লেখা: জাবির ফেরদৌস রাফি, (রংপুর)।
১.
স্যুপে চুমুক দিচ্ছিলো লোকটা । তাড়াহুড়ো নেই। স্যুপ খাওয়া আর বসে থাকার জন্যই অঢেল টাকা দেয়া হচ্ছে তাকে । এটাই তার কাজ। খাও আর বসে থাকো। আর মাঝে অন্যের সুখের সংসারে নজর দাও।
"ঠিক সময়মতোই এসেছে।" হাতঘড়ি দেখলেন লোকটা । সুদর্শন একটা ছেলের সাথে ঠিক সময়মতোই এসেছে সানা জাভেদ। ভুল তথ্য দেয়নি সিধু।
একদিকের কোনার টেবিলে বসলো ওরা। তাতেও অবশ্য সমস্যা নেই 'র' এর এজেন্টের। সবই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সানা আর তার বয়ফ্রেন্ডকে ঠিকই নজরে রাখা যাচ্ছে। কোনো সমস্যা নেই।
ওয়েটারকে ডাকলো ছেলেটা। মেন্যু থেকে ব্রাউন উইন্ডসোর স্যুপ অর্ডার করলো। খাবার আসতে আসতে কথা বলছে ওরা, হাসিমুখেই,, হাত ধরে রেখেছে ।
কথাবার্তা ভালোই চলছে। তবে একটু আড়ষ্টতা খেয়াল করলো 'র' এর এজেন্ট। "প্রথমবার দেখা করছে হয়তো, তাই এমন" নিজেকে বোঝালেন তিনি।
মেয়েটা কালো নাইট গাউন পড়েছে। গলায় দামী একটা নেকলেস, হয়তো ছেলেটা দিয়েছে। আর ছেলেটা পড়েছে চমৎকার একটা সাদা শার্ট , জিনস আর বুট। পিওর ক্যাপ্টেনস থার্সডে বুট না হলে 'র' এজেন্ট অন্যকিছু সন্দেহ করতেন।
স্যুপ শেষ করে অ্যাসপারগাস আর পোচড স্যালমনের অর্ডার দিলো ছেলেটা। 'র' এজেন্ট, যিনি নজর রাখছেন সানা আর ওর বয়ফ্রেন্ডের উপর, নিজের জন্য মাটন, রোস্ট পটাটো আর অ্যাসপারগাস অর্ডার করলেন।
ততক্ষণে সুদর্শন ছেলেটা সানার হাতে একটা আংটি পড়িয়ে দিয়েছে। কথাবার্তা স্বাভাবিকই লাগছে।
কফি শেষ করে উঠে পড়লো ছেলেটা। বিল বকশিশ মিটিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। নিজেই ড্রাইভ করলো।
মেয়েটাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেল ছেলেটা। পুরো সময়টা ওদের ফলো করলেন 'র' এর এজেন্ট মনোজ শর্মা। ছেলেটা চলে যাওয়ার পর ফোন লাগালেন ডিরেক্টর জেনারেল কে।
পরদিন সকালে দিল্লির বাড়িতে বসে চমৎকার একটা খবর পেল সানা জাভেদ। সানা ইলতিজা জাভেদ। সুপ্রিম কোর্ট তাকে তার মায়ের সাথে দেখা করার অনুমতি দিয়েছেন। সাতদিনের জন্য। মায়ের স্বাস্থ্য নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তার সাথে দেখা করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিল সানা। আজ তার ফলাফল আসলো। সব রেডিই ছিল। দ্রুত এয়ারপোর্টে রওনা করলো । গন্তব্য কাশ্মীর।
শ্রীনগর এয়ারপোর্টে নামলো সানা । কেউ তাকে নিতে আসেনি। অবশ্য আসার প্রশ্নও ওঠে না। নিজেই একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে বসলো। গন্তব্য চাশমে শাহী । গুগল ম্যাপে জায়গাটা দেখে নিল। এরপরই মনে পড়লো প্রেমিককে এখনো ফোন দেয়া হইনি। " হ্যালো রেজা। আমি ঠিক আছি...হ্যাঁ নিরাপদেই আছি...আচ্ছা আচ্ছা বেশ , দিল্লিতে যেয়েই দেখা করবো। বাই।" ড্রাইভারকে গুগল ম্যাপ দেখে পথ বলে দিচ্ছে সানা।
ঘন্টাখানেক পর গন্তব্যে আসলো। যেখানে ওর মাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। যেমনটা ভেবেছিল। গেটের আশেপাশে অসংখ্য পুলিশ। আধা সামরিক বাহিনীর একটা ভ্যান। ওদের সাথে প্রশিক্ষিত কুকুরও আছে।
