গল্প: গ্রহান্তর।
লেখা: জেবা সামিহা তমা, (রংপুর)।
টিমুকে পৃথিবীর সবাই খুব পছন্দ করে। আর করবে নাই কেনো? টিমু অনেক পরোপকারী, উদার ও সদা হাস্যজ্বল একজন মানুষ। মানুষের স্নেহের পাত্রের এসব বৈশিষ্ট্যই তো থাকে। আর টিমু তার সব ভালো গুনের প্রমাণ সবরকম প্রতিকূল অবস্থায় দিয়েছে। কিন্তু সেই টিমু নিজের অজান্তেই একটা অপরাধ করে ফেলেছে। পুরো পৃথিবী অবাক! কেউ টিমুকে অপরাধী বলে ভাবতেই পারছে না। তবুও অপ্রিয় সত্যি সবাই মানতে বাধ্য হলো। পৃথিবীবাসী দুঃশ্চিন্তা করছে বিচারক তাকে কোন গ্রহে পাঠাবে? সেখানে টিমু থাকতে পারবে তো? পৃথিবী সবচেয়ে শান্তির গ্রহ। এখানে কেউ অপরাধ করলে তার এক মাত্র শাস্তি গ্রহান্তর। এটা পৃথিবীর সবাই জানে। টিমুর ভবিতব্যও একই। তবে কোন গ্রহে যেতে হবে এটা টিমু নিজেও জানেনা।
পৃথিবীবাসীর প্রিয় বিচারক টিমুর বিচার করছে। টিমু অসহায় চেহারা নিয়ে চুপ করে মাথা নিচু করে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। অনেক লজ্জা আর কষ্ট নিয়ে শুধু অপরাধ টুকু স্বীকার করেছে টিমু। তার এই অবস্থা দেখে পুরো পৃথিবীবাসী কাঁদছে। বিচারক অপরাধ সম্পর্কে জেনে অনেকক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে শাস্তি দিলেন টিমু কে প্লুটোতে পাঠানো হবে। টিমু শাস্তি শুনে প্রচণ্ড ভেঙ্গে পড়লো। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে টিমু বিচারকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলছে "আমি জেনে শুনে অপরাধ করিনি। আমাকে কে কি এই শাস্তি পাওয়া থেকে মুক্ত করা যায় না?" বিচারক টিমুর দিকে তাকালেন। মনে হচ্ছে তার দৃষ্টি টিমুকে বলছে "সজ্ঞানে কেউ অপরাধ করে না। অপরাধীকে শাস্তি দেয়া হয় এই কারণে যেনো সে পরে আবার জ্ঞান শূন্য না হয়ে পড়ে।" বিচারক এক কঠিন চরিত্রের মতো শাস্তি লিখলেন। সত্যিই পৃথিবীর কিছু কিছু চরিত্র বোঝা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।
বিচারক যে কলম দিয়ে শাস্তি লিখলেন সে কলম দিয়ে দিলেন যাদুঘরে রাখার জন্যে। যাতে সাধারণ মানুষের যাদুঘর ভ্রমণের সময় সেই শাস্তি দেয়া কলম দেখে অপরাধ করার প্রবণতা কমে যায়।
পৃথিবীর বিজ্ঞরা বেশি করে পড়াশোনা ও গবেষণা করছেন যদি কোনোভাবে টিমুকে শাস্তির হাত থেকে রক্ষা করা যায়। হোক সেটা আইন দিয়ে কিংবা বিজ্ঞান দিয়ে। টিমু জানে এই পৃথিবীর মানুষ তাকে কতো ভালোবাসে তাই সে কতৃপক্ষকে বলেছে তাকে প্লুটোতে পাঠানোর সব কাজ যেনো খুব গোপনে করা হয়। হঠাৎ করে প্রিয় মানুষকে হারানো আর ধীরে ধীরে নিজের চোখের সামনে প্রিয় মানুষকে হারিয়ে যেতে দেখার মধ্যে তফাৎ হলো প্রথমটিতে একবারে সব কষ্ট পেয়ে যায় আর এতে যন্ত্রণা বোধহয় কম হয়। টিমুর কথা মতো টিমুকে খুব গোপনে প্লুটোতে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। বর্তমান যুগের যানবাহন চলাচলে কোনো শব্দ হয় এমনকি রকেটেও না। তাই পৃথিবীর কেউ জানতেই পারলো টিমু কখন তাদের ছেড়ে চলে গেছে।
