-->

শূন্য থেকে ডিজিটাল কারেন্সি।

- মৃন্ময় দাস,(রংপুর)।

গ্রীষ্ম শেষে বর্ষা নেমেছে। ক'দিনের বৃষ্টিতে গরম টাও এখন বেশ কম।  কিন্তু "টাকার গরম" তো মাস বছর পেরিয়ে বেড়েই চলেছে!

আচ্ছা, এই "টাকা" কি?

টাকা=অর্থ=সম্পদ।

মানে যার সম্পদ আছে, তার অর্থও আছে, তার কাছে টাকাও আছে। কিন্তু এই টাকা তো শুধু মাত্র একটা কাগজের টুকরো ছাড়া আর কিছুই না! বলে না, "টাকা হলো হাতের ময়লা", হাত ধুলেই ময়লা ছাফ, টাকাও গাপ!

এখন সবার কাছে টাকা। টাকা ছাড়া আমরা আমাদের জীবন এখন কল্পনাও করতে পারি না। কিন্তু যখন টাকা ছিল না তখন কি মানুষ জীবিকা নির্বাহ করত না?  নিজেদের কল্পনা করত না?

আচ্ছা এবার তাহলে জেনে নেয়া যাক এই টাকা বা অর্থের ভূত ও ভবিষ্যৎ-

এক সময় মানুষ ছিল আদিম, বর্বর। মানুষের ছিল না অধিক কোনো চাহিদা বা আশা।  তারা গুহায় থাকতো, প্রয়োজনে গাছের পাতা ও ছাল পরিধান করত ও শিকার করে খাদ্য সংগ্রহ করত।  তাদের জীবন তাদের মতোই বেশ চলে যেত।  তাই তাদের কোনো অর্থ-সম্পদ বা টাকার দরকার হয়নি।

এরপর মানুষ সময়ের সাথে ধীরে ধীরে সভ্য হয়ে উঠতে লাগল। তারা কৃষিকাজ ও পশু পালন কিভাবে করতে হয় তা শিখলো। তাই তখন তারা বিভিন্ন দল ও পরিবারে ভাগ হয়ে গিয়ে কলোনি গঠন করে কৃষিকাজ শুরু করল।  প্রত্যেকে তাদের সাধ্য মতো জিনিস উৎপাদন করত।  তখন মানুষ বুঝতে পারল যে তার নিজের প্রয়োজনের সব কিছু সে একা উৎপাদন বা সংগ্রহ করতে পারছে না। তাকে অন্য সব জিনিস অন্য কারো কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। কিন্তু অন্য কেউ কেনো তার জিনিস আরেক জনকে দিবে?

তাই তাদের মধ্যে বিনিময় প্রথার প্রচলন শুরু হয়। ধরি, কেউ ধান উৎপাদন করে এবং আরেকজন মাছ ধরে। তাই  যে শুধু মাছ ধরে তার তো শুধু মাছ খেয়ে স্বাভাবিক জীবন চলবে না,  আবার,  যে শুধু ধান উৎপাদন করে সেও তো শুধু ভাত খেয়ে দিন কাটাতে পারে না।  তাই ধানওয়ালা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান মাছওয়ালাকে দিয়ে তার কাছ থেকে মাছ নিবে এবং একই ভাবে মাছওয়ালাও তার মাছের একটা অংশের বিনিময়ে ধান পাবে।  এভাবে কলোনি বা সম্পূর্ণ সমাজের সবাই সবার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ল এবং নিজেদের প্রয়োজন মতো একে অপরের সাথে দ্রব বিনিময়ের মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করা শুরু করল।

এই বিনিময় প্রথা প্রায় এক লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে চালু ছিল। কিন্তু সমাজে এবং অর্থনীতিতে এর কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই প্রথা শুধু অপরিচিতদের অথবা ক্ষমতাবান শত্রুদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। অন্য অ-আর্থিক সমাজ পরিচালিত হতো প্রধানত  উপহার ও ঋণের দ্বারা।


এরপর সময়ের সাথে সাথে মানুষ আরো সভ্য ও চিন্তাশীল হয়ে উঠতে লাগলো। বাড়তে লাগলো মানুষের প্রয়োজন। এবং মানুষের সবসময়ের অভ্যাস হলো কিভাবে জীবন ও জীবনযাত্রাকে আরো সহজ ও সাবলীল করে তোলা যায়। এর থেকেই উদ্ভব ঘটে একটি অর্থনৈতিক মাধ্যমের, তা হলো কড়ি বা মুদ্রা 'র।

এর ফলে পণ্য বা দ্রব্য বিনিময়ের প্রয়োজন হত না। যার যখন যতটুকু উৎবৃত্ত দ্রব্য থাকত তখন সে সেটা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের( কড়ি/মুদ্রা) বিনিময়ে বিক্রি করতে পারত এবং যার প্রয়োজন সে কিনতে পারত। এর ফলে প্রতিটা দ্রব্যের একটি নির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণ করা হয়।  যার জন্য সকল দ্রব্যের সঠিক অর্থের বিনিময়ে আদান প্রদান সম্ভব হয়। এর ফলে, বিনিময় প্রথাতে দ্রব্য বিনিময়ের মধ্যে যে বৈষম্য হতো বা সময়ের অপচয় হতো তা দূর হয়। এভাবেই অর্থ বিনিময়ের একটি নির্দিষ্ট মাধ্যম বা মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়।

