গল্প: টাইম ট্রাভেল।
লেখা: জাবির ফেরদৌস রাফি।
অধৈর্য ভঙ্গিতে একপা থেকে আরেক পায়ের উপর দেহের ভর চাপালো লোকটা। লোক না বলে ছেলে বলাই ভালো। কতই বা বয়স হবে! এই ছাব্বিশ সাতাশ। তবে বয়স নিয়ে আপনার খুঁতখুঁতে স্বভাব থাকলে যুবক বলতে পারেন, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। সে যাক-গে।
এক পা থেকে আরেক পায়ে ভর চাপানোর কারণ ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। বাম হাতে একটা ফাইল । স্বচ্ছ। তাতে ভিতরের জিনিসপত্র দেখা যাচ্ছে। ডান হাতে ঢাউস সাইজের একটা স্মার্টফোন। অন্তত প্রথম দেখায় তাইই মনে হবে! যাই হোক।
ছেলেটার বিরক্তির কারণ তার সামনে বসা কেমব্রিজের ফিজিক্সের প্রফেসর আইজ্যাক ব্যারো , যিনি আবার এফটিএল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান , আধঘন্টা থেকে কেবল ফেসবুক ঘুতিয়েই যাচ্ছেন। অনিকের দিকে নজর নেই ওনার। তাতেই অনিক নামের বাঙালির ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। বাঙালির আবার ধৈর্য কম। একবার গলা খাঁকারি দেয় ছেলেটা । তাতে কাজও হয়। আইজ্যাক ব্যারো কথা বলে ওঠেন।
" তো তুমি দাবি করছো যে তুমি একটা টাইম মেশিন বানিয়ে ফেলেছো?" স্মার্টফোনে চোখ রেখেই বলেন ব্যারো
"জি স্যার।" বেশ খুশি হয় অনিক।
"তো কত সামনে যাওয়া যায় তোমার মেশিন দিয়ে?" এখনো স্মার্টফোনেই চোখ ব্যারোর।
" পিছনে যাওয়া যায়।" অনিক জবাব দেয়
" কী বললে? কী? পিছনে যাওয়া যায়!?" অবশেষে স্মার্টফোন থেকে চোখ তুললেন ব্যারো।
"জি স্যার।" অনিকের কন্ঠ আস্তে আস্তে দৃঢ় হতে থাকে।
"স্বয়ং স্টিফেন হকিং অতীতে ভ্রমণ নাকচ করে দিয়েছেন সেখানে তুমি---
"তিনি এটাও বলেছেন যে শক্তির ঘনত্ব ধনাত্বক হলে অতীত ভ্রমণ সম্ভব নয়।"
"মানে?" ব্যারো সাংঘাতিক উত্তেজিত হয়ে গেছেন।
" মানে স্থান কালকে ঋনাত্বক দিকে বাঁকানো গেলে অতীত ভ্রমণ সম্ভব। আর কোয়ান্টাম মেকানিকসও এটা সমর্থন করে।" কঠিন গলায় জবাব দেয় অনিক।
"তো তুমি দাবি করছো যে তুমি ঋনাত্বক ভর আবিষ্কার করে ফেলেছো?" ব্যারো বলেন।
"অনেকটা ওরকমই।" অনিক দায়সারা জবাব দেয়।
"কীভাবে?" ব্যারো প্রশ্ন করেন
"আপনাকে নিশ্চিয়ই ক্যাসিমির ইফেক্ট বোঝাতে হবে না প্রফেসর ব্যারো!" অনিক আগ্রাসী হয়ে উঠছে।
অপমানটা নিরবে হজম করে সাথে সাথেই কথা বলেন ব্যারো ,
" তো কত পিছনে যাওয়া যায় তোমার যন্ত্র দিয়ে?"
"দশ বছর।"
"দশ! মাত্র দশ বছর! অন্তত একশ বছর না হলে তোমাকে টাকা দেয়া সম্ভব নয় অনিক।" অনিকের সামনে প্রায় অবাস্তব একটা শর্ত দাড়া করান প্রফেসর ব্যারো,অনিককে দমানোর জন্য।
"সে সমাধান আছে।" অনিকের মুখে কোয়ান্টাম বাল্বের হাসি।
" আছে ! আছে সমাধান! কী সেটা?"
