বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানী শব্দটি শুনলে প্রথমে তোমার চোখের সামনে কী ভেসে ওঠে? ঝাকড়া চুলের কেউ? যে খুব মনযোগ দিয়ে টেস্টটিউব- বিকার হাতে নিয়ে গবেষণা করছে। নাকি খুবই গম্ভীর ভাবে কেউ বিশাল বিশাল অ্যালজেবরা সমাধান করছে? নাকি তোমার গনিত বা বিজ্ঞান বইয়ের কোনো একটা কটমটে কঠিন ফর্মুলা তোমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে? যা কোনো দিনই তুমি ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারো নি।
অথচ আমাদের চোখের সামনে এসব ভেসে না উঠে, বিজ্ঞান শব্দটি শুনলে বিস্ময় এবং আনন্দে ঝলমল করে ওঠার কথা ছিল। বহির্বিশ্বে তথা আমেরিকা বা অন্যান্য দেশে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে যা ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের শেখানো হয়। সেটি "Science is fun" অর্থাৎ বিজ্ঞান মানে মজা। কিন্তু আমাদের ছোটবেলা থেকেই হলো, বিজ্ঞান একটি কঠিন, কটমটে রসকসহীন বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে এবং যথারীতি আমরা বিজ্ঞানকে ভয় পাচ্ছি। বিজ্ঞান মানেই বাঙালীর কাছে কঠিন, বিজ্ঞান| মানেই ভীতি। হ্যাঁ এটা সত্য যে, পূর্বের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশে বিজ্ঞান পড়ুয়া | শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। তাতে কি আসলেই বিজ্ঞান সাধনা বাড়ছে? এই বিজ্ঞান পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের থেকে কি নতুন কিছু উদ্ভাবন হচ্ছে? আর যারা বিজ্ঞান পড়ছে তারা কতটুকুই বা বিজ্ঞান কে ভালোবেসে বা জানার জন্য পড়ছে?
সবাই তো পরীক্ষায় কোনো ভাবে এ প্লাস পেলেই বর্তে যায় কখনো কি মনে হয়েছে আমাদের দেশে কেনো এখনো কোনো বিজ্ঞানী বা উদ্ভাবক তৈরী হচ্ছে না? আসলে ছোটবেলা থেকেই আমাদের বলা হচ্ছে প্রচুর পড়াশুনা করতে হবে, এ প্লাস পেতে হবে, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, তা হতে না পারলে বিসিএস পাশ তো তোমাকে দিতেই হবে। এই এত চাওয়া পাওয়ার পেছনে ছুটতে ছুটতেই বাঙালীর জীবন শেষ। বাঙালীর একটু বিজ্ঞান বা সংস্কৃতি মনস্ক হওয়ার সুযোগ কোথায়? আমাদের দেশ যে বহির্বিশ্বের থেকে এখনো অনেকাংশে পিছিয়ে আছে তার একমাত্র কারণ আমরা এখনো সম্পূর্ণ ভাবে | বৈদেশিক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। আমাদের আজও কোনো নিজস্ব | আবিষ্কার বা প্রযুক্তি নেই বললেই চলে। কারণ আমাদের দেশে বিজ্ঞান বই থাকলেও বিজ্ঞান চর্চা হয় না, সাইন্স ফেয়ার হলেও সাইন্সের কেয়ার কেউ করে না। আমরা এখনো বুঝেই উঠতে পারি নি যে, আমাদের দেশে যতদিন বিজ্ঞান চর্চা হবে না, যতদিন এই জাতি বিজ্ঞানমনা হবে না। এবং যতদিন এই দেশে নবীন উদ্ভাবক বা বিজ্ঞানী তৈরী হবে না ততদিন আমাদের দেশ তথা রাষ্ট্রের উন্নতি সম্ভব নয় এবং এই দেশ প্রকৃত অর্থেই অগ্রসর হতে পারবে না।
