আ ন ম ইমতিয়াজ:
গত বেশ কয়েক বছর ধরে যে কোন বয়সের শিক্ষার্থীদের বাবা-মা কিংবা অভিভাবকদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে যে একটা বিষয়, সেটা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা বইয়ের পাতা রেখে ইলেকট্রনিক কোন গেজেটের ডিজিটাল পর্দায় দীর্ঘ সময় ব্যস্ত থাকা। পড়ার টেবিলে বেশিক্ষন মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না বাচ্চারা। সুযোগ পেলেই ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে সেলফি তোলায় বা কোন গেমস খেলায় কিংবা ইউটিউবের নেশায়। আসলেই তাই, নেশা বা আসক্তি বলা হচ্ছে। কারন, তারা নিজের ইচ্ছায় ইলেকট্রনিক ডিভাইসটি হাত থেকে সরিয়ে রেখে যে অন্য কোন কাজে মনোনিবেশ করবে, তা তারা পারছে না! বাবা-মা এসে যতক্ষন না রাগ দেখাচ্ছে কিংবা বকা দিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা আটকে আছে ইন্টারনেট, মোবাইল, গেমস কিংবা স্যাটেলাইট টিভির রঙিন দুনিয়ায়। বকা-ঝকা থেকে শারীরিক প্রহার কিংবা শাস্তি কোন ভাবