সানজিদা আক্তার,(রংপুর):
ফাহমিদ, ক্লাস টু এ পড়ে। ভালোবাসে কার্টুন দেখতে আর পছন্দের কার্টুন এর অংশ অভিনয় করতে। শুধু তাই নয়, ছড়া আবৃত্তিতেও বেশ পটু। কি সুন্দর সাবলীল উচ্চারণ! সবই ভালো চলছিলো। কিন্তু সমস্যা শুরু হয়েছিলো করোনা প্রাদুর্ভাব এ প্রতিষ্ঠান, পড়াশুনার আগ্রহ, বাহিরে যাওয়া, বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা, পার্কে ঘুরতে যাওয়া অর্থাৎ পুরো দেশ আটকে যাওয়ায়। পৃথিবী বন্দী হলো ঘরের ভেতর টিভি আর মোবাইল ফোনের মাঝে।
একদিন খবর দেখছিলাম,ফাহমিদ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, "আচ্ছা মা, এই জীবানুটা সবাইকে মেরে ফেলবে, তাই না?"
চমকে উঠলাম। খেয়াল করলাম আসলে গত কয়েক মাসে ফাহমিদ অনেক নেতিবাচক খবর দেখেছে। প্রায় প্রতিদিনই সবার আগে আমি ফাহমিদেরই মুখে করোনা আপডেট শুনতাম। সে খেলাধুলা এমনকি খাবার খাওয়াও ছেড়ে দিচ্ছিলো। সারাদিন মনমরা হয়ে পড়ে থাকতো। তাহলে কী ও ধরেই নিয়েছে যে আমরা সবাই এভাবেই মারা যাবো? তার মনোভাব বদলাতেই আমি কিছু নতুন পদক্ষেপ নিলাম।
(পদক্ষেপ ১)
ফাহমিদের রুটিন করা জীবনঃ আগে যেমন ফাহমিদের স্কুল যাওয়া, পড়া করা, খাবার গোসল সবকিছুর একটা রুটিন ছিলো সেই অনুরূপ রুটিন করে ফেললাম। শুধুমাত্র স্কুলের সময় টুকু তাকে অন্যান্য খেলাধুলার সময় দিলাম। যেন সে তার নিজস্ব কাজেই ব্যস্ত থাকে।
(পদক্ষেপ ২)
মতামত শোনা ও গুরুত্বঃ এটি খুব কঠিন কাজ। কারণ ফাহমিদের বয়স মাত্র ৯। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে নিজেই জানে না কি চাইছে! মতামত চাইলেও দোটানায় পড়ে যায়। এক্ষেত্রে আমি তার প্রতিটি কথায় মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম। কখনো উদাসীন কিংবা মনমরা দেখলে তাকে যথাসাধ্য সময় নিয়ে বুঝানো শুরু করলাম।
(পদক্ষেপ ৩)
অনলাইন ক্লাসে সহায়তাঃ ফাহমিদ মাত্র ক্লাস টু এ। তবুও যখন তার শিক্ষক অনলাইন ক্লাসের কথা বলেছেন তখন আমি প্রতিটি ক্লাস খেয়াল করেছি এবং ফাহমিদের যেন কোনো কষ্ট না হয়, কিছু না বুঝলে কিংবা এড়িয়ে গেলে সেগুলো বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আর অনলাইনে ক্লাসে কি কি করা সে নিয়ে শিক্ষকদের সাথে কথা বলেছি।
(পদক্ষেপ ৪)
ফাহমিদের ভালো কাজগুলোকে পুরষ্কৃত করাঃ
বাচ্চাদের মাঝে পুরষ্কারের আশায় ভালো কাজ করার কিংবা কোনো দুষ্টুমি না করার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। তাই আমি তাকে প্রতিদিনই কিছু না কিছুর জন্য পুরষ্কার দিয়েছি৷ বাহিরের খাবার গুলো বাসায়ই তৈরী করেছি।
(পদক্ষেপ ৫)
পরিচ্ছন্নতা নিয়মিতঃ ফাহমিদের পরিচ্ছন্নতার তৈরী করার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আমার পরিবারের। নিয়ম করে গোসল, খেলাধুলার পর পরিষ্কার হওয়া, নিজের আশপাশ গুছিয়ে রাখা এই সব কিছু সম্ভব হয়েছে৷ অবশ্য এতে পদক্ষেপ ৪ অর্থাৎ ভালো কাজে পুরষ্কার দেয়ার উপায়টি বেশ কাজে এসেছে।
(পদক্ষেপ ৬)
গঠনমূলক কাজ শেখানো ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে সাহায্যঃ ফাহমিদ আগে অভিনয় কিংবা আবৃত্তি করতো। তার সেই চর্চাটি ফিরিয়ে আনতে আমিও তার সাথে চর্চা শুরু করলাম। এমনকি মোবাইল ফোনে কার্টুন দেখানোর বদলে তাকে শিশুদের উপযোগী হাতে তৈরী জিনিস বানানোর ভিডিও দেখতে দিলাম। প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো এনে দিতেই সে নিজের মত করে বিভিন্ন জিনিস বানানো শুরু করলো। এমনকি সে তার পুরনো খেলনাগুলোও নতুন করে ফেললো।
(পদক্ষেপ ৭, গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ)
টিভিতে কিংবা পরিবারে সংবাদ শোনার ক্ষেত্রে পরিবর্তনঃ আমি ফাহমিদ কে লক্ষ্য করা শুরু করেছিলাম মূলত তার খবর দেখার ও মনে রাখার এবং সেটি নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করার ব্যাপারটি থেকে। তাই এটিকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বললাম। কারণ সবার সাথে বসে সংবাদ দেখা, মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনা, অন্যান্য সামাজিক সমস্যা এগুলো শুনতে শুনতেই ফাহমিদ মূলত নিজেকে ভয়ে গুটিয়ে নিচ্ছিলো। উপরের অন্যান্য পদক্ষেপ গুলো নিয়ে আমি ফাহমিদ কে সম্পূর্ণ ব্যস্ত করে ফেললাম। যাতে ফাহমিদ সংবাদ দেখতে পেলোনা এবং পরিবারকে তার সামনে ভালো অনুষ্ঠান ও সংবাদ দেখার কথা বললাম।
শুধু ফাহমিদ নয়, দেশে পড়াশুনা করা অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এ রকম নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। অনলাইন ক্লাস হচ্ছে বলেই ভবিষ্যৎ ঠিক হয়ে যাবে ধরে নেয়া যায় না। শিশুর বিকাশে এগিয়ে আসতে হবে পরিবারকেই। কারণ আজ একটি ফাহমিদ সামান্য যত্নের কারণেই এই সময়টি তে অনেক সাবলীলভাবে জীবন যাপন করতে পারছে।