গল্প: মমতা।
লেখা: ইসরাত জাহান ইশিকা,(রংপুর)।
প্রতিদিন বেশ সকালেই ঘুম থেকে উঠে তমা,উঠেই ফ্রেশ হয়ে চলে যায় মর্নিং ওয়াকে। মর্নিং ওয়াকে ওর সঙ্গী ওর লেখক বাবা জালাল উদ্দিন। তো রোজকার মতো আজও বাবাকে নিয়ে বের হলো তমা,এই সময়টক বড্ড প্রিয় ওর,কি সুন্দর ফুরফুরে বাতাস! বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই পার্ক,সেখানেই ওরা হাঁটে।হাঁটতে হাঁটতে ওরা আলোচনা করে বই নিয়ে,দেশ বিদেশের অনেক লেখকদের নিয়ে। বাবার হাত ধরে লেখালেখি শুরু হয়েছিলো ছোট্টবেলাতেই,এখনো লেখে ও,তাই এসন বিষয় আলোচনা করে দুজনেরই ভালো লাগে।পার্কটাও ভালো লাগে ওর,খুব বড় নয়,মফস্বলের যেমন হয় আরকি।
বেশ কিছুদিন থেকেই তমা লক্ষ্য করছিলো একটা আইসক্রিমের দোকান বসে পার্কে,তার পাশে ঘুরঘুর করে দুটো ছেলেমেয়ে।বয়স আট-দশের বেশি হবে না। ওরা টাকা চায় না,ওরা চায় ওই আইসক্রিমের দোকান থেকে যেন ওদের আইসক্রিম কিনে দেওয়া হয়।প্রথমে ব্যাপারটা স্বাভাবিক লাগলেও গেল এক সপ্তাহ ধরে কিছু কথা ওর মনে কিছু প্রশ্ন তৈরি করে দিয়েছে। সেদিনও বাচ্চা ছেলেমেয়ে দুটো আইসক্রিম খাওয়ার জন্য বায়না করছিলো,বাবা দুজনকেই আইসক্রিম কিনে দিয়েছেন।তারপর তমার কাছে এসে বললেন, " বুঝলি রে মা, এদের বয়সটা বায়না করার, এরকম আবদারের, তবে ওদের মতো বাচ্চাদের পেটের দায়টা অনেক বড়,সাধারণত ওরা এসব শখ মনে রাখে না,কিন্তু ওদের দেখ সকাল সকাল বেড়িয়েছে আইসক্রিম খাওয়ার জন্য, দেখ ওরা ওদের শখকে পূরণ করতে এতো সকালে উঠে রোজ।"
এই কথাটাগুলোই একটা জায়গা নিয়ে নেয় ওর মনে। ওই আইসক্রিম ওয়ালা কে চিনতেন বাবা। অনেক আগে ওর দাদুবাসায় কাজ করতেন তিনি।তখন সবেমাত্র কিশোর।আইসক্রিম খেতে খেতে গিয়ে লোকটা একদিন বলেন " স্যার আপনি জালাল উদ্দিন না?
সাহেবপুরের? আমারে চিনছেন? আমি রহিম।আপনাগো বাড়িতে কাজ করতাম যে। এভাবেই খুঁজে পায় ওরা।তবে নিজের পরিবার নিয়ে বেশি কিছু বলতে চায় না রহিম।
সেদিন থেকে রোজ আইসক্রিম খায় ওরা।আর বাচ্চা দুটোকেও খাওয়ায়।
এক সপ্তাহ বেশ ব্যস্ততায় কেটেছে ওর। অনলাইন পরিক্ষা,ক্লাস এসব নিয়ে বেশ ব্যস্ত ছিলো ও। কিন্তু সেদিন একায় পার্কে আসে তমা।বাবার নাকি কি লেখা আছে তাই আসলেন না।
আজও বাচ্চা দুটো এসেছে। হাঁটা শেষে বাচ্চাগুলোর কাছে আসে তমা। বাচ্চার দুটোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বেশ নরম সুরে কথা বলে ও।
তোমাদের নাম কি?