এই মাধ্যমের প্রচলন শুরু হয় প্রায় তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বে মেসোপটেমিয়া সভ্যতা থেকে। আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার সমাজে প্রায়ই ব্যবহৃত হতো কড়ির শেল। তবে সে সময়ে সমুদ্র থেকে কড়ি সংগ্রহের অধিকার ছিল শুধু রাজাদের। প্রচলিত মুদ্রা প্রায় দুই হাজার খ্রীষ্টপূর্বের আশে-পাশে সংগঠিত হওয়া দু'টি মৌলিক অভিযোজন থেকে ক্রমবিকাশ লাভ করে। মুলত অর্থ মুদ্রা প্রাপ্তির একটি প্রকার ছিল যা প্রাচীন কালের মেসোপটেমিয়া (তখনকার ইজিপ্টের সামার)  এর দেবালয়ের ভান্ডারে সঞ্চিত রাখা শস্যকে প্রতিনিধিত্ব করত। মজুদ মূল্যকে প্রতিনিধিত্ব করতে বিভিন্ন ধাতু এবং পণ্যসমূহকে প্রতিনিধিত্ব করতে বিভিন্ন প্রতীক ব্যবহৃত হওয়া প্রচলিত মুদ্রার এই পর্যায়টি "ফারটাইল ক্রিসেন্ট" এ দেড় হাজার বছরেরও অধিককাল ব্যবসা বাণিজ্যের ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। এই পর্যায়ে প্রচলিত মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত ধাতু নিজেই মূল্যের ভাণ্ডার হিসেবে পরিগণিত হতে। প্রথমে রূপা, পরবর্তী পর্যায়ে রূপা এবং সোনা উভয়ই, এবং এক সময়ে তামা মিশ্রিত ধাতু ব্যবহৃত হতো। হেবোডেটাসের মতানুসারে, লিডিয়ানসরা সর্বপ্রথম স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার ব্যবহার করে।অবশ্য আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে সুমেরিয়রা বার্লি বিক্রির জন্য প্রথম ধাতব মুদ্রা ব্যবহার করে। আধুনিক পণ্ডিতদের মতে, সাড়ে ছয়শো থেকে ছয়শো খ্রীষ্টপূর্বে আবিষ্কৃত হয় প্রথম স্ট্যাম্প কয়েক বা প্রতীক যুক্ত মদ্রা।

টঙ্কন ব্যবহৃত হওয়া অধিক সংখ্যক বৃহত্তর অর্থনীতিতে তামা, রূপা ও সোনার মুদ্রার তিনটি স্তর গঠন করত। সোনার মুদ্রাসমূহকে বাজারি পরিমাণের ক্রয়-বিক্রয়, সামরিক খরচ আদায় এবং রাষ্ট্রের কার্যপ্রণালীতে সহায়তা করার জন্যে ব্যবহার করা হতো। রূপার মুদ্রাসমূহকে মধ্যম আকারের লেনদেন সমূহের কারণে ব্যবহার করা হতো। তাছাড়া, রূপার মুদ্রাসমূহ করের জন্য হিসাবের একক, চুক্তি এবং রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আনুগত্য আদায়ের জন্য ব্যবহৃত হতো। ঠিক সেইমত তামার মুদ্রাসমূহে সাধারণ লেনদেনের টঙ্কনকে প্রতিনিধিত্ব করা হতো। এই ব্যবস্থা মহাজনপদ-এর সময় থেকে প্রাচীন ভারতে প্রচলিত ছিল।

এই মুদ্রা সমূহ সকলই একেকটি নির্দিষ্ট এলাকা বা গোষ্ঠর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এক স্থানের মুদ্রার গুরুত্ব অন্য স্থানে ছিল না। এভাবে প্রতিটা স্থানে নিজস্ব মুদ্রা এলাকা বা রাজ্য গড়ে ওঠে।

এভাবেই ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে মুদ্রার প্রচলন ঘটতে থাকে ও বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এক রাজ্যের সাথে অন্য রাজ্যের অর্থ মূল্যের তুলনা ও সমতা ঘটতে থাকে। কিন্তু অধিক অর্থ বিনিময়ের ক্ষেত্রে, ধাতব মুদ্রার চাহিদা বৃদ্ধির জন্য এবং ধাতব মুদ্রা ক্ষয় প্রাপ্ত হতে থাকায় অর্থ ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দেয়। কারণ,  মুদ্রা বা কয়েন আকারে, অনেক অর্থ বহন বা বিনিময় করা কষ্ট সাধ্য এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে চাহিদা অনুযায়ী অধিক মুদ্রার প্রয়োজন হতে লাগল। এই অধিক মুদ্রার অনেক ধাতুর প্রয়োজন হতো।  তাই ধীরে ধীরে অাবির্ভাব ঘটে কাগজী অর্থমুদ্রার বা আমরা যাকে নোট বা টাকা বলে থাকি। এই "টাকা" শব্দটি এসেছে সংস্কৃত"টঙ্ক" থেকে যার অর্থ রৌপ্য মুদ্রা।

