জেবা সামিহা তমা,(রংপুর):
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হওয়ার পরে আমাদের অনেকেরই একটা গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী থাকে, যাকে সাথে নিয়ে সারাটা দিন চলতে হয়। সঙ্গীটি হলো চশমা। মনে হতে পারে চশমা একজন মানুষের দূর্বলতা। কিন্তু মোটেও তা নয়।
দুই কানের উপর ভর করে নাকের সাহায্য নিয়ে থাকা যে বস্তুটি মানুষের চোখের সংবেদনশীল অংশকে রক্ষা করে তাকেই মূলত চশমা বলে। সাধারণ চশমার মধ্যে দুইটা স্বচ্ছ কাঁচ থাকে তবে রোদ চশমা ও সাঁতার চশমার কাঁচ ভিন্ন ধরণের হয় অর্থাৎ এই কাঁচগুলো রঙ্গিন ও অস্বচ্ছ হয়ে থাকে।
চশমা অনেক কারণেই ব্যবহার করতে হয়। দূরের জিনিস বা কাছের জিনিস দেখতে সমস্যা হলে, ক্রমশ চোখের দৃষ্টি কমে আসলে চশমা ব্যবহার করতে হয়। এবং এই দৃষ্টিশক্তির সমস্যার কারণেই অনেক সময় মাথাব্যথাসহ আরও বিভিন্ন সমস্যা হয়। দৈনন্দিনের ব্যবহারের জিনিস চশমা বোধবয় দূর্বলতা হতে পারে না। চশমা একটা অপরিহার্য বস্তু।
আচ্ছা আজকে আমরা যে চশমা দেখি এক হাজার বছর আগেও কি চশমা একই রকম ছিলো? ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে কিভাবে আসলো এই চশমা? চলুন জেনে আসি তার গল্প।
চশমার উৎপত্তি বা প্রচলন বহু পুরোনো তাই নির্দিষ্ট করে একজনের নাম বলা কঠিন যিনি প্রথম চশমার উদ্ভাবন করেছেন। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতার ছবিতে ফুটে উঠেছে হায়ারোগ্লোফিকসে মানুষ চশমা ব্যবহার করতো। তবে সেই চশমা আজকের সময়ের চশমার মতো নয়। বিভিন্ন জিনিসকে পরিষ্কার ভাবে দেখার জন্যে ভিন্ন ভিন্ন কাঁচ ব্যবহার করা হতো।
এরপর রোমান সভ্যতায় চশমার উদ্ভাবনের কিছুটা গল্প গাঁথা রয়েছে। রোমান সম্রাট নিরোর একজন শিক্ষক দূরের জিনিস পরিষ্কারভাবে দেখায় জন্যে জলমিশ্রিত একটি কাঁচ ব্যবহার করার কথা বলেছিলেন। রোমান গ্লাডিয়েটরসদের লড়াই উপভোগ করার সময় সম্রাট নিরো নিজ আসনে বসে বিশেষ কাঁচ চোখে ব্যবহার করতেন।
১২৮৬ সালে জিওর্দানো দা পিসা নামে একজন ইতালীয় ব্যক্তি একধরণের চশমা আবিষ্কার করেন। আদিম একধরণের লেন্স কাঠ বা চামড়ার ফ্রেমে বসানো হতো। অবশ্য বিশেষ ক্ষেত্রে পশুর শিঙ দিয়ে এই চশমাগুলোর ফ্রেম বানানো হতো। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি সেইসময় সন্নাসীদের কাছে এটা বেশি জনপ্রিয় ছিলো এবং ইতিহাস বলে তারাই নাকি প্রযুক্তির ব্যবহার করে সেসময় এই উদ্ভাবনের নবজাগরণ ঘটিয়েছেন। তবে এই চশমাটি হাত দিয়ে মুখের সামনে বা চোখের সামনে ধরা লাগতো। মূলত ছোট জিনিসকে বড় করে দেখার জন্যে এই চশমা ব্যবহার করা হতো, এক কথায় বলা যেতে পারে ম্যাগনিফাই গ্লাস। এটার জনপ্রিয়তা আরও একটা প্রমাণ অটোমান সাম্রাজ্যের রাণী তার প্রয়োজনে এই ধরণের চশমা ব্যবহার করতেন।