পুলিশের একজন এসে ওর ব্যাগ চেক করলো। সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে ওকে ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিল। কাগজপাতি কিছুই দেখাতে হলো না সানাকে , কারণ দিল্লি পুলিশ ওর সম্পর্কে আগেই বলেছে এখানকার পুলিশকে।
গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলো সানা । মোটামুটি সাইজের একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি এটা। কী ভেবে ডেজার্ট ব্রাউন রং করা হয়েছিল সানা ভেবে পায় না।
মূল বিল্ডিংয়ে ঢাকার আগে কালো স্টেইলনেস স্টিলের দশাসই একটা দরজা। এখানেও চেক করা হলো ওর ব্যাগ। বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকেও চেকিংয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে ওকে।
যাই হোক , অবশেষে মায়ের সাথে দেখা করার সুযোগ হলো ওর। জড়িয়ে ধরলো মাকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মায়ের শরীর ভালো নেই। গৃহবন্দী থাকায় মানসিক অবস্থাও ভালো নেই। " তোমাকে এখান থেকে মুক্ত করবো মা!" চোখের পানি মুছে বললো সানা। মা বুঝতে পারলেন মেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে। হয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলছে। " ওদের হাতে অনেক ক্ষমতা মা।" মেয়েকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেন তিনি।
খাওয়া দাওয়া শেষে মেয়ের সাথে গল্প করতে বসেন রেহনুমা সুলতানা , কাশ্মীরের প্রথম নারী এবং সাবেক মূখ্যমন্ত্রী। সারাদিন গল্প চলল তাদের।
পরদিন সকালে চাকরবাকরদের ডেকে মিটিং বসালো সানা। মায়ের শরীর ভালো রাখতে কী কী করতে হবে তার একটা ফর্দ ধরিয়ে দিলো ওদের হাতে। ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলো মায়ের ভালো করতে হলে কী করতে হবে। ওদের অনেককেই অবশ্য দ্বিধাগ্রস্ত মনে হলো। সে যাক গে।
নেটওয়ার্ক অফ। রেজার সাথে কথা বলতে না পেরে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলো সানা। তবে মায়ের সান্নিধ্যও ভালো লাগছে ওর।
সাতদিন চলে গেল। এবারে চলে যেতে হবে। মেয়ের জন্য কাঁদছেন রেহনুমা সুলতানা। " আমি মরে গেলে তুই নরওয়ে চলে যাস।" মেয়েকে নির্দেশনা দেন তিনি।
মাকে বিদায় জানিয়ে চলে আসলো সানা। সোজা শ্রীনগর টু দিল্লি। সেখানে রেজা ওকে নিতে এসেছে। রেজার গাড়িতে করে যাচ্ছে ওরা। সেখানেই সানাকে লাঞ্চের অফার দেয় রেজা।
একই রেস্টুরেন্টে একই টেবিলে আবারও বসে ওরা। একইভাবে হাত ধরে গল্প করতে থাকে। এবারও মনোজ শর্মা তাদের ফলো করেন। কিন্তু তাকে হতাশ হতে হয়। সন্দেহজনক কোনো তথ্য পেলন না তিনি। হয়তো ভুল খবর দিয়েছে সিধু।
বাড়িতে ফিরে সিদ্ধান্ত নিলো সানা। নরওয়ে চলে যাবে। ভিসার জন্য বেরিয়ে পড়লো তখনি। কিছু কেনাকাটা করে সন্ধ্যা নাগাদ ফিরলো। রাতে সব গোছগাছ করে রেজাকে ফোন দিলো। পরদিন বিকালে ভিসা পেল এবং রাতেই রওনা করলো নরওয়ে।
ওই রাতেই আক্রান্ত হলো শ্রীনগরে মেহবুবা মুফতির বাড়ি!