প্লুটোর সব কিছুই ঠিকঠাক শুধু মাঝেমাঝে পুরো গ্রহতে ঝড় হয়। তখন প্লুটো গ্রহ অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে থাকে এবং সেখানকার সব কিছু ওলট পালট হয়ে যায়। এমতাবস্থায় সেখানে একজন মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকবে সেটাই প্রশ্ন। টিমু রকেটে বসে এই ভাবনাটাই বেশি করেছিলো। নয় বছর পর টিমুর রকেট প্লুটোতে এসে পৌঁছালো। টিমু রকেট থেকে বের হয়ে দেখলো লালচে রং এর গ্রহ। চারদিকে শুধু শূন্যতা। টিমুর এখন পৃথিবীর মানুষকে বেশি করে মনে পড়ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর টিমু রকেট থেকে তার প্রয়োজনীয় সব জিনিস নামিয়ে নিলো। এরপর রকেট স্বয়ংক্রিয় ভাবে চলে গেলো। টিমুর খারাপ লাগাও আরও বেড়ে চললো। তবুও টিমু যেখানে নেমেছিলো সেখান থেকে একটু দূরে গিয়ে নিজের বাড়ি বানিয়ে নিলো। টিমুর শরীরে টিসটিসের দেয়া একটা জাদুর ব্যাগ বাঁধা আছে যেখান থেকে সবসময় খাবার পাওয়া যায় এবং ভবিষ্যৎেও যাবে। টিসটিস হলো টিমুর পৃথিবীর কাছের বন্ধুদের একজন। টিমু জাদু ব্যাগ থেকে খাবার খেয়ে ঘুমাতে গেলো। এখন আর সে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। অনেকক্ষণ চিৎকার করে কাঁদলো। একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
৩ মাস পার হয়ে গেলো। টিমুর সময় কাটে প্লুটোর ৫ টা উপগ্রহের সাথে গল্প করে। হঠাৎ ঝড় উঠলো। টিমু এতোদিনে প্রতিনিয়ত লড়াই করে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে প্লুটোর সাথে কিন্তু ঝড় কখনো মোকাবেলা করেনি। টিমু দ্রুত ঘরের ভিতরে গিয়ে দরজা জানালা সব বন্ধ করে দিলো। ধীরে ধীরে সব ঝাপসা হয়ে আসছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। প্লুটো গ্রহ কাঁপছে। টিমুর ঘরের সব ওলট পালট হয়ে ঘুরছে। অল্প কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে টিমুর বাড়ি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে এবং টিমু সজ তার সব জিনিস ছিটকে ঝড়ের মধ্যে মিশে গেছে। কয়েকদিন পর ঝড় থেমে যায়। টিমু একটু স্বাভাবিক হয়ে পুরো গ্রহ ঘুরে নিজের জিনিসপত্র খুঁজে আবার বাড়ি তৈরি করে জীবনযাপন শুরু করে।
এভাবে কেটে যায় ২৪৮ বছর। টিমু তখন নতুন সূর্য দেখছে। হঠাৎ টিমু একটা রকেটের শব্দ শুনতে পায়। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা প্রায়ই বিভিন্ন যানবাহন পাঠায় ঠিকই কিন্তু এই শব্দটা ধীরেধীরে বেশি হয়ে আসছে। টিমু বাইরে বেরিয়ে দেখে একটা রকেট প্লুটোতে এসেছে তার গায়ে পৃথিবীর চিহ্ন। টিমু রকেট দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। কতদিন পর যেনো টিমু আবার বেঁচে উঠলো। চোখে জল নিয়ে রকেটের কাছে যেতেই একটা রোবট বেরিয়ে এলো রকেট থেকে। টিমু কিছু বলার আগে রোবট তার দিকে একটা চিঠি এগিয়ে দিলো। টিমু কৌতূহল নিয়ে চিঠি পড়া শুরু করলো। চিঠি পড়ে অবাক হয়ে গেছে সে। চিঠিতে লেখা - "টিমু, তুমি অপরাধ করোনি সেটা সবাই জানি কিন্তু আমরা যদি তোমাকে এভাবে না ফাঁসিয়ে দিতাম তাহলে প্লুটোর গবেষণা হতোই না। কারণ কেউ স্বেচ্ছায় প্লুটোতে গিয়ে থাকতে রাজী নয়। তুমি সব ভুলে পৃথিবীতে এসে আমাদের সাহায্য করতে চাইলে রোবটের কাছে সুইব বক্স আছে সেখানে সবুজ বোতাম একবার চাপ দাও। আমরা তোমার অপরাধের শাস্তির থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দিবো। আর নাহলে লাল রং এর বোতাম প্রেস করে প্লুটোতেই থেকে যাও।
- ইতি
গিলখঃ কোম্পানি"
টিমু চিঠি পড়ে ভাবলো পৃথিবীতে যাওয়ার এই সুযোগ হাত ছাড়া করা উচিত নয়। তাই সবুজ বোতাম চাপ দিয়ে রোবটের সাথে পৃথিবীতে ফিরে গেলো। আর মনে মনে ঠিক করলো সবাইকে ক্ষমা করে দিয়ে সে প্লুটোতে থাকা অভিজ্ঞতা নিয়ে গবেষণা করবে।
অলঙ্করণ: সৌহাত রাশেদিন।