"প্রাক্-আধুনিক চীনে ধার এবং হাজারটি তাম্র মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে দেখা দেওয়া অসুবিধা দূরীকরণের জন্য একটা সুবিধাজনক বিনিময়ের মাধ্যম প্রচারের প্রয়োজনীয়তাই কাগজী অর্থমুদ্রার সূচনা করেছিল। এই কাগজী অর্থমুদ্রা আজকের দিনে সমস্ত ব্যাঙ্ক নোট বা কাগজী টাকা হিসাবে পরিচিত।"

এরপর থেকে ধীরে ধীরে এই নোট বা কাগজী অর্থমুদ্রার প্রসার বাড়তে থাকে।  কারণ এটি পরিবহন সহজ এবং তৈরির খরচ অনেক কম। এবং প্রতিটি রাজ্যে অর্থাৎ বর্তমানের প্রতিটি দেশের নিজস্ব মুদ্রা বা নোট রয়েছে। এবং এই নোট শুধু মাত্র সেই দেশের মধ্যেই কার্যকর। প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রয়েছে এবং রয়েছে টাঁকশাল। প্রতিটি দেশ তাঁর দেশের সম্পূর্ণ সম্পদের সমমূল্য পরিমাণ অর্থ মূল্যের নোট ছাপাতে পারবে।  কোনো দেশের টাকার পরিমাণ তাদের সম্পদের তুলনায় বেশি হলে তখন তাকে মূল্য স্ফীতি বলা হয়। 

প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সম্পদের ওপর নির্ভর করে প্রতিটি দেশের টাকার মূল্যের একটি নির্দিষ্ট মানদন্ড নির্ধারিত করা হয়েছে যাতে অন্য দেশের সাথে অর্থ ও পণ্যের বিনিময় করা সম্ভব হয়।

বর্তমান বিশ্বে আমার এখন সব সময় নোট বা টাকা ব্যবহার করে থাকি।  যেকোন প্রয়োজনে এই টাকা ব্যবহার করে পণ্য ক্রয় করে থাকি বা আমরা কোনো কাজ করলে তার মূল্য স্বরূপ টাকা পেয়ে থাকি। যা একটি ভৌত বস্তু, হাতে ধরা যায়, যন্ত্রে ছাপানো যায়।কিন্তু বিশ্ব ধীরে ধীরে ডিজিটালাইজড হচ্ছে।  অফলাইন কর্মকাণ্ডের থেকে বেড়ে চলেছে অনলাইন কর্মকাণ্ড। আমরা এখন ফোনের মাধ্যমেই টাকার বা অর্থের লেনদেন করতে পারি। পণ্য ক্রয়-বিক্রয় তো বর্তমানের সবচেয়ে বড় অনলাইন কর্মকাণ্ডের একটি। এই গ্লোবালাইজেশন, ডিজিটালাইজেশন মধ্য দিয়ে চলার সাথে সাথে মুদ্রা বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও হয়ে উঠেছে ডিজিটাল। উদ্ভব ঘটেছে ডিজিটাল কারেন্সির বা ভার্চুয়াল মুদ্রার, যা একটি অভৌত অর্থ, হাতে ছোঁয়া যায় না, যন্ত্রের ছাপানো হয় না। তবে এই ডিজিটাল কারেন্সি এখন পর্যন্ত বিশ্বের সকল দেশে প্রচলন বা ব্যাপ্তি ঘটেনি। কিন্তু বর্তমানের ইন্টারনেট ও অনলাইনের যুগে এই মুদ্রার লেনদেন চলছে। ফ্রিল্যান্সিনের মাধ্যমে আয় হলো এই লেনদেনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

এভাবেই শতাব্দী পর শতাব্দী ধরে এগিয়ে চলেছে বিশ্বের অর্থনীতি ও পরিবর্তন ঘটেছে অর্থ বিনিময়ের মাধ্যমের।সেই শূন্য থেকে শুরু হয়ে কড়ি, ধাতব মুদ্রা,টাকা হয়ে বর্তমানের ভার্চুয়াল মুদ্রা।...হয়তো ভবিষ্যতে এই ডিজিটাল কারেন্সিই হবে লেনদেন বা অর্থ বিনিময়ের একমাত্র মাধ্যম!!


শূন্য থেকে ডিজিটাল কারেন্সি। শূন্য থেকে ডিজিটাল কারেন্সি। Reviewed by সম্পাদক on রবিবার, আগস্ট ০৮, ২০২১ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.