২.
ঘড়ির কাটা দেড়টা পেরিয়েছে সবেমাত্র। কোথেকে যেন আরপিজির একটা গোলা এসে আধা সামরিক বাহিনীর ভ্যানটা উড়িয়ে দিলো। ভেতরে কেউ জীবিত নেই সম্ভবত। থাকলেও ওরা লড়াই করার অবস্থায় নিশ্চয়ই নেই!
পুলিশ বক্স থেকে পুরো বিষয়টা চুপচাপ খেয়াল করলো কনস্টেবল রাওয়াত। অন্যদের বেরোতে দেখে তারপর বেরোলো সে। সবাই যার যার পজিশন নিয়ে নিয়েছে। আক্রমণকারীকে এখনো দেখা যায়নি। সেই মুহূর্তে আরেকটা আরপিজির গোলা মেশিনগান পোস্টটা উড়িয়ে দিলো। অবশ্য ওতে মেশিনগানার ছাড়া আরকেউ হতাহত হয়নি।
হঠাৎ দুটো কালো আর্মার্ড লিমো কোথেকে যেন উদয় হলো। আপাদমস্তক কালো পোশাক আর বুলেটপ্রুফ পড়া একদল লোক ফায়ার করতে করতে বেড়িয়ে আসলো। সবার হাতে সাবমেশিনগান, উজি সম্ভবত। দুজনের হাতে এম-৪ কারবাইন। বেশ কজন পুলিশ প্রথম রাউন্ডেই ধরাশায়ী হলো। বাকিদের প্রতিরোধও তেমন কিছু মনে হলো না। ব্যাকআপ টিমের জন্য ফোন করেছে কনস্টেবল রাওয়াত।
দুপক্ষেই ফায়ার চলছে। একপক্ষ আরপিজির ব্যবহার একটু বেশিই করছে। দুটো আরপিজির গোলা একত্রে বাড়ির মেইনটা গেটটা উড়িয়ে দিলো। গেট বরাবর ভিতরে ঢোকার আগে গ্রেনেড লঞ্চ করলো সাদা শার্টের উপরে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পড়া রেজা। ফায়ার করতে করতে একাই ভিতরে ঢুকলো , বাকিরা বাইরের পরিস্থিতি সামাল দিক।
ভিতরে ঢুকে ফায়ার করলো রেজা। চারজন পুলিশকে বুলেট খাইয়ে দিলো। আরেকটা গ্রেনেড চার্জ করে বাকিদের মাটিতে শুইয়ে দিলো ।
ওয়াকিটকিতে কাউকে স্মরণ করলো ও। আরপিজির দুটো গোলা এসে অন্দরমহলে ঢোকার দরজাটা ভেঙ্গে দিলো। "ধন্যবাদ শাহেদ।" ওয়াকিটকিতে বলে রেজা।
" সানার তথ্যমতে নিচতলায় দুজন , দোতলায় তিনজন , বেডরুমের সামনে তিনজন।" মনে মনে আওড়ালো রেজা।
৩.