-আমার নাম জরি।উত্তর দেয় মেয়েটা।
-আর আমার নাম রাকিব। এবার উত্তর দেয় ছেলেটা।
-তোমরা কি বন্ধু?
- হ আপা,কিন্তু আমরা নিজের ভাইবোন,জরি আমার ছোট। কিন্তু বেশি দেওয়ানি।
ফিক করে হেঁসে ফেলে তমা। রাগি রাগি চোখে রাকিবের দিকে তাকায় জরি।
আচ্ছা আইসক্রিম কি তোমাদের খুব পছন্দের? আবার প্রশ্ন করে তমা।
- হ আপা ভালোই লাগে তো।উত্তর দেয় জরি।
- তাহলে খুব ভালো লাগে না?
-এক জিনিস পত্যেক দিন খাইলে কারো রি ভাল্লাগে না আপা। জ্ঞানিদের মতো উত্তর দেয় রাকিব।
- তাহলে খাও কেন প্রতিদিন? এতো সকালে উঠে আইসক্রিম খেয়ে কি হয়? আর এতে ঠান্ডাও লাগে।
তমার প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় জরি। একগাল হেসে রাকিব বলে,ব্যাপার আছে আপা, বুঝবেন না।
কেন বুঝব না? তুমি বুঝবা আর আমি বুঝবো না?
- নাহ আপা।
বলে ফেল চট জলদি,না হয় আমি আর কাল থেকে তোমাদের আইসক্রিম খাওয়াব না।
এবার তমার কথায় আটকা পড়ে যায় রাকিব। কিছুটা কাছে এসে বলে,আগে কন কাউরে কবেন না।
আচ্চা কাউকেই বলব না।
আপা এই যে আইসক্রিমওয়ালা,উনি আমার আব্বা। উনি আমাদের সাথে নিয়া আসে। প্রায় ৬ মাস হইতেছে এমন করে বেড়াই আমরা।আব্বার দোকানের চারদিক ঘোরা ফেরা করি আর যে যায় তারেই ধরি আইসক্রিম কিনে দেওনের জন্য।এতে করি আমাদেরও কিছু খাওন হয় আর আব্বারও বিক্রি হয়।এইটা হইলো আমাদের গোপন ব্যাপার।বলেই দাঁত ক্যালিয়ে হাসে রাকিব।
মুখটা অন্ধকার হয়ে যায় তমার।ছোট্ট দুটো বাচ্চা ছেলেমেলে কিভাবে সাহায্য করছে ওদের পরিবারকে! পেটের দায়ই পৃথিবীর সব থেকে বড় দায়, এর জন্য কত অভিনয়,কত চালাকি আর কতোই না কষ্ট!
নানা চিন্তা মাথায় আসে তমার। নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করে প্রতিদিন যে আইসক্রিম খাও ঠান্ডা লাগে না?
হ আপা টুকটাক কাশি সদ্দি তো আমাদের সারা বছরে থাকে ওটা কিছু না,তয় একবার আমাদের দুইজনের এক লগে জ্বর আইছিলো,চার-পাঁচদিন থাইকা ঠিক হইয়া গেইছে,ওগলা কিছু না। সাবলিল ভাষায় উত্তর দেয় রাকিব।
আরও অবাক হয়ে যায় তমা।ওর মনে হচ্ছে জরি আর রাকিব বাচ্চা না,ওরা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে।জীবনের নির্মম রুপ দেখে ফেলেছে ওরা। নিষ্ঠুর জীবনের এই সূক্ষ সত্য গুলোকে কত না সহজ ভাবে নিয়েছে ওরা!
