জিনাত মহল। মহল আলো করা বেগম। মোগল বংশের শেষ সম্রাজ্ঞী। সম্রাট বাহাদুর শাহের বেগম। অন্য সব বেগমদের চেয়ে একটু যেন আলাদা। ছাইচাপা আগুন তার বুকের ভেতর ধিকিধিকি জ্বলত। জ্বলে জ্বলে সে আগুন একদিন পেল প্রচন্ড শক্তি। ফেটে পড়ল দারুণ তেজে। জীনাত মহল কে নতুন করে চিনল সবাই। তিনি হলেন সংগ্রামী বেগম। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল সাম্রাজ্যে দুর্দশা নেমে আসে। যোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে মোগল শক্তি। এই দুর্বলতার সুযােেগ এগিয়ে আসে বণিক ইংরেজরা। ভারতের রাজনীতিতে ধরে ধরে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। দুর্বল মোগল সম্রাটদের বানিয়ে ফেলে তাদের হাতের পুতুল।
আঠার শ সাইত্রিশ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ সিংহাসনে বসেন। তখন ইংরেজরাই দেশের সর্বেসর্বা। তারা বাহাদুর শাহকে মোটা টাকা বৃত্তি দিয়ে দিল্লির শাহী দূর্গে অলস জীবনের ব্যবস্থা করেছিল। আর নিজেরা পর্দার আড়ালে বসে তুলে নিয়েছিল রাজদন্ড। শুধু তাই নয়, ক্রমে ইংরেজরা এমন সব বিধি জারি করতে লাগল যে, ভবিষ্যতে মোগলদের হাতে ক্ষমতা ফিরে আসার পথ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। বৃদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ কোনো ঝামেলায় জড়াতে চান না। তিনি কবিতা লিখে আর ঘুড়ি উড়িয়ে অবসর কাটান। কিন্তু ইংরেজদের ওপর সন্দেহ গভীর হল বেগম জীনাত মহলের। লালকেল্লার ভেতরে বসে এই বেগমের লাল রক্ত টগবগ করে উঠল।
আঠার শ সাতান্ন সাল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে জীনাত মহল এর মতো অনেক দেশপ্রেমিকের বুকে ঘৃণা জমে উঠেছে। আশার আলো দেখতে পেলেন বেগম। গোপনে যোগাযোগ করলেন এই দেশপ্রেমিকদের সাথে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য উৎসাহ দিলেন। দেশপ্রেমিক যোদ্ধাদের মধ্যে একটি বড় অংশ ছিল সেনাবাহিনীর সদস্য। গোপনে তাদের সাথে সভা হয় বেগম জীনাত মহলের। সংগ্রাম নিয়ে কথা হয়। ঠিক করেন সবাই একযোগে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবেন, ইংরেজদের হটিয়ে দেবেন এদেশ থেকে।পারস্যের সাথে ইংরেজদের সম্পর্ক ভালো ছিল না। এ সময় পারস্য আর ইংরেজদের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়। জীনাত মহল সুযাগে গ্রহণ করলেন। পারস্য সম্রাটের কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য বাহাদুর শাহকে পরামর্শ দিলেন। সম্রাট দূত পাঠালেন পারস্যে। স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করার প্রস্তুতি নিলেন বেগম। বিপ্লবীদের সাথে গোপন বৈঠক বসত দিল্লির দুর্গে। জীনাত মহল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়ে সবাইকে উপদেশ দিলেন। ঠিক হল আঠার শ সাতান্ন সালের তেইশ জুন একযােেগ শুরু হবে বিপ্লব। সব ঠিকঠাক। এমন সময় গোল বাঁধলম ারাঠি। ব্যারাকপুর সেনা ছাউনির সিপাহি মঙ্গল পান্ডের আর তর সইছিল না। ঊনত্রিশ মার্চের সন্ধ্যায় সবাইকে অবাক করে দিল সে। অস্ত্র নিয়ে একাই ঝাঁপিয়ে পড়ল ইংরেজদের ওপর। পরিকল্পনার গতি গেল থেমে। নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই শুরু হয়ে গেল বিপ্লব। এবার ইংরেজরা প্রস্তুতি নেওয়ার যথেষ্ট সুযাগে পেয়ে যাবে। স্বাধীনতা কেড়ে আনা আর বুঝি সম্ভব হয় না। জীনাত মহলের মনে আশঙ্কা।