গৃহবন্দী থাকা রেহনুমা সুলতানার মেয়ে সানা ইলতিজা হাবিব মায়ের সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েছে; এই খবরটা কানে আসতেই কিছু একটা করার লোভ সামলাতে পারেনি আইএসআই। দিল্লিতে থাকা ওদের ফুলটাইম এজেন্ট, যাকে বলা হয় আইএসআইর ইতিহাসের সেরা এজেন্ট, রেজাকে দায়িত্ব দেয়া হয় রেহনুমা সুলতানাকে মুক্ত করে পাকিস্তানে নিয়ে। তাতে যত শক্তিই প্রয়োগ করতে হয় রেজা করুক। এবং তাতে আন্তর্জাতিক মহল যা ভাবে ভাবুক। এমনিতেই পাকিস্তানের ভাবমূর্তি খুব একটা উজ্জ্বল নয়।
যাইহোক, রেজা টার্গেট করে সানাকে। প্রথমে বন্ধু সেজেই কথা বলে ওর সাথে। সুদর্শন রেজার ডিনারের প্রস্তাব এড়াতে পারেনি সানা। ডিনারে গিয়েই হালকা কথায় পুরো বিষয়টা ওকে ক্লিয়ার করে রেজা। রেজা জানতো সানার উপর নজর রাখছে র এর গোয়েন্দারা। তাই সানার প্রেমিকের অভিনয় করতে হলো ওকে। র যে ওদের অভিনয় টের পায়নি বোঝাই যাচ্ছে।
সানা তার মায়ের সাথে দেখা করতে গেলো কাশ্মীরে। হৃদয়ে মা আর মাথায় রেজার দেয়া মরিয়া প্ল্যান বাস্তবায়নের বোঝা।
সানা দুটোই ভালোভাবে সামলায়। বাড়ির পুরো লেআউট আর সিকিউরিটির ডিটেলস মাথায় টুকে নিয়ে সাতদিন পর দিল্লিতে ফিরে রেজাকে সব জানায় সে। এবারও ওদের অভিনয়ে ঘোল খেয়েছে র!
রেজার দেয়া ওর জন্য নিরাপত্তা প্ল্যান আর মায়ের নির্দেশনা মেনে নরওয়ে রওনা করে সানা। আর কাশ্মীরে অভিযান চালায় রেজা।
৪.
রেজা ভিতরে ঢোকায় বাইরের দায়িত্ব নিলো ওর টিম। গেটের বাইরে রেজার ছোট্ট কমান্ডো দলটার সাথে খন্ডযুদ্ধ চলছে পুলিশের। দক্ষ কমান্ডোদের সামাল দিতে পারছে না ওরা । যেকোনো সময় আধা সামরিক বাহিনীর ব্যাকআপ টিম এসে যাবে। তার আগেই কাজ সারতে হবে রেজাকে।
অন্দরমহলে ঢুকে পড়লো রেজা। নিচতলার দুজনকে ফায়ার করার আগেই ওদের মেরে দিলো। সিড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতেই কেউ ফায়ার করলো , মাথা বাঁচিয়ে পাল্টা ফায়ার করলো রেজা। ওপাশের দুজনই প্রাণ দিলো। দোতলার তৃতীয় ব্যক্তিকে কতল করতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না ওকে।
বুলেটের আওয়াজ শুনে বেডরুমের সামনের দুজন গার্ড বেড়িয়ে এসেছিল , এসেই রেজার ফায়ারের মুখে পড়লো। ড্রয়িংরুম রান্নাঘর আরও দুটো ঘর পেরিয়ে বেডরুমের সামনে হাজির হলো রেজা । অবাক হয়ে গেল সাথে সাথেই। সানা তো এর কথা আগে বলেনি! নতুন আমদানি হয়তো। তবে রেজা চেনে ওকে।
প্রায় দরজার সমান লম্বা এক ব্যক্তি পাহারায়। কালো পায়জামা পাঞ্জাবি গায়ে। পাহাড়ের মতোই শারীরিক আকার। অসম্ভব শক্তি রাখে গায়ে বোঝাই যায়। বেডরুমে যাওয়ার আগে ওই পাহাড়ই শেষ বাধা। ব্যাকআপ পাওয়ার আশা কম। যা করার ওকেই করতে হবে। লড়াইয়ের জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে রেজা।
অবাক ভাবটা সামলে নিলো রেজা। নিরস্ত্র লোকটাকে আপাদমস্তক দেখে নিলো । মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল , "তুইই তাহলে কাশ্মীরের কালাপাহাড় খ্যাত মাধব রাও?"
মাধব রাওকে না চেনার কারণ নেই। ভারতের শ্রেষ্ঠ গেরিলা ফাইটার। ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধে দারুন কৃতিত্ব দেখিয়েছিল সে।
"চিনতেই যখন পেরেছিস , তখন হয়ে যাক ম্যান টু ম্যান কমব্যাট।" পাল্টা হেসে জবাব দিলো মাধব রাও। চ্যালেঞ্জ করলেও মাধব ভালোভাবেই জানে রেজা কতটা টাফ গাই। পাকিস্তানের সেরা বক্সারকে খালি হাতেই হারিয়েছিল সে, বক্সিং গ্লাভস ছাড়াই!
আর কথা বাড়াল না রেজা। পিস্তল ফেলে ছুটে গেল মাধব রাওয়ের দিকে। সোফার এক কোনায় পা রেখে লাফিয়ে পড়ল মাধব রাওয়ের উপর। অতবড় শরীরটার ভারসাম্য রক্ষা করতে পারলো না মাধব। রেজার সাথে সাথে ভূমি শয্যা নিতে হলো ওকেও।
উঠেই ঘরের উল্টোদিকে দৌড় দিলো রেজা। ফিরে এল হাতে একটা প্লাস্টিকের টুল নিয়ে। উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করছিল মাধব , একইভাবে ওর উপর ঝাপিয়ে পড়ল রেজা। প্লাস্টিকের টুলটা মাধবের পিঠের উপর ভেঙ্গে মাটিতে নামল। আঘাতটা কার্যকর হলেও মাধব রাওয়ের কাছে ওটা সামান্যই , রেজাও জানে ওই কথা।
কি মনে করে মাধবকে একটা সুপারম্যান পাঞ্চ মারতে গেছিলো রেজা , গলাসুদ্ধ ওকে ধরে ফেলল কালাপাহাড় খ্যাত মাধব রাও। ছুঁড়ে ফেলে দিলো ডাইনিং টেবিলটার উপরে। একগাদা গ্লাস জগ মগ নিয়ে মাটিতে পড়ে গেল রেজা। ঠোঁটের কোনা কেটে গেছে ওর , কনুইয়ে ভালোই আঘাত পেয়েছে।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে একহাতে টেবিলটা সরিয়ে ফেলে রেজার দিকে এদিয়ে গেল মাধব। উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করছিল রেজা , মাধব রাও ওকে উঠতে সাহায্য করলো। চুল ধরে টেনে তুলে রেজার চোয়ালে বিরাশি সিক্কার একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো । হাঁটু ভাজ করে পেটে বসিয়ে দিলো। হুঁক শব্দ করে ককিয়ে উঠলো রেজা। পেট থেকে সমস্ত দম বেরিয়ে গেছে ওর। ধাক্কা মেরে ওকে ফেলে দিলো মাধব রাও। মাটিতে পড়ে গেল রেজা। পড়েও অবশ্য শান্তি পেল না , ওর পাজর বরাবর পেনাল্টি কিক নিয়েছে মাধব রাও। কয়েকগজ দূরে ছিটকে পড়লো রেজা। প্রচন্ড ব্যাথায় কুঁকড়ে গেল ও। সম্ভবত পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে গেছে । উঠে দাড়ানোই কষ্টকর সেখানে ফাইট করা অসম্ভব। মাধব রাও অসম্ভব টাফ গাই। খালি হাতে ওর সাথে লড়াই করা আত্মহত্যার শামিল ।
" জান বাচানো ফরজ আর আত্মহত্যা মহাপাপ।" মনে মনে বলল রেজা। অ্যাকশনে গেল সাথে সাথেই । একটু দূরেই দাড়িয়ে আছে মাধব রাও , ওকে দেখছে আর বড় বড় দম নিচ্ছে। অ্যাঙ্কেল হোলস্টার থেকে ছুড়িটা বের করে মাধব রাওয়ের দিকে ছুঁড়ে দিলো রেজা। মাধবের এক চোখে গেঁথে গেল ওটা। ঘর কাঁপানো চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে গেল কাশ্মীরের কালাপাহাড় খ্যাত কিংবদন্তি পালোয়ান মাধব রাও।
