জেবা সামিহা তমা, (রংপুর):
পুতুল। ছোটবেলার খেলার বস্তু। সংজ্ঞা বলতে হলে পুতুল হলো একটি বস্তু, যা মানুষ, পশুপাখি, বা পৌরাণিক চরিত্রের সাথে মিল রেখে তৈরি করা হয়। কখনো কখনো শিল্পীর নিজস্ব ব্যতিক্রম সৃষ্টিও ফুটে ওঠে পুতুলের মাধ্যমে। এই পুতুলকে যখন মানুষ বিভিন্নভাবে পরিচালিত করে, প্রদর্শন করে তখন তাকে বলা হয় পুতুলের খেলা। ইংরেজি শব্দে যা পরিচিত পাপেট শো(Puppet show). ইংরেজি শব্দ Doll অর্থও পুতুল হলেও অভিধানে পুতুলের ইংরেজি সমার্থক শব্দ হিসেবে পাপেট ও স্থান পেয়েছে। পুতুল নাঁচ বা পুতুলের খেলা অথবা পাপেট শো গুলোতে পুতুলের বিভিন্ন অংশে রড, তার বা সুতা দিয়ে পরিচালনা করা হয় এবং মঞ্চের পিছন থেকে মানুষ কখনো পুতুলের কন্ঠ দেয় আবার কখনো বা গান-বাজনা করে।
পাপেট শো এর ইতিহাস অনেক পুরাতন। প্রাচীন গ্রীসে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী থেকে এর প্রচলন শুরু হয় এবং এর প্রমাণ পাওয়া যায় হেরোডোটাস ও জেনোফোনের রচনাবলি থেকে। ৩৮৪ খ্রিস্টপূর্বে জন্ম নেয়া অ্যারিস্টটলের কবিতায়ও পুতুলের কথা পাওয়া যায়। ভারতেও পুতুলের প্রচলন ছিলো প্রাচীনকাল থেকেই। ভারতের সিন্ধু উপত্যকার বেশ কিছু যায়গার মাটি খনন করে পুতুলের সন্ধান পাওয়া যায়।
গ্রীক শব্দ নেভ্রোস্পাস্টোস এর থেকে পুতুল বা পাপেট শব্দটি এসেছে। নেভ্রোস্পাস্টোস এর আক্ষরিক অর্থ হলো 'স্ট্রিং দ্বারা আঁকানো বা স্ট্রিং দ্বারা টানা'।
এখন পর্যন্ত প্রায় ২৪ ধরণের পাপেটের খোঁজ রাখা সম্ভব হয়েছে। এগুলো হলো - ব্লাক লাইট পাপেট, বুনরাকু পাপেট, ক্যানটাসটোরিয়া, কার্নিভাল অথবা বডি পাপেট(সেসামি স্ট্রিট ও সিসিমপুরে আমরা যে পাপেট দেখতে পাই তা এই প্রকারভেদের অন্তভূর্ক্ত), ফিঙ্গার পাপেট, হ্যান্ড অথবা গ্লোভ পাপেট, হিউমান আর্ম পাপেট, লাইট সারটেন পাপেট, ম্যারিওনেটস, ম্যারোট, মোটেকার, অবজেক্ট পাপেট, পুল স্ট্রিং পাপেট, পুশ স্ট্রিং পাপেট, রড পাপেট, শ্যাডো পাপেট, সক পাপেট, সুপারম্যারিওনেশন, টেবিল টপ পাপেট, টিকেল বাগ, টয় থিয়েটার, ভেনট্রিলোকুইজম ড্যামি, ওয়াটার পাপেট, রাজস্থানি পাপেট।