১৭২৭ সালে গিরোলামো সাভোনারোলা নামের একজন ইতালীয় বর্তমান সময়ের চশমার নকশা তৈরি করেন। একারণেই তাকে আধুনিক চশমার জনক বলা হয়।
প্রয়োজনেই বা কৌতূহলে ইতালির এই অসাধারণ উদ্ভাবন খুব দ্রুতই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় অন্যান্য বিজ্ঞানীদের গবেষণায়।
গিরোলামো সাভোনারোলার তৈরি চশমার নকশার রূপ পাল্টেছে অনেকবার এবং তাদের মধ্যে জনপ্রিয় এক চশমা "মার্টিনের মার্জিন"। এটা তৈরি করেছেন বেঞ্জামিন মার্টিন।
এরপর বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের আবিষ্কার মানুষকে অবাক করে। একই কাঁচ দিয়ে কাছে ও দূরের জিনিস ভালোভাবে দেখা সম্ভব করে তুলেন।
সেইসময় আরও এক ধরণের চশমা প্রচলিত ছিলো। যার নাম ছিলো "scissor spectacles" এই চশমাটি জামার পকেটে সংরক্ষিত করা যেতো। সবসময় চশমা পড়ে থাকার সমস্যা থেকে এটা মানুষকে মুক্তি দিয়েছিলা।
১৯ শতকেও চশমা ছিলো বিলাসিতার বস্তু, সকলের কাছে সহজলভ্য ছিলো না চশমা। কিন্তু শিল্প বিপ্লবে এতো পরিমাণে লেন্স ও ফ্রেম তৈরি হয়েছে যে খেটে খাওয়া মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় বস্তু হিসেবে চশমা তাদের সাধ্যের মধ্যে হয়ে উঠলো।
তবে সাধারণ চশমার দামও বেশি হয়ে ওঠে ব্যক্তি বিশেষের ব্যবহারে। যেমন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ব্যবহৃত চশমা বিক্রি হয়েছে ২৫০ কোটি টাকার ও বেশি দামে।
প্রযুক্তির বিশ্বে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে চশমার এমন এক হালনাগাদ রূপের আলোচনা হচ্ছে যে শুনলে যে কেউ চমকে যাবে। গুগলের গোপন ল্যাব "গুগল এক্স" যেখানে বিশ্বের উচ্চাভিলাষী সব আবিষ্কার নিয়ে কাজ করা হয় তাদের ওয়েবসাইটে দেয়া এক ভিডিওর মাধ্যমে জানা যায় আসছে এক আশ্চর্য চশমা।
সেই চশমাটি পড়লে ড্রিল মেশিন দিয়ে ফুটো করার আগে জানতে পারবেন দেয়ালের ভিতরে কোন যায়গায় তার রয়েছে কিংবা আপনার পছন্দের বইটি লাইব্রেরীর কোন তাকে রয়েছে। চমক এখানেই শেষ নয়। দিনের শুরুতে তাপমাত্রা বলে দেয়া, মুখ দিয়ে কথা বলায় চশমার মাধ্যমে মেসেজ যাওয়া, পাতাল ট্রেন আজ বন্ধ তাই অন্য পথ বলে দেয়া এমনকি সিনেমার টিকিট কাটা, বান্ধবিকে ভিডিও কল দিয়ে সূর্যাস্ত দেখানো সবই সম্ভব এই দারুণ চশমা দিয়ে। গুগলের এই ভবিষ্যৎ চশমা নিয়ে অনেক নেতিবাচক ধারণা সামনে এলেও গুগলের এক কর্মকর্তা বলছেন আগামী ১০ বছর পর এই চশমা বাজারে আসতে পারে।
মানব সভ্যতার প্রয়োজনে উদ্ভাবিত চশমা আজকে মানুষের চিন্তাধারার সীমার বাহিরে পৌঁছে গেছে। প্রযুক্তির হাত ধরে আরও আধুনিক হয়ে উঠুক আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্র এবং এর সদ্ব ব্যবহারে মানব সভ্যতা আরও উন্নত হোক।