গল্প: বিনাশ।
লেখা: জাবির ফেরদৌস রাফি, (রংপুর)।
১.
"স্যার প্রতিকণা কী? অ্যান্টিম্যাটার বা প্রতিপদার্থই বা কোন কিসিমের পদার্থ?" ফিচলেমার্কা পিত্তি জ্বালানো হাসি হেসে বলল রিফাত।
প্রশ্নটা শুনে বিরক্ত হলেন আসলাম মাস্টার। স্কুলটায় দশম শ্রেণীর ফিজিক্স ক্লাস নেন তিনি। ইদানিং রিফাত ছেলেটার পন্ডিতিমার্কা প্রশ্ন শুনে তার ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে যায় রাগে।
"প্রতিকণা হলো কণার বিপরীত রাশি। ভর একই কিন্তু চার্জ আলাদা। যেমন ইলেক্ট্রনের প্রতিকণা হলো পজিট্রণ। ওদের ভর সমান কিন্তু চার্জ আলাদা। ইলেক্ট্রনের চার্জ মাইনাস কিন্তু পজিট্রণের চার্জ প্লাস।
এরকম অনেক কণা ও তার প্রতিকণা রয়েছে। আর এইসব প্রতিকণা দিয়ে তৈরি পদার্থই হলো প্রতিপদার্থ বা অ্যান্টিম্যাটার।" বিরক্তি চেপে উত্তর দেন আসলাম মাস্টার। দশম শ্রেণীর একটা ছাত্রের মুখে এসব প্রশ্ন মানায় না ঠিক। খুব সম্ভবত তিনি যেন ঠিকঠাক ক্লাস নিতে না পারেন সেকারণেই হয়তো বড় কারো কাছে শিখে নিচ্ছে এসব প্রশ্ন।
"ওওওওহ" টেনে টেনে বলল রিফাত, প্রশ্ন করলো " আচ্ছা স্যার প্রতিকণা সৃষ্টি হলো কিভাবে?"
"শক্তি থেকে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতে শূন্যস্থান আসলে শূন্য নয়। সেখানে থাকে শক্তি। শক্তি থেকেই সৃষ্টি হয় কণা-প্রতিকণার জোড়া। কণা আর প্রতিকণা একসাথে মিলিত হলেই ধ্বংস হয়ে যায়। থাকে শুধু শক্তি। এভাবে কণা ও প্রতিকণা সৃষ্টি ও ধ্বংস হতে থাকে।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির পরপরই ওই প্রক্রিয়া শুরু হয়। সমান সংখ্যাক কণা প্রতিকণা সৃষ্টি ও ধ্বংস হতে থাকে।" কঠিন ব্যাখ্যা দিয়ে ছেলেটাকে দমাতে চাইলেন আসলাম। তাতে বোধয় ছেলেটা আরও উৎসাহ পেল!
"সমান সংখ্যক কণা প্রতিকণা সৃষ্টি ধ্বংস হতে থাকলে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হলো কী করে? কোনো কণাই তো থাকার কথা নয় স্যার!?"
তাজ্জব বনে গেলেন আসলাম মাস্টার! কণা থেকেই পদার্থ সৃষ্টি হয়, সেখান থেকে ভর , ভর থেকেই ধীরে ধীরে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে; এই কথা তিনি বলেননি। ছেলেটা সেটা বুঝে নিলো খুব দ্রুতই!
"প্রায় প্রতি তিন কোটি জোড়া কণা-প্রতিকণা সৃষ্টি ও ধ্বংস হওয়ার পর কী-করে-যেন একটা করে কণা বেঁচে যেতে থাকলো। এই কণাগুলো থেকেই পদার্থ তথা মহাবিশ্ব সৃষ্টি হলো। এই 'কী করে যেন' এর উত্তর পদার্থবিজ্ঞান এখনো জানে না।" বললেন আসলাম মাস্টার। ভাবলেন ছেলেটার প্রশ্ন বোধয় শেষ!
"বিজ্ঞান জানে না নাকি আপনি জানেন না" কথাগুলো বিড়বিড় করে বলল রিফাত যেন আসলাম সাহেব শুনতে না পান। তারপর ভালো মানুষের মতো মুখ করে বলল,
"প্রতিকণা গুলো কোথায় গেল সেটা কি জানে আপনার পদার্থবিজ্ঞান?"
"খুব জানে সেটা বলব না। কোনো কোনো বিজ্ঞানীর ধারনা এই প্রতিকণা গুলোই গঠন করেছে প্যারালাল ইউনিভার্স বা সমান্তরাল মহাবিশ্ব।" প্যারালাল ইউনিভার্সের ব্যাখ্যা দেয়ার সময় পেলেন না আসলাম। ক্লাসের বেল পড়ে গেল তার আগেই।
২.
ভুরু কুঁচকে সামনে তাকিয়ে থাকলো নিশিত। আমেরিকায় এসে ওর জমজ ভাইকে দেখতে পাবে সেটা ওর সবথেকে উদ্ভট কল্পনাতেও ও ভাবতে পারনি ! সত্যি বলতে ওর যে জমজ ভাই আছে, বেঁচে থাকতে ওর বাপ মা সে কথা ওকে বলেননি।
যাকগে, জমজ ভাইদের নাকি সবকিছুই একরকম হয়, প্রশ্ন করে তাই নিজের জমজ ভাইকে বাজিয়ে দেখতে চাইছে সে।
"তোমার মা বাবা বেঁচে আছেন?"
"হ্যাঁ। তোমার?"
"না নেই। আচ্ছা ঝাল খেতে তোমার ভাল্লাগে?"
"নাআআহ! জিব পুড়ে যায় একদম! তোমার?"
"হ্যাঁ আমার ভাল্লাগে। অংক করতে তোমার নিশ্চিয়ই ভাল্লাগে?"
"এহহহে একদমই না! তুমি?"
"ম্যাথ ভালো লাগে বলেই তো এমআইটিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছি! বাদ দাও, সাদা নাকি কালো রং প্রিয়?"
" কালো জগতের আলো। সাদা কোনো রং নাকি হে? তা তোমার আবার সাদা প্রিয় নাকি?"
" হ্যাঁ। আচ্ছা যাই বলো না কেন মেসিই কিন্তু এখনকার সেরা!"
"ধুর এখনকার সেরা হলো রোনালদো। আর সর্বকালের সেরা পেলে!"
"উহু! ম্যারাডোনা সেরা!"
বলেই থেমে গেল নিশিত। কিছুই মিলছে না ওর জমজ ভাইয়ের সাথে, অথচ ও জানে জমজ ভাইদের সবই একরকম হয়!
আর মাত্র একটাই প্রশ্ন করবে ও। না মিললে সোজা কেটে পড়বে এখান থেকে।
"তোমার সাহিত্য ভালো লাগে?"
" হ্যাঁ। কারণ সাহিত্যই একমাত্র সৃষ্টি যেটা মানুষকে পশুর থেকে আলাদা করেছে।"
" ঠিকই বলেছ তুমি , সাহিত্যই মানুষকে মানুষ বানিয়েছে।"
"মিলে গেছে!" উল্লসিত কন্ঠে বলল জমজ ভাইটা। " অন্তত একটা পয়েন্টে আমাদের মিল আছে। মেলাও হাত!"
অতঃপর প্যারালাল ইউনিভার্স থেকে আসা নিজের প্রতিরূপের সাথে হাত মেলাতেই ধ্বংস হয়ে গেল নিশিত, একইসাথে ওর প্রতিরূপও ধ্বংস হয়ে গেল!