উঠে দাড়াতে কষ্ট হলেও সময় নষ্ট করলো না রেজা। ওর ক্ষুদ্র দলটা বিপদে আছে । ওকে তারাতারি বের হতে হবে ওখান থেকে।
বেডরুমের দরজার সামনে গিয়ে নক করলো ও। কেউ খুলল না । ভিতরের মানুষ সম্ভবত ভয় পেয়েছে। উল্টো দিক থেকে ছুটে এসে লাথি মেরে দরজাটা খুলে ফেলল রেজা। ভিতরেই ছিলেন রেহনুমা সুলতানা। রেজাকে দেখে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলেন।
" ম্যাম আশা করছি সানা আপনাকে সব বলেছে।" বলে রেজা ।
"ত- তুমিই রেজা! আইএসআই এর রেজা!?" জিজ্ঞাসা করেন রেহনুমা সুলতানা।
" জি ম্যাম আমিই। আপনার জিম্মা আমার হাতেই" রেজা জবাব দেয়।
আর কোনো সন্দেহ থাকে না রেহনুমা সুলতানার। ওর সাথে বেরিয়ে পড়েন। রেজা নিজের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটটা ওনাকে দিয়ে দেয়।
" শাহেদ সব ঠিক আছে? আমি ম্যামকে নিয়ে আসছি।" ওয়াকিটকিতে কথা বলে রেজা। পিস্তল টা তুলে নিয়ে পুরনোটা বদলে নতুন আরেকটা ম্যাগাজিন লাগায় ।
" স্যার ওদের ব্যাকআপ টিম এসে গেছে। খুব ফায়ার হচ্ছে" ওপাশ থেকে জবাব আসে।
" তাহলে স্ট্রাটেজি বদলাতে হবে শাহেদ। তোমরা আমাকে লিমো পর্যন্ত যাওয়ার একটা রাস্তা বানিয়ে দাও" রেজা নির্দেশ দেয়।
" স্যার সেটা সম্ভব নয়। ওদের একটা টিম ইত্যিমধ্যেই আপনাদের উদ্দেশ্যে উপরে উঠছে। সাবধানে বেরিয়ে আসুন। আমাদের পক্ষে উপরে ওঠা সম্ভব নয়।" শাহেদ জবাব দেয়।
থমকে যায় রেজা। কিংকর্তব্যবিম্যুঢ় হয়ে যায় । হঠাৎ সিড়িতে বুটের আওয়াজ পাওয়া যায়। রেজা জানে ওরা কারা। কী করবে বুঝতে পারে না সে।
নখ কামড়াচ্ছে আর পায়চারি করছে এদিক ওদিক। আবারও অ্যাকশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় সে। টেবিলটা উল্টিয়ে ওটাকে কভার বানায় । মানে ওটার আড়ালে দাঁড়িয়ে ফায়ার করার ধান্দা আরকি! টেবিলটার দিকে এগিয়ে যাবে তখনি রেহনুমা সুলতানা ওর হাত চেপে ধরেন।
" আমাকে ফলো করো এজেন্ট রেজা।" কথা বলে ওঠেন রেহনুমা সুলতানা।
" ম্যাম বাইরের কন্ডিশন খুবই ক্রিটিক্যাল। এই অবস্থায়--"
কথা শেষ করতে পারে না রেজা। রেহনুমা ওর দিকে গরম চোখে তাকিয়ে থাকেন। হাল ছেড়ে দেয় রেজা। "আচ্ছা চলুন।"
রেজাকে নিয়ে আবারও বেডরুমে ঢোকেন রেহনুমা সুলতানা। ছোট্ট একটা দরজা খুলে গোপন একটা লিফটে ওঠেন। লিফটটা ওদের সোজা নিচতলায় নামিয়ে দেয়, বাড়ির পিছন দিকে। বুলেটের শব্দ শোনা যাচ্ছে ওখান থেকে। এলাকাটা একদম যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেছে। ওরা যেখানটায় আছে সেখানে অনেকদিন কারও পা পড়েনি বোঝাই যায় । একদম জঙ্গল হয়ে গেছে। ওখানে যেয়েই হতাশ হয়ে যায় রেজা। জায়গাটা প্রাচীরঘেরা , উপরে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া। রেজা টপকাতে পারলেও রেহনুমা সুলতানা পারবেন না । সমাধান দেন উনি নিজেই।
