জেবা সামিহা তমা,(রংপুর):
১৯৯০ সালের ১০ই এপ্রিল ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে জন্ম নেয় জামাল হ্যারিস ভূঁইয়া। বাবা ইনসান ভূঁইয়া ও মা রাজিয়া আক্তার বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ থেকে ষাটের দশকে পাড়ি জমান ডেনমার্কে। জামাল ভূঁইয়ার শৈশব কেটেছে প্র্যানপিতে এবং বড় হওয়া কোপেনহেগেনে।
ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের অবস্থা যখন ভয়ানক তখন একদিন ১৭ বছর বয়সী জামালের শরীরে বিঁধে ৪টি গুলি, সে যাত্রায় বেঁচে যায় তার প্রাণ। আর পাঁচটা সাধারণ বাবা-মায়ের মতো জামালের বাবা-মা তাকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চেয়েছিলেন কিন্তু জামালের গতানুগতিক পড়াশোনায় মন না বসায় নিজে ইন্টারনেট ঘেঁটে পড়াশোনা করলেন আইটি নিয়ে। নিজে নিয়মের পড়াশোনা না করেও হয়ে গেলেন ডেনমার্কের একটি হাই স্কুলের ইংরেজি ও ইতিহাস শিক্ষক কিন্তু ভাগ্যের লিখন আর কে খন্ডাতে পারে। আজকে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক।
ডেনমার্কের ফুটবল ক্লাব প্র্যানপির যুব পর্যায়ের হয়ে প্রথম ফুটবল খেলেন জামাল ভূঁইয়া কিন্তু তার খেলা বিকশিত হয়েছে যখন তিনি কোপেনহেগেনের ফুটবল ক্লাবের হয়ে যুব পর্যায়ে ফুটবল খেলেন। এরপর ডেনমার্কের হেলেরপ, বোল্ডক্লুবেন, আভেডোর হয়ে খেলার কথা হলেও একটি মাত্র ম্যাচ খেলেছেন তিনি এবং সেই ম্যাচে একটি গোল করেন।
কিন্তু এতো কিছুর পরেও দেশের টান ভুলে থাকা সম্ভব হয়নি জামালের তাই ২০১১ সালে বাংলাদেশে চলে আসেন ডেনীয় ফুটবলার জামাল ভূঁইয়া। ডেনমার্কের আর বাংলাদেশের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়ায় মানিয়ে নিতে পারেনি জামাল। এমনকি প্রাক্টিসের সময় বারবার পানি খাওয়ায় খেলোয়াড় থেকে স্টাফ সবার হাসির পাত্র হয়েছিলেন তিনি। তেল-ঝালের খাবারের দেশে মানিয়ে নিতে না পারায় ডি-হাইড্রেশনের কারণে জাতীয় দলে যায়গা করে নিতে পারেনি জামাল। ক্ষোভে, দুঃখে ডেনমার্কে ফিরে যায়, নিজের শোককে শক্তিতে পরিণত করার জন্যে প্রচুর পরিশ্রম করেন। আবার ফিরে আসেন বাংলাদেশে এবং ২০১৩ সালে ডাচ কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফের হাত ধরে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে দেয়ার স্বপ্ন পূরণ হয় জামাল ভূঁইয়ার। ২০১৪ সালে এশিয়ার সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে নবম স্থানে ছিলেন জামাল কিন্তু তখন লোডভিক ডি ক্রুইফের চোখে জামাল এশিয়ার সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। কিন্তু শ্রীলঙ্কার কোচ নিকোলা কাভাজোবিচের এর মতে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হলেন জামাল ভূঁইয়া। অন্যান্য খেলোয়াড়রা তখন ডেনীয় একজন ফুটবলারকে মনে করছিলেন উড়ে এসে জুড়ে বসা কেউ। ডিফেন্ডার আতিকুর রহমান মিশু জামালের একমাত্র বন্ধু ছিলেন। ২০১৫ সালে কেরালার সাফ গেমসে দেখা যেতো মিশু ও জামাল প্রায় সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন। অন্যরা তখন বাঁকা চোখে তাকাত, ফিসফিসিয়ে কথা বলতো কিন্তু জামাল সেসব কষ্টকে গ্রাহ্য না করে বাংলাদেশের সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করছিলেন। তবে এখন দলের মধ্যমনি হয়ে উঠেছেন জামাল। দেশের জাতীয় সঙ্গীত কিছুই বুঝতেন না তবুও আন্দাজে ঠোঁট মিলানোর চেষ্টা করতেন যদিও জামাল দাবি করেন এখন তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পারেন। এমনকি বাংলাটাও বলতে পারতেন না। তবে এখন ভাংগা হলেও বাংলায় মনের ভাবটা ভালোই প্রকাশ করতে পারেন তিনি।
২০১৪-১৬ সাল পর্যন্ত শেখ জামালের হয়ে ফুটবল লীগ খেলেন জামাল ভূঁইয়া তখন ১টি লীগ শিরোপা সহ মোট ৩টি শিরোপা জয় করেন শেখ জামাল। এরপর শেখ রাসেল, বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব ২৩ দল, সাইফ স্পোর্টিং এ খেলেন তিনি। সম্প্রতি দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশী কোনো খেলোয়ার ভারতের কলকাতা মোহামেডানের হয়ে খেলেছেন, আর তিনি হলেন জামাল। গোল না পেলেও তার অবদানেই একের পর এক জয় লাভ করে মোহামেডান। তাই তো মোহামেডানেরও মধ্যমনি হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
ব্যক্তিগতভাবে জয়লাভ করেন ২০১৫ বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার।
বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক খেলার নিজের অভিষেক করেন ২০১৩ সালের ৩১ শে আগস্ট।
এখন তো জাতীয় দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া।
২৭ বছর বয়সে যখন পরিবার থেকে চাপ দেয়া হয় বিয়ে করে ডেনমার্কে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্যে তখন তিনি নিজের পরিবারের আদেশ অমান্য করে নিজের দেশে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ইউরোপের এতো জাঁকজমক জীবনযাত্রাকে না করে মাত্র ৫ লক্ষ টাকার বেতনে দেশের হয়ে ফুটবল খেলাটা অবশ্যই মহান দেশপ্রেমের পরিচয়। জামাল বলেন " আমার জন্ম ও বেড়ে হওয়া ডেনমার্কে হলেও আমি এই দেশের মাটির ছেলে। " এবং তিনি আরও বলেন " ১৭ কোটি মানুষের দায়িত্ব তার পরিবার ও বন্ধুদের থেকে দূরের থাকার কষ্টকে ভুলিয়ে দেয়। "
২০২০ এর শেষের দিকে এসে করোনা আক্রান্ত হয় জামাল ভূঁইয়া এরপর করোনাকে জয় করে আবারও খেলায় ফিরে এসেছেন তিনি। এত এত বাঁধা বিপত্তি কাটিয়ে যখন বাংলাদেশের ফুটবলের হাল ধরেছেন জামাল তখন বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন পূরণের আশা করাই যায়। অনেক শুভকামনা রইলো জামাল ভূঁইয়ার জন্য। তার জন্মদিনে আমাদের আশা ১৭ কোটি মানুষের দেশ উজ্জ্বল হবে জামাল ভূঁইয়ার নামে।