কি হইলো আপা? চুপ কইরা আছেন যে? এবার প্রশ্ন করে জরি।
হ্যাঁ? নাহ রে কিছু না। আজ তোমরা আমার বাসা যাবে আমার সাথে? সারাদিন থেকে সন্ধ্যায় তোমাদের বাড়ি দিয়ে আসব।খুব মজা করবো সারাদিন।
তমার কথায় ওরা ততক্ষনাত খুশি হলেও, মুখ গোমরা করে জরি বলে,আব্বা কইছে যারা এরকম কথা বলে ওরা ছেলেধরা,কিন্তু আমি জানি আপনি ছেলেধরা নন।
জরির দিকে চোখ পাকায় রাকিব।
ইতস্তত করে রাকিব তমাকে বলে,আপা আব্বারে কন,দেহেন যাইতে দেয় কি না।
অনেক বুঝিয়ে ওদের বাবাকে রাজি করায় তমা।আসার সময় ওর বাসার ঠিকানা ওর মোবাইল নম্বর দিয়ে আসে ওদের বাবাকে।সাথে সামন থেকে বাবাকে দেখিয়ে দেয় ওদের বাড়িটা। শেষে রাকিবদের বস্তির ঠিকানাটাও নেয়।
জামালউদ্দিনের সাথে এই ব্যাপারটা নিয়ে আগেই আলোচনা করেছিলেন তমা। এসে দেখে বাবা ড্রয়িং রুমে প্রতিকা পড়ছেন।এদিকে মাকেও কিছুটা আঁচ দিয়েছিলেন।তাই ওদের দেখে অবাক হন না তেমন।তবে খুব অবাক হয় জরি-রাকিব।পেটপুরে খায় তমার মায়ের বানানো পরোটা-মাংস।সবার সাথে অনেক গল্প করে ওরা। এরপর তমা নিয়ে যায় ওর ঘরে।সারাদিন অনেক মজা করে ওরা।একসাথে খেলে,গান গায়,ছবি আঁকে, গাছে পানি দেয়। দুপুরেও খায় ভালোভাবে।তমার মায়ের হাতের বানানো পোলাও-কোর্মা খেয়ে মুগ্ধ হয়ে যায় ওরা।বিকেলে ওদের নিয়ে ঘুরতে বের হয় তমা।চিড়িয়াখানা যায় আগে।তারপর যায় বাজারে।সেখান থেকে কিছু কাপড় কিনে দেয় ওদের।সবশেষে সূর্য ডোবার আগে বস্তির পথ ধরে ওরা তিন জন।
সারাটা দিন বিস্ময়ে কেটেছে দুই ভাইবোনের।ওদের মতো মানুষদেরও যে কেউ এতো আদর করতে পারে ভাবনাতেও আসেনি কখনো। কিন্তু কথা বলে যেন সেটা ঠিক প্রকাশ করতে পারে না।তাই ঘুরে ফিরে বলে " আপা আপনে অন্নেক ভালো। আমাদের কেউ এমনে আদর দেয় নাই কখনো,আজ খুব মজা করছি।" এই কথাগুলো গভীর ভাবে স্পর্শ করে তমাকে।ও ঠিক করে প্রতিদিন সকালে বাসায় খাওয়াবে ওদের। বস্তির ওদের ঘরের সামনে পৌছে যায় তমারা। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো ওদের মা। পরিচয় শেষে গল্প করে কিছুক্ষন। ফেরার সময় বসে ওদের দুই ভাইবোনকে আদর করে বলে,কাল পার্কে দেখা হবে।ওরা অন্যরকম একটা মমতা দিয়ে জড়িয়ে ধরে তমাকে।খেই হারিয়ে ফেলে তমা।এটা অন্যরকম এক স্পর্শ।এই স্পর্শ সম্ভবত ও কখনো পায় নি। যেখানে মিশে আছে দুটি নিস্পাপ শিশুর অকৃত্রিম ভালোবাসা।।
অলঙ্করণ: জুলকারনাইন তাহসিন।
গল্প: মমতা।
Reviewed by সম্পাদক
on
মঙ্গলবার, জুন ২৯, ২০২১
Rating: