- জেবা সামিহা তমা,(রংপুর)
আমাদের ছোট বেলার বিনোদনের সময় বা অবসর সময় কাটানোর বিষয় ছিলো কার্টুন দেখা বা অ্যানিমিনেশন দেখা। কার্টুন ইংরেজি শব্দ (Cartoon) এর বাংলা অর্থ ব্যঙ্গচিত্র। কার্টুন হলো দ্বিমাত্রিক চিত্রকলা যা সাধারণত কাগজে এঁকে করে প্রকাশ করা হয়। প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে একাধিক কার্টুন ইলাস্ট্রেটরের মাধ্যমে একত্রিত করে তৈরি করা হয় অ্যানিমিনেশন।
এবার যাওয়া যাক তাদের গল্পে যারা আমাদের ছোটবেলা এতটা আনন্দের করেছে। বাংলাদেশের কিংবা বলতে পারি দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ কিশোরীর গল্প ফুটে উঠে যেই অ্যানিমিশন চরিত্রে তার নাম হলো মীনা। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে সার্কের অন্তভূর্ক্ত দক্ষিণ এশিয়ার ৭ টি দেশেই তখন মেয়েরা সামাজিক অবকাঠামোর দিক দিয়ে সবকিছুতেই পিছিয়ে ছিলো। সার্ক এ বিষয়টি নিয়ে ইউনিসেফের কাছে সাহায্য চাইতেই ইউনিসেফ দায়িত্ব নেয়। দীর্ঘদিনের গবেষণা ও মাঠ পর্যায়ে কাজের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য থেকে ইউনিসেফের তত্ত্বাবধায়নে রাম মোহন, মোস্তফা মনোয়ার, শিশির ভট্টাচার্য সহ বাংলাদেশের শীর্ষে থাকা বেশকয়েকজন শিল্পী মিলে "মীনা কার্টুন" এর চরিত্রগুলো তৈরি করেন। ৭টি দেশের প্রতিনিধির সাথে আলোচনা করে মীনা কার্টুন এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে এটি শুধুমাত্র একটি দেশকে প্রতিনিধিত্ব না করে। তাই মীনা কার্টুনের প্রত্যেকটি চরিত্রের পোশাক ও নাম দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে তৈরি করা হয়। বাংলা ভাষার ব্যতিরেকেও ইংরেজি, উর্দু, নেপালি, হিন্দি, পোশত ও পর্তুগীজ ভাষায় ও রয়েছে জনপ্রিয় এই ধারাবাহিক টিভি কার্টুন ও কমিক বই। ভারতের রাম মোহনের আঁকা ৯ বছর বয়সী এই মীনা চরিত্রটি এতটাই সফলতা পেয়েছে যে এক গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে বাংলাদেশের ৯৫% মানুষ মীনা কার্টুনের সাথে পরিচিত। বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পরিচিত সমস্যাগুলোর সমাধান এবং সমাজের কল্যাণমূলক কাজই মীনা কার্টুনের মূল বিষয়। যেমন - নারীশিক্ষার সুফল, ছেলে ও মেয়ের সমস্বাস্থ্য সচেতন, স্বাথ্যসম্মত পায়খানা, বাল্য বিবাহ রোধ, যৌতুক প্রথা বন্ধ। মীনা কার্টুনের প্রকাশক ও নির্মাতা ইউনিসেফ হলেও টুন বাংলা, হান্না-বারবারা কার্টুনস ও এর নির্মাণ সহযোগিতায় ছিলো এরপর পরবর্তীতে বেশ কিছু পর্ব ভারতে রাম মোহন স্টুডিওতে তৈরি করা হয়। যুগান্তরেও যেসব মেয়েরা পিছিয়ে আছে তাদের প্রদর্শক হয়ে উঠুক মীনা, এটাই কাম্য।
জাপানের নোবিতা নোবি নামে এক বালক স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত ছিলো। নোবিতার রোগটি হলো সে তার কল্পনার জগতের সবকিছু বাস্তব ভাবতে শুরু করে। নোবিতা কল্পনা করতো ডোরেমনকে। নোবিতা ভাবতে শুরু করে ডোরেমন তাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করছে, সে আর ডোরেমন মিলে বাঁধাহীনভাবে পুরো দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। নোবিতার এই রোগের কারণে যখন তাকে সবার সামনে হাসির পাত্র হতে হলো তখন সে নিজেকে ঘরে বন্দী করে নিলো। উপায় না পেয়ে নোবিতা নোবির বাবা-মা তাকে নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন। চিকিৎসক তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে ডোরেমন তার কল্পনা মাত্র। চিকিৎসকের কথা বুঝার পরে নোবিতা বাড়ি ফিরে