চারদিকে বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠল। ভারতীয় সিপাহি-জনতা বুকের রক্ত ঢেলে প্রতিশাধে নিতে লাগল, তাদের উৎসাহ হয়ে রইলেন বেগম জীনাত মহল। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জীনাত মহলের একটি নতুন রূপ ভেসে ওঠে। সংগ্রামী বেগমের কঠোর রূপের ভেতর থেকে ফুটে ওঠে তার কোমল মন। ইংরেজদের হাত থেকে পালিয়ে অনেক বিপ্লবী আশ্রয় নেয় দিল্লিতে। জীনাত মহল তাদের পাশে দাঁড়ান। আশ্রয় দেন দুর্গে। দিল্লির আশপাশে বাস ছিল চাকুরে আর ব্যবসায়ী ইংরেজদের। শত্রুপক্ষ বলে বিপ্লবীদের দ্বারা তাদের ভয় ছিল। জীনাত মহল এসব ইংরেজ নারী পুরুষদেরও আশ্রয় দেন। এদের জীবন রক্ষার ভার নিজ হাতে গ্রহণ করেন।
বিপ্লবীরা রক্ত ঢালছে অকাতরে। সবার মনে আশা। জীনাত মহলের চোখে স্বপ্ন, স্বাধীনতার আলো দেখতে পাচ্ছেন তিনি। বিপ্লবীদের রুখতে পারছে না ইংরেজরা। ইংরেজ সেনাপতিদের চোখেমুখে এবার দুশ্চিন্তার ছায়া। অবশেষে শেষ উপায় বের করল তারা। ওদের মাথায় ষড়যন্ত্রের দুষ্টবুদ্ধি খেলে যায়। দেশীয় সৈন্যদের ভয় দেখাতে শুরু করে। প্রচুর পুরস্কারের লোভ দেখায়। এতে ফল হয়। অনেক দেশীয় নেতা এবং সৈন্য ইংরেজদের সাথে যোগ দেয়। এদের মধ্যে সরাসরি অংশ নেয় শিখ সৈন্যরা। দেশীয় সৈন্যদের এই বিশ্বাসঘাতকতা বিপবের মাড়ে ঘুরিয়ে দেয়। এবার বিপ্লবীদের পরাজয়ের খবর আসতে থাকে। বিজয়ী ইংরেজরা দিল্লির দোরগাড়োয় উপস্থিত। আর তো ওদের ঠেকিয়ে রাখা যায় না। জীনাত মহল দ্রুত ভাবছেন। ইংরেজরা নিশ্চয়ই কাউকে ক্ষমা করবে না। অবশেষে তিনি T সিদ্ধান্ত নিলেন। বিপ্লবীদের পালিয়ে জীবন বাঁচানারে নির্দেশ দিলেন। বৃদ্ধ সম্রাটকে নিয়ে নিজে আশ্রয় নিলেন হুমায়ুনের সমাধিতে। ইংরেজরা দখল করল দিল্লি। এমনি করে শেষহল চার মাসের যুদ্ধ। স্বাধীনতার আলো জ্বলতে গিয়েও নিভে গেল। ইংরেজরা সন্ধান পেল সম্রাটের। বন্দি হলেন সম্রাট বাহাদুর শাহ আর সংগ্রামী বেগম জীনাত মহল। শুরু হল বিচারের নাটক। সম্রাট আর বেগম দন্ড পেলেন। তাদের নির্বাসন দেওয়া হল সুদূর বার্মার পাহাড়ি নির্জনে। নিজেদের দেশ-জাতি ছেড়ে চলে যেতে হল বার্মায়। সংগ্রামী বেগমের শেষ জীবন ছিল বড় কষ্টের। সাধারণ প্রজার মতো দিন কাটে। বার্মার নির্জনে সম্রাটের সেবা করেন। সান্তনা দেন, দিন গড়ায়। এক-দুই করে মাস পেরোয়। নিঃসহায় অবস্থায় মারা যান দিল্লির শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ। যে সংগ্রামী বেগমের তেজ একসময় বিপ্লবীদের জাগিয়ে তুলেছিল। কী করুণ অবস্থায় তিনিও হারিয়ে গেলেন। রেখে গেলেন স্মৃতি। তৈরি করলেন ঐতিহ্য।
- মজার ইতিহাস বই থেকে