বাংলাদেশে পাপেট শো এর কথা বলতেই যেই নামগুলো আগে আসে তার একটি হলো "মনের কথা" এবং এর কারিগর মুস্তফা মনোয়ার। বিটিভিতে দেখা যেতো পারুল, বাউল, ষাঁড় ও ডাক্তারদের মজাদার সব ঘটনা ও কথোপকথন। আর তাদের সাথে থাকতো আমাদের প্রিয় শিল্পী ও জীবন্ত কিংবদন্তী মুস্তফা মনোয়ার। মুস্তফা মনোয়ারের সৃষ্টিতেই ফুটে উঠে তিনি কতটা প্রকৃতি প্রেমী। বাংলার সব সৌন্দর্য ফুটে উঠে উঠেছে "মনের কথা" এর পারুল চরিত্রে এবং বাউল চরিত্র যেনো বাংলার ঐতিহ্যকে প্রতিনিধিত্ব করে। মূলত মুস্তফা মনোয়ার চেয়েছিলেন বাংলার আবহমান সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে এবং তিনি সফল ও হয়েছেন এতে। ১৯৬০-৬১ খ্রিস্টাব্দে কলিম শরাফী তার ডকুমেন্টারিতে মুস্তফা মনোয়ারের পাপেট অন্তভূর্ক্ত করেন। টেলিভিশনে "আজব দেশে" নামের অনুষ্ঠানে 'বাঘা ও মেনি' নামের পাপেট দেখানো হতো।
প্রতি বৃহস্পতি ও শুক্রবার অধীর আগ্রহে টেলিভিশনের সামনে অপেক্ষা করতাম আর যখন শুনতে পেতাম - "এসো পাশে বসো, ভেসে ভেসে মজার দেশে ছুটে যাবো" তখন সব অপেক্ষা আনন্দে রূপ নিতো। হ্যাঁ, আমি সিসিমপুরের কথাই বলছি। সিসিমপুর হলো 'সেসামি স্ট্রিট' এর বাংলাদেশি সংস্করণ। 'সেসামি স্ট্রিট' এর অনেক সংস্করণ রয়েছে। যেমন - বাংলাদেশে সিসিমপুর, কসোভার রুগা সিসাম ও উলিকা সেজাম, দক্ষিন আফ্রিকার তাকালানি সিসামি। 'সেসামি স্ট্রিট' এর বেশ কিছু সংস্করণ নিয়ে ২০০৬ সালের ২১শে মে লিন্ডা হকিন্স কিস্টাগান, লিন্ডা গোল্ডস্টেইন-নোল্টনের পরিচালনায় ও এরিক মার্টিন, চার্লি পিয়ারসনের রচনায় "দ্যা ওয়ার্ল্ড এক্রোডিং টু সিসামি স্ট্রিট" ছবিটি মুক্তি পায়। 'সিসামি স্ট্রিট' যুক্তরাষ্ট্রের শিশুদের জন্যে তৈরি করা হলেও এর প্রয়োজনীয়তা, উপকারিতা ও সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এটি বিশ্বের অনেক দেশেই ছড়িয়ে যায়। ইউএসএইড এর আথিক সহযোগিতায় ২০০৪ সালের পহেলা বৈশাখ সিসিমপুরের যাত্রা শুরু হয়। মূলত বাচ্চাদের শিক্ষাকে আনন্দদায়ক ও উপভোগ্য করতেই 'চলছে গাড়ি সিসিমপুরে '। প্রথমবারেই মোট ২৬ টি পর্ব অনুষ্ঠিত হলেও এরপরে জনপ্রিয়তার কারণে ৭০০ এর অধিক পর্ব প্রচারিত করা হয়েছে। সিসিমপুরের হালুম, ইকরি, শিকু, টুকটুকি, মানিক-রতন,গুনি ময়রা, আশা ও মুকুল প্রত্যেকটিই চরিত্র যেনো আমাদের ছোটবেলার এক একটি সুন্দর স্মৃতি।
কখনো এই পুতুলগুলো মানুষকে জীবনের গল্প শোনায় কখনো বা তাদের হাসায় আবার মাঝেমধ্যে পুতুলের গল্পে শোনা যায় প্রতিবাদ। তবে মূল কথা হলো এটা মানুষকে আনন্দ দেয়। এই পুতুল নাঁচ বা পাপেট শো এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক ঐতিহ্য ও ইতিহাস। বেঁচে থাকুক শিল্পী ও তার সৃষ্টি।