প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতা অনুভব করে। ডোরেমন, যাকে সে সবচেয়ে কাছের বন্ধু বলে মনে করতো তাকে ছাড়া নোবিতা নিজের জীবন ভাবতেই পারছিলো তাই সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। জাপানি কার্টুনিস্ট হিরোশি ফুজিমাতো ও মোতো আবিকো ১৯৫৪ সালে জুটিবদ্ধ হয়ে জুটির নাম দেন ফুজিকো ফুজিয়ো। নোবিতা নোবির ঘটনাটি জানার পর ফুজিকো ফুজিয়ো সেটাকে কার্টুন ও জাপানি কমিক (মাঙ্গা) কার্টুনে রূপ দেয়া শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে প্রথম জাপানের ৬ টি ম্যাগাজিনে ডোরেমন প্রকাশিত হয়। বাস্তব ঘটনা অনুসারে ডোরেমন শেষ করতে চাইলেও ভক্তদের ভালোবাসার কাছে হেরে গিয়ে চলমান রাখতে ডোরেমনের গল্প। হয়তো ডোরেমন ও নোবিতার গল্প ভালো লাগার চাহিদার শীর্ষে থেকেই যাবে।
অপরজনের সাথে ঝগড়া, তার পিছনে লাগা আবার সে যখন এসবে বিরক্ত চলে যায় তখন আবার তার জন্যে মন খারাপ হওয়া এরপর তাকে ফিরিয়ে আসা ; এই বাক্যগুলো বন্ধুত্বেরই বৈশিষ্ট্য। আর এই সব কিছুই আমরা দেখতে পাই টম আর জেরির মধ্যে। আপাতত দৃষ্টিতে টম আর জেরিকে শত্রু মনে হলে হলিউডের এই বিখ্যাত কার্টুন অনেক পর্ব আমাদের বন্ধুত্বের সূত্র শেখায়। অতীতে মেট্রো গোল্ডইউন মেয়ার স্টুডিওতে হলেও বর্তমানে হ্যানা বার্বেরা স্টুডিওতে উইলিয়াম হানা ও জোসেফ বারবেরার রচনায় ও প্রকশনায় তৈরি হয় জনপ্রিয় ইংরেজি কার্টুন। ১৯৩০ সালে উইলিয়াম হানা ও জোসেফ বারবেরা 'পাস গেটস দ্যা বুট' নামে কার্টুন পরিচালনা করেন এবং সেগুলো থিয়েটারে দেখানো শুরু। একসময় থিয়েটারের কর্মীরাও মজা করে বলতে শুরু করেন 'বিড়াল আর ইঁদুরের খেলা কি কম হলো?' বিড়াল-ইঁদুরের সম্পর্কের মানুষের নেতিবাচক চিন্তাধারা যখন বদলানো শুরু করলো তখন এমজিএম ও থিয়েটার কর্তৃপক্ষ বেশ খুশি হলো এবং শুরু করলো নতুন কার্টুন টম এন্ড জেরি। ১৯৪০ সাল থেকে টম এন্ড জেরি ঝগড়া যেমন হাসিয়েছে তেমনি তাদের বন্ধুত্বও মন জয় করে নিয়েছে বিশ্বের প্রায় শিশু-কিশোরদের। টম এন্ড জেরি হয়তো এভাবেই শতাব্দীর পর শতাব্দী আমাদের মন জয় করে যাবে।
সেই কাঠবিড়ালিকে মনে আছে আপনাদের? ১৯৫৭ সালে টিভির প্রথম ব্রডকাস্ট কার্টুন? মনে পড়ছে না? আচ্ছা তাহলে শিরোনামটা বলি "The Woody Woodpecker Show" নিশ্চয়ই এবার মনে পড়েছে। উডি উডপেকার হলো একটি নরত্বারোপমূলক কার্টুন।
উডি উডিপেকার কার্টুনের প্রযোজক ওয়াল্টার লানটজ তার স্ত্রী গ্রেসিকে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় ঘুরতে গিয়েছিলেন। বৃষ্টির রাতে হঠাৎ শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলে তারা দেখে একটি কাঠঠোকরা পাখি এসে তাদের কেবিনে একটি গর্ত করছিলো। ওয়াল্টার পাখিটিকে গুলি করতে চাইলে গ্রিস তাকে বাধা দেয় এবং বলে এটাকে নিয়ে একটি কার্টুন তৈরি করতে। ওয়াল্টার এটাকে অনেক গবেষণা করে এবং বেন হার্ডওয়ের সাথে মিলে তৈরি করে উডি উডপেকার।
এরপর বেশ কিছু গুনী কণ্ঠশিল্পী ও ডিজাইনের কঠোর পরিশ্রমে তৈরি হয় উডি উডপেকার। ভাইঝি স্পলান্টার ও ভাইপো নথেডকে নিয়ে উডির পরিবার ও তার মজাদার গল্প যা আমাদের টিভির দিকে মুগ্ধ হয়ে থাকতে বাধ্য করেছিলো। আমাদের ছোটবেলার আরও একটি প্রিয় স্মৃতি উডি উডপেকার।
মীনা কার্টুন, ডোরেমন, উডি উডপেকার ও টম এন্ড জেরির মতো অসংখ্য কার্টুন যুগের পর যুগ আমাদের মন জয় করে আসছে। এই সবগুলো কার্টুন সৃষ্টির পিছনে রয়েছে অজানা সব অসাধারণ গল্প। যে গল্পগুলো বর্তমানে ইতিহাস হয়ে আমাদের মাঝে রয়ে গেছে।