"হাইপার স্পেস।" অনিক ভয়ে ভয়ে জবাব দেয়।
" কী-ক কী ! কী বললে!? হাইপা--হিহ হিহ হিহ হি হি-- হাইপার স্পেস!!!" প্রফেসর ব্যারো হাসতে থাকেন।
" আমি হাইপার ড্রাইভ ইঞ্জিনের নকশা করে ফেলেছি।"
" হাইপার হিহ হিহ হিহ হি হি-- হাইপার ড্রাইভ । তো সেটা দিয়ে কী করবে! বড়জোর দু সেকেন্ডে চাঁদে পৌছাতে পারবে! আর কী! অতীত ভ্রমণ করতে এটলিস্ট আলোর গতি অতিক্রম করতে হবে। সেটা তো পারবে না। হিহ হিহ হিহ হিহ হি হি হাইপার ড্রাইভ....." ব্যারোর হাসি থামছেই না।
" হাইপার স্পেস ড্রাইভের সর্বোচ্চ গতির সীমা আলোর গতি নয় মিস্টার ব্যারো। অনেক বেশি। অনেক অনেক বেশি।" অনিকের ইস্পাত কঠিন জবাব।
অনিকের কথার দমকে চুপ মেরে যান প্রফেসর আইজ্যাক ব্যারো। তারপর আবারও হাসতে থাকেন। হাসতেই থাকেন। হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়েন, চশমা ছিটকে পড়ে। বিষম টিষম খেয়ে একাকার অবস্থা। ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে অনিক পানি এগিয়ে দেয়। পানি খেয়ে শান্ত হন প্রফেসর ব্যারো। সিরিয়াস ভঙ্গিতে পিঠ সোজা করে বসেন চেয়ারে। তারপর বলেন,
" জেনারেল রিলেটিভিটি আলোর থেকে বেশি গতিতে ভ্রমণ অনুমোদন করে না। জানো তো!?"
" আইনস্টাইন ভুল ছিলেন।" চশমা ঠিক করতে করতে বলে অনিক।
"কীহ!?" প্রফেসর ব্যারো চেয়ার থেকে পড়ে যেতে ধরেছিলেন। নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড মারলেও এতটা শক পেতেন না , যতটা পেলেন অনিকের কথায়।
" আপনার স্টিফেন হকিংও বলে গেছেন সাধারণ আপেক্ষিকতা সঠিক হলে অতীতে ট্রাভেল করা সম্ভব নয়।" অনিক সম্ভবত রেগে গেছে। গলার সুর ওরকমই মনে হচ্ছে।
"মানে কী বলতে চাচ্ছো?" প্রফেসর ব্যারো দ্বিধান্বিত।
" মানে যেকোনোভাবে হোক আমি একটা টাইম মেশিন আবিষ্কার করেছি এবং হাইপারড্রাইভ ইঞ্জিনের নকশা করে ফেলেছি। আপনারা আমাকে টাকা দিন আমি আপনাদের ইঞ্জিন দিচ্ছি।" অনিক গলার সুর নরম করে বলে।
প্রফেসর ব্যারো চুপ করে গেলেন। তার এই বাংলাদেশি শিষ্যটি মিথ্যা কথা বলার বা চাপা মারার লোক নয়। কিন্তু কি কারণে সে বিখ্যাত দুজন বিজ্ঞানী ছোট করে কথা বলছে সেটা বোধগম্য হচ্ছে না তার ।
সে যা বলছে তাও মিথ্যা নয় । আবার ওর কথা বিশ্বাস করলে আইনস্টাইন-হকিং এর মতো দুজন বিজ্ঞানীর কথা অস্বীকার করা হয়!
ব্যারোকে চুপ দেখে অনিক পেনড্রাইভ বের করে ব্যারোর ল্যাপটপে লাগিয়ে দেয়। প্রফেসর ব্যারো চশমা খুলে ল্যাপটপে চোখ লাগিয়ে ওর থিওরি গিললেন। তারপর বললেন,
" খুব ভালো সায়েন্স ফিকশন। কিন্তু তোমাকে টাকা দিতে গেলে ফিন্যান্স কমিটিকে বোঝাতে হবে যে এটা মারভেলের কমিক নয়।"
" আর তাছাড়া , হাইপার স্পেস ড্রাইভ নিয়ে খেলার পরিণতি ভালো হব---
অনিক ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।
সেই রাতে বাসায় যেয়ে বিবিসি চালু করলেন ব্যারো। লাইভ দেখাচ্ছে। দশদিন আগে অনিক নামে কেমব্রিজের তরুণ এক লেকচারার লন্ডন ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে টাকা নিয়ে ভেগে গেছে।
" অনিক দশদিন আগে ভেগে গেলে আজ 'কে' এসেছিল?" এই কথা ভাবতে ভাবতে প্রফেসর আইজ্যাক ব্যারোর সম্ভবত হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়।