"তোমার কাছে গ্রেনেড আছে?" জানতে চান রেজার কাছে।
মাথা নাড়ায় রেজা। " লঞ্চ করো!" নির্দেশ দেন এই মূহুর্তে ময়দানের কমান্ডার রেহনুমা। আদেশ পালন করে রেজা। একদিকে সরে এসে দেয়াল বরাবর দুটো গ্রেনেড ছোঁড়ে । তাতে আহামরি ভাঙ্গন না ধরলেও , একজন মানুষ বেড়োনোর মতো জায়গা পাওয়া যায়। বেড়িয়ে আসে ওরা।
রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের আলো আছে। লোকেশন জানতে চাইলে বলব এই মুহূর্তে ওরা পুলিশের পিছনে । যুদ্ধক্ষেত্র ওদের সামনে। আলো আঁধারির সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটা আর্মার্ড লিমো পর্যন্ত ঠিকই এগিয়ে যেতে পারে ওরা। মাথা বাচিয়ে গাড়িতে ওঠে । বুলেটের বৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যেই কেউ ওদের গাড়ি বরাবর ফায়ার করতে শুরু করেছে। আর্মার্ড লিমোজিন বলে বেঁচে যায় রেজা আর রেহনুমা সুলতানা।
" শাহেদ আমি বর্ডারে যাচ্ছি । তোমার টিম নিয়ে পিছিয়ে আসো।" ওয়াকিটকিতে নির্দেশ দেয় শাহেদ।
ফাঁকা রাস্তায় সর্বোচ্চ স্পিড তোলে রেজা। পিছনে শাহেদর কমান্ডো টিমটা। ওদের পালাতে দেখে যা বোঝার বুঝে নেয় কনস্টেবল রাওয়াত। ফোন লাগায় সে। "স্যার বর্ডার বন্ধ করুন , রেহনুমা সুলতানা পালিয়ে যাচ্ছেন।" বর্ডারের যুদ্ধের খবর জানা নেই তার।
বর্ডার বেশি দূরে না , সময় লাগবে না বেশি। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে রেহনুমা সুলতানাকে বাকি প্ল্যান বুঝিয়ে দেয় রেজা। আয়নায় চোখ পড়তেই দেখে পুলিশের গাড়িগুলো শাহেদের আর্মার্ড লিমোটা তাড়া করতে করতে আসছে। বর্ডারে ফোন লাগায় রেজা ।
" জুলফিকার সব ঠিক আছে? আমি ম্যামকে নিয়ে আসছি।"
" এভরিথিং ইজ ওকে রেজা।" খোশ মেজাজে জবার দেয় মেজর জুলফিকার , পাকিস্তান রেঞ্জার্সের কমান্ডার। পাকিস্তানের সীমান্ত রক্ষীরা ভারতীয় বিএসএফকে ব্যস্ত রেখেছে যেন রেজা কাজটা সফলভাবে শেষ করতে পারে। ব্যস্ত রাখার দায়িত্ব পালন করছেন মেজর জুলফিকার। কন্ঠ শুনেই রেজা বুঝতে পারে ওপাশে সব ঠিক আছে।
ঘন্টাখানেক পর বর্ডারের কাছে যেতেই বিএসএফ এর জওয়ানরা ওর গাড়ি লক্ষ্য করে ফায়ার করতে শুরু করে। শাহেদকে স্মরণ করে রেজা।
"শাহেদ এগিয়ে গিয়ে ফায়ার করো।" তাই করে শাহেদ। ফলে দুদিক থেকে আক্রান্ত হয় বিএসএফ। সুযোগটা কাজে লাগায় রেজা। এখন ওর সামনে শুধুই কাঁটাতারের বেড়া আর কংক্রিটের পিলার। ঘন্টায় দেড়শ কিলোমিটার স্পিড তুলে বেড়া-পিলার ছিড়ে ছুড়ে ওপাশে মানে পাকিস্তানে প্রবেশ করতে সক্ষম হয় রেজার গাড়ি।
অলঙ্করণ: আল রোমান, (ঢাকা)।