-->

একজন জহির রায়হান


ইসরাত জাহান ইশিকা,(রংপুর):


নিঃসন্দেহে "জহির রায়হান" বাংলাদেশের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম।হ্যাঁ, আমাদের প্রিয় লেখক ও পরিচালক "জহির রায়হানে" কথাই বলছি। কমবেশি সকলেই তাকে চিনি।আজ নাহয় তাঁর একটু খানি জীবন বৃত্তান্ত নিয়েই বলি!
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে  মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ব্যাপক অবদান রেখেছেন এই মনীষি। ভারতবর্ষে তখন চলছে ব্রিটিশ শাসন।বাংলার মানুষ যখন ব্রিটিশদের কাছে নিপীড়িত  তখন  ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট আমাদের বাংলাদেশের ফেনি জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি,যেটা তখন ছিলো ফেনি মহুকুমার। মো.জহিরুল্লাহ খান তাঁর পুরো নাম।ছোট থেকেই  বাংলাকে ভালোবেসেছিলে গভীরভাবে। প্রথমে ব্রিটিশ শাসনের প্রত্যক্ষদর্শী পরে পাকিস্তান শাসনের।বর্বর শাসকদের শাসন দেখে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন জহির রায়হান। বাংলা ভাষা,বাংলার মানুষজন,বাংলার প্রকৃতিকে বেশ আপন করে নিয়েছিলেন তিনি,যার প্রভাব দেখা যায় তার জীবনের পরবর্তী সময়ে।১৯৪৭ পর্যন্ত পরিবারসহ ভারতেই বাস করছিলেন জহির রায়হান,ভারত বিভাগের পর চলে আসলেন আমাদের বাংলায়।এরপর "বাংলা" নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আগেই বলেছি তার জীবনে বাংলার প্রভাব ব্যাপক। মেধাবী এই তরুণ তার কর্মজীবন শুরু করেন সাংবাদিক হিসেবে, ১৯৫০ সালে,যুগের আলো পত্রিকায়।সে সময় "যুগের আলো" ছিলো পূর্ব বাংলার বেশ বড় মাপের  পত্রিকা। পরে অবশ্য "খাপছাড়া" " যান্ত্রিক" "সিনেমা" পত্রিকাতেও কাজ করেছিলেন। এরপর আসে ১৯৫২,বাংলার মানুষের ভাষার জন্য আন্দোলন। তখন টগবগে এই তরুণ আন্দোলন করেন।১৯৫২ এর ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায় অংশ নেওয়ার জন্য যে সকল ভাষা সংগ্রামী গ্রেফতার হয়েছিলেন,জহির ছিলেন তাদের মধ্যে। 

কৈশোর থেকে দারুণ আগ্রহ ছিলো সিনেমার প্রতি।তাই তরুণ বয়সে সুযোগ খুঁজছিলেন সিনেমায় কাজ করার।পশ্চিম পাকিস্তানের ছবিতে কাজ শুরু করেন সহকারী পরিচালক হিসেবে।১৯৫৬ তে কাজ করেন প্রবাহ সিনেমায়।এরপর পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি "সঙ্গম" পরিচালনা ও প্রযোজনা করেন ১৯৬৪ সালে। সিনেমার কাজের পাশাপাশি চালিয়ে যান লেখালেখি। তাঁর প্রথম উপন্যাস " শেষ বিকেলের মেয়ে" প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। ১৯৫২ এর প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখেছিলেন "আরেক ফাল্গুন"। তৎকালীন বাংলার সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতির চিত্র উঠে এসেছে " হাজার বছর ধরে", "বরফ গলা নদী", " জীবন থেকে নেয়া উপন্যাসে।"  পরে তিনি "নিজেই জীবন থেকে নেয়া" উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমা নির্মাণ করেন।তাঁর লেখা উপন্যাসেগুলো এতো বছর পরেও বেশ জনপ্রিয়। 
১৯৬১ সালে প্রথম বিয়ে করেন সুমিতা দেবিকে,সাত বছরের মাথায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন সুচন্দাকে।দুজনই ছিলেন সেই সময়ের প্রখ্যাত অভিনেত্রি।
১৯৬৯ সালে বাংলার গণঅভ্যুত্থানে সরব আন্দোলন করেন জহির রায়হান। ১৯৭১ এ শুরু হয় বাংলাকে স্বাধীন করার মরণপন যুদ্ধ। তাতে অংশ নেন এই কিংবদন্তি। "জীবন থেকে নেয়া" ছায়াছবিটি সেসময়ে তিনি কলকাতায় প্রদর্শিত করেন। সেখানে জনপ্রিয়তা পায় ছবিটি। সত্যজিৎ রায়ের মতো বড় বড় পরিচালকদের দ্বারা  প্রশংসিত হন তিনি। ছবিটি প্রদর্শন করে যে টাকা আয় হয়েছিলো তার পুরোটাই জহির দিয়ে দেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য গঠিত ট্রাস্টে,যদিও সে সময়ে ব্যাপক অর্থকষ্টে ছিলেন তিনি। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়,স্বাধীনতার তিন দিন পর পা রাখেন স্বাধীন বাংলায়।
বলে রাখা ভালো, জহির রায়হানের ভাই " শহিদুল্লাহ কায়সার"।তিনি ছিলেন বুদ্ধিজীবি,লেখক ও সাংবাদিক। মুক্তিযুদ্ধের একদম অন্তিমকালে,১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর, পাক বাহিনীরা বুদ্ধিজীবিদের উপর যে বর্বরতা চালায়,তার শিকার হয়েছিলেন শহিদুল্লাও। জানা যায় মিরপুরে বুদ্ধিজীবিদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতে হয়েছে।এবং সেটি ছিলো অবাঙালি মুসলিমদের বাসস্থান,যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিলো। ১৯৭২ এর ২১ জানুয়ারি পুলিশ যায় বুদ্ধিজীবিদের খোঁজে, পুলিশের সাথে ভাইয়ের খোঁজে তিনিও যান। পুলিশ দেখে গুলিবর্ষণ শুরু করে বিহারিরা। খুব সম্ভবত সেখানেই শহিদ হন তিনি। ভাইয়ের খোঁজে গেলেও তাঁর এবং ভাইয়ের লাখ খুঁজে পাওয়া যায় নি। যদিও পরে পুলিশ দখল করে জায়গাটা।সমাপ্তি হয় একজন মেধাবি ও যোদ্ধার।তিনি একাধারে লেখক, পরিচালক,সাংবাদিক স্বাধীনতা সংগ্রামি ছিলেন। মাত্র ৩৬ বছরের জীবনে দেশের জন্য ও মানুষের জন্য অনেক কিছু করেছিলেন। স্বাধীন বাংলায় আরও কিছু সময় পেলে হয়তো দেশকে দিতে পারতেন আরো অনেক কিছু।



একজন জহির রায়হান একজন জহির রায়হান Reviewed by সম্পাদক on মঙ্গলবার, নভেম্বর ০৯, ২০২১ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.