গল্প: প্রশান্তি।
লেখা: ইসরাত জাহান ইশিকা,(রংপুর)
যা গরম পড়েছে আজ,কিছুই ভালো লাগছে না তিথির।করার মতো কোনো কাজও নেই।রোদের জন্য ছাদেও যেতে পারছে না। ওর সব বন্ধুরা এই ছুটিতে কোথাও না কোথাও বেড়াতে গেছে।শুধু ওরাই কোথাও যায় না। ওরও তো ইচ্ছে হয় বেড়াতে যেতে। ওর কাছে মনে হয় কান্তানগরীর এই বাসাটা থেকে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই ওর। হ্যাঁ, বছরে অবশ্য ৩ বার ওরা দাদুবাড়ি যায়। একই জায়গা কি বারবার যেতে ভালো লাগে বলো? ওরো তো ইচ্ছে হয় নীল সমুদ্রে গোসল করতে,পাহাড় বেয়ে উঠার সময় অবাক হয়ে মেঘ আর আকাশের হাতছানি দেখতে। যতবার বাবাকে বলে ও, বাবা প্রতিবারই বলেন,হ্যাঁ মা আমরাও তো যাব,এখানে যাব,ওখানে যাব, ট্রেনে করে যাব,তুই তো বাসে উঠতেই পারিস না! তিথি খুব ভালো করেই জানে এসব মিথ্যে আশ্বাস, তখনই গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। মা-বাবা খেয়াল করেন ওকে,কিন্তু কিছুই বলেন না।কিইবা বলবেন তারা? আর ভালো লাগে না ওর। মাকে বললে মা মাঝে মাঝে বলেন আমরাও তো যাব,কিন্তু সেই দিন কবে আসবে তা মাও জানেন না।আবার খুব বেশি মেজাজ খারাপ থাকলে মার কাছে অনেক কথাও শুনতে হয়!
এসব ভাববে না ও আর।যতই ভাববে ওর কষ্ট তত বেশি হবে। কাউকে কিছু না বলে বেড়িয়ে পড়লো তিথি।কোথায় যাবে তাও জানেনা।দূরে কোথাও না,হয়ত একটু হেঁটে আসবে আশপাশ থেকে, মনে করে ছাতাটা নিল,যা রোদ ছাতা না নিলে গা পুড়ে যাবে।তিথি বাসা থেকে বেড়িয়ে প্রথমে গেল বড় মাঠের দিকে,নাহ কেউ নেই।! মাঠে একা একা হাঁটতেও ভালো লাগছে না।মাঠের বা দিকের রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করল ও। এদিকে বাবা সহ দু একবার এসেছিলো।রাস্তাটা তো বেশ, অনেক গাছ,এইদিকে খুব আসা হয় না ওর।যখন বের হয় তখন খেলার মাঠেই ব্যাস্ত থাকে ওরা। হঠাৎ একটা বড় সেগুন গাছের নিচে বসে পড়লো তিথি।আহা,কি বাতাস! মনটাই ভালো হয়ে গেল ওর।আশপাশটা একটু নির্জন বলা যায়,লোকজন তো নেই।তখন একটা কালো মতো কুকুর এসে ওর সামনে দাঁড়াল, ভয় পেল না ও।অনুগ্রহ ভরা চোখ দুটো নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে কুকুরটা,ওর কি খিদে পেয়েছে? না তিথির কেন জানি মনে হল,অন্য কিছু বলতে চায় ও।উঠে দাঁড়ালো তিথি।কুকুরটার কাছে যেতেই,ঘেউ ঘেউ বলে ডাকা শুরু করলো ডানদিকে,পেছন ফিরে দেখলো তিথি আছে কিনা,না আছে তিথি।তিথিও ওর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো ,বেশি দূর হাঁটতে হলো না ওর,একটু এগিয়েই ও দেখতে পেল একটা গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে ছোট্ট একটা কুকুরছানা।কিন্তু গর্তের উপর নানা জঞ্জাল থাকায় উঠতে পারছে না ।মা কুকুরটাও করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,সেও নামতে পারছে না।আর কিছু না ভেবে বসে পড়ে তিথি।সরাতে থাকে জঞ্জালগুলো।কত কাঁচের বোতল, বড় বড় ইট,কাঠ রাখা,দ্রুত সরিয়ে ফেলে ও। আর ঠিক তখনি লাফিয়ে ওদের কাছে চলে আসলে ছানাটি।এসেই মায়ের কোলে ঢুকতে চায়।মাও নিজের সবটুকু দিয়ে আদর করে ছানাটিকে।ইশ! কি সুন্দর দৃশ্য,ছলছল করে তিথির চোখ।মুগ্ধ হয়ে দেখে মা-সন্তানের মিলনের দৃশ্য,কিছুক্ষন পর ওরা দুইজন চোখভরা অনুনয় আর ভালোবাসা নিয়ে তাকিয়ে থাকে তিথির দিকে। এগিয়ে গিয়ে দুইজনকেই আদর করে তিথি।তারপর দুহাতে জড়িয়ে ধরে নিয়ে বলে,ভালো থেকো বন্ধুরা,আজ আমি খুব খুশি,যাই এখন তাহলে?ওরা যেন তিথির কথা বুঝতে পারে। তিথির পেছন পেছন হাঁটা শুরু করে।ফিরতি পথে হঠাৎ থেমে তিথি বলে,"আর এসো না তোমরা,ভালো থাকো,আবার দেখা হবে"।দাঁড়িয়ে যায় ওরা।তাকিয়ে থাকে তিথির দিকে যতক্ষণ না অদৃশ্য হয় ও। আপনমনে পথ চলতে থাকে তিথি। কোথায় যেন খুব প্রশান্তি হচ্ছে ওর। অন্য রকম ভালো লাগা ছুঁয়ে যাচ্ছে তিথিকে। ও হাতের পিঠ দিয়ে মুছে ফেলে চোখ।মনে মনে ও ভাবে,যদি ওরা ঘুরতে যেত তাহলে আজকে এই প্রশান্তির অনূভুতিটা মিস হয়ে যেত, কুকুরছানাটাও হয়ত সুস্থভাবে মায়ের কাছে ফিরে আসত না। সবকিছুর পেছনেই ভালো কিছু থাকে যা সামনে আসেই, তবে কিছু প্রতিক্ষার পর।
অলঙ্করণ: মাহিম বিন রশিদ, (সৈয়দপুর)।