আজকাল শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানমুখী করার জন্য সরকার এবং আমাদের দেশের সম্মানিত বুদ্ধিজীবিরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন করছেন। তাদের এই প্রচেষ্টা কে | সাধুবাদ জানিয়ে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই যে, এই প্রতিযোগিতাগুলো কি আসলেই কোনো কাজে আসছে? আসলেই কি শিক্ষার্থীরা এই প্রতিযোগিতাগুলো কে | সিরিয়াসলি নিচ্ছে? নাকি এটিও তাদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক এ প্লাস পাওয়ার মতো শুধু পুরস্কার পাওয়ার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ বেশির ভাগ প্রতিযোগিতাতেই আমার দেখা চেনা প্রজেক্টগুলোকেই নতুন উদ্ভাবন নামে উপস্থাপিত হতে দেখি। আর দেখি বিভিন্ন ধরনের রং-বেরংয়ের কর্কশীটের শিল্পকর্ম। প্রথমে আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছে এই প্রতিযোগিতার আসল উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব বোঝাতে হবে। তারপর এ প্রতিযোগিতাটি আসলে কী, বিজ্ঞান মেলা আসলে কী বা কিসের জন্য তা বোঝাতে হবে। তাহলেই হয়তো প্রতিযোগিতাগুলো স্বার্থক হয়ে উঠবে। সর্বোপরি বাঙালীর বিজ্ঞানের যে এই দুর্দশা এ থেকে কাটিয়ে ওঠার উপায় কী? কি করলে বাঙালীর বিজ্ঞান মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এই সকল সমস্যার সমাধান বাঙালী বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত 'ভাঙার' পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন “আমাদের দেশে শিক্ষিতদের মধ্যেও বিজ্ঞান চর্চা তেমন করিয়া ছড়াইয়া পড়ে নাই। দেশী ভাষায় সাহিত্যের যেমন উন্নতি হইয়াছে, বিজ্ঞানের তেমন হয় নাই। ইহা তাহার একটি প্রমাণ। এমন হলে এদেশের ইউনিভার্সিটিকে এই দেশের অবস্থা ও অভাব বিশেষভাবে বিচার করিয়া কাজ করিতে হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই। অন্য দেশের অনুকরণ করিতে গেলে সে দেশের লোকে যে ফল পাইতেছে তাহাও পাইব না, আমরা যে ফল আশা করিতে পারিতাম তাহা হইতেও বঞ্চিত হইব। প্রথম পরিচয়ের স্বাদ বিস্তার করিবার জন্য শিক্ষার প্রণালীকে সরল করা চাই।....... বিজ্ঞানের কূটতত্ত্ব ও কঠিন সমস্যা নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই যে উদ্ভাবনী শক্তি বাড়ে তাহা নহে। প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয়, ভাল করিয়া দেখিতে শেখাই বিজ্ঞান সাধনার মুখ্য সম্বল। বিজ্ঞান পন্ডিত্যে যাহারা যশস্বী হইয়াছেন, তাঁহারা যে বিদ্যালয়ে অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষা দিয়া বড় হইয়াছেন তাহা নহে। আমাদের দেশে আমরা যদি যথার্থ বিজ্ঞানবীর অভ্যুদয় দেখিতে চাই, তবে শিক্ষার আদর্শ আরও দুরহ ও পরীক্ষা কঠিন করিলেই সে ফল পাইব না। তাহার জন্য দেশে বিজ্ঞানের সাধারণ ধারণা ব্যাপ্ত হওয়া চাই এবং ছাত্ররা যাহাতে পুঁথিগত বিদ্যার শুষ্ক কঠিন্যের মধ্যে বদ্ধ না থাকিয়া প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষ করিবার জন্য বিজ্ঞান দৃষ্টি চালনার চর্চা করিতে পারে, তাহার উপায় করিতে হইবে।"
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর এই উপদেশ যে বর্তমান বাঙালীর বিজ্ঞান কে মাথাচাড়া দিয়ে তুলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বাঙালীরা উপদেশটা ঠিক ভাবে মানসেই হয়। আশা করছি পাঠক বন্ধুরা আমার এই লেখা পড়ে বিজ্ঞান চর্চার গুরুত্ব বুঝতে পারবে এবং বিজ্ঞান চর্চায় আগ্রহী হবে। একদিন এই দেশে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীদের | জয়জয়কারের প্রত্যাশায় রইলাম। জয়তু বিজ্ঞান।