয়ে তৈরি। পরবর্তী সময়ে নরওয়ে, সুইডেন এবং রাশিয়া এই জুতার আধুনিকায়ন করে।
বিয়ের জুতা প্রথম তৈরি হয়েছিল উনিশ শতকের দিকে ফ্রান্সে। এই জুতা কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এবং নবম শতকের দিকে প্রাচীন আফ্রিকার মরিশাসের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষের ব্যবহৃত জুতা দেখে ধারণা করে বানানো হয়েছিল।
বর্তমান যুক্তরাজ্যের ডারলিংটনে একটি পুরোনো রোমান দুর্গের পাশে থেকে পাওয়া রোমান রাজনীতিবিদ ট্যাসিটাসের (৫৬ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ১২০ খ্রিষ্টাব্দ) একটি লেখায় জানা যায় যে, রোমানরা সেই যুগে একধরনের শক্ত পাদুকা ব্যবহার করত।
বর্তমানে আমরা জুতার মধ্যে হাইহিল জুতা প্রায়শই দেখতে পাই। ধারণা করা হয়, হাই হিল প্রচলনের গল্প দশম শতকের। মূলত হাই হিল যুক্ত জুতা ব্যবহার করত পুরুষ সৈনিকেরা। নারীরা সেটা ব্যবহার শুরু করে অনেক পরে।তবে হাইহিল জুতার প্রচলন মূলত শুরু হয় প্রথম ফ্রান্সে। ১৭০০ শতকের দিকে ইউরোপীয়রা নারী-পুরুষের কথা মাথায় রেখে এক জোড়া জুতা তৈরি করেন ফরাসি বিপ্লবের পঞ্চদশ লুই, এর নাম রাখা হয়েছিল ‘হাই হিল’। এই হাই হিল নামের প্রথম জুতাটি ব্যবহার করেন ফ্রান্সের সম্রাট পঞ্চদশ লুই। তৎকালীন ষোড়শ লুই হাইহিল জুতার প্রচলন করেন। সেসময় ফরাসি রাজপরিবার রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জনসাধারণের হাইহিল জুতা পরিধানের উপর নিশেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এমনকি ফ্রান্সের ইতিহাস থেকে জানা যায়, হইহিল জুতা নিয়ে ফ্রান্সে ছোটো-খাটো বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়েছিল এবং সেই যুদ্ধগুলোতে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিহত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে লন্ডনের কিছু ব্যবসায়ি ফ্রান্সের হাইহিল জুতার অনুকরণে জুতা প্রস্তুত শুরু করে এবং লন্ডনের রাজপরিবারেও সমান জনপ্রিয় হয় সেই জুতা। প্রায় একশ বছরেরও বেশি সময় হাইহিল জুতা ছিল জনসাধারণের জন্য নিষিদ্ধ।
ওদিকে উত্তর আমেরিকার ইন্ডিয়ান জাতিগোষ্ঠি নিজেদের প্রয়োজনেই ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য একপ্রকার জুতা তৈরি করে নিয়েছিল যাকে মোকাসিন নাম দেয়া হয় পরবর্তী সময়ে। তবে ইন্ডিয়ানরা শুধু ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্যই নয়, চারিত্রিক দৃঢ়তা বোঝানোর জন্যও বিভিন্ন রংয়ে আঁকা জুতা পরিধান করতেন। ইন্ডিয়ানদের উপর যারা তৎকালীন সময়ে আগ্রাসন চালিয়েছিল সেই আগ্রাসনকারীরাই নিজেদের প্রয়োজনে মোকাসিন জুতাকে নিজেদের জুতা বলে দাবি করে। ইউরোপে রানী এলিজাবেথের সময়ে আইন করা হয়েছিল যে কেউ যদি জুতা বানাতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই ৫১/২ ইঞ্চি জুতা তৈরি করতে হবে। এই দৈর্ঘ্য প্রস্থের বাইরে জুতা তৈরির অধিকার একমাত্র রাজপরিবারেরই ছিল।
খুব বেশি আগেকার কথা নয়, ৪০০ বছর আগ পর্যন্ত আমেরিকাতে মানুষ শুধু এক ধরনের জুতাই পরত। প্রথম আমেরিকাতে সু-মেকার নিয়ে আসে থমাস বিয়ার্ড নামের এক ভদ্রলোক এবং তিনি নিজেও সুমেকার ছিলেন। ১৫০০ সালের শেষের দিকে তিনি প্রথম লন্ডন থেকে জুতা তৈরির কারিগর নিয়ে আসেন। এরাই পরবর্তিতে জুতার মান উন্নয়ন সহ বিভিন্ন প্রকার মেশিনারি আবিস্কার করে অনেক জুতা বাজারজাতকরণ করা শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৫৮ সালে লেম্যান আর. ব্লেক নামের এক ইংলিশ ম্যান প্রথম জুতার বিভিন্ন অংশ জোড়া দেবার আধুনিক মেশিন আবিস্কার করেন। যদিও গর্ডন মেকাই নামক এক ব্যক্তি লেম্যানের যন্ত্রের পেটেন্ট কিনে নেন।এবং তিনি জুতার উপরিভাগের সাথে তলার সংযোগের উন্নয়ন করেন।
১৮০০ সালে গোড়ার দিকে জন এডাম ডাগির প্রথম জুতার ফ্যাক্টরী চালু করেন। জান মেটলিঞ্জার সেসময় যে জুতা তৈরির মেশিন আবিস্কার করেন তা দিয়ে প্রতিদিন ৭০০ জুতা তৈরী করা যেত। যখন হাতে জুতো বানানো হতো বলে কেউ তখন কোনদিন ভাবতেও পারেনি যে শুধুমাত্র মেশিন দিয়ে কখনো জুতা তৈরি করা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ১৮৪৫ সালে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জুতা তৈরির কারখানা স্থাপন করে। এই সময়ই প্রথম যন্ত্র দ্বারা জুতা তৈরি করা হয়। আর এই যন্ত্রের আবিষ্কার করেন “এলিস হাও”।তবে গর্ডনের প্রতিষ্ঠিত জুতা কোম্পানিই যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর জুতা তৈরি করে। যুদ্ধ পরবর্তীকালে এই কোম্পানিটি জনসাধারণের জন্য জুতা তৈরি শুরু করে।
রেনেসাঁর পূর্বে ইউরোপের অভিজাত ব্যক্তিরা বিভিন্ন নকশার জুতা পরতেন বলে জানা যায়। তবে এখন যে ধরনের ফিতাযুক্ত জুতা দেখা যায় তা আবিষ্কৃত হয় ১৭৯০ সালে, ইংল্যান্ডে।
১৮৫০ সালের আগ পর্যন্ত জুতা আমদানি বা রপ্তানি করা হতো না। সেসময় ১৬৬৫ - ৭০ সালের মধ্যে নির্মিত ‘অক্সফোর্ড স্যু’ বিশ্বের অনেক দেশেই রপ্তানি করতে শুরু করে লন্ডন। একই সময়ে ১৪৯০ সালে জার্মানিদের তৈরিকৃত ‘ভাল্লুকের থাবা’ নামে পরিচিত জুতাও রপ্তানি শুরু হয়।
১৮০০ সালের আগে পর্যন্ত ইউরোপে নারী-পুরুষের জন্য আলাদা কোনো জুতা ছিল না। একই ডিজাইন এবং দৈর্ঘ্যের জুতা সবাইকে পরিধান করতে হতো। কিন্তু ১৮০০ সাল পরবর্তীকালে জুতার উপরিতলের অংশে চামড়ার বদলে সিল্কের কাপড় ব্যবহার করে নারীদের জন্য পৃথক জুতা তৈরি করা হয়। সিল্কের ব্যবহারের পর জার্মানি, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডও সিল্কের জুতা তৈরি করতে শুরু করে। এক্ষেত্রে বেলজিয়াম অনেকটাই অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে। তারা নারীদের জন্য তৈরিকৃত জুতায় সিল্কের উপর বিভিন্ন নকশা করতে শুরু করে, যা সেই যুগের এবং সময়ের সাংস্কৃতিক চর্চার ধারাবাহিকতা ধারণ করতো।
১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে আইরিশ-আমেরিকান উদ্ভবক হামফ্রে ও’সুলিভান রাবার হিলের পেটেন্ট পান।
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম সফলভাবে তৈরি স্নিকার উৎপাদন ও বিক্রয় শুরু হয়। প্রথম দিকে এই স্নিকার শিশু ও টেনিস খেলোয়াড়েরা ব্যবহার করত।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের পর রাবার, প্লাস্টিক, সিনথেটিক কাপড় এবং আরও বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে জুতার নতুন নতুন নকশা শুরু হলো।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার এই সময় স্টিলেটো হিল নামে লম্বা, চিকন হিলের জুতা বাজারে আনেন। সারা বিশ্বে নারীদের কাছে তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে বিশ শতকের শুরুতে যে অ্যাথলেট জুতা পরিচিতি পেয়েছিল এই সময়টাতে বিশ্বব্যাপী তা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এভাবেই জুতার আধুনিকায়নের শেষের ২০০ বছরের মধ্যেই জুতার ব্যাপক পরিবর্তন ও পরিমার্জন সাধিত হয়। এবং সারা বিশ্বের মানুষের কাছে জুতা পৌঁছে যায় নানা রূপ ও আকারে।
তবে বর্তমানে ৪০,০০০ বছর পূর্বের চাহিদাটা বিলাসীতায় পরিণত হয়েছে। আমেরিকার ধনাঢ্য পরিবারে লোকেরা তাদের উচ্চমূল্যের জুতা সংরক্ষণের জন্য আলাদা ওয়াকিং রুম ব্যবহার করে থাকে যার তাপমাত্রা বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।এবং অপর দিকে ক্রয় ক্ষমতার বাইরে থাকায় পৃথিবির বেশিরভাগ মানুষ এখনো জুতা ব্যবহার করতে পারে না।
তাই সকল বস্তুর চাহিদা অনুসারে বিস্তারের পাশাপাশি যেন তার সহজ লভ্যতাও বজায় থাকে। ।
কোন মন্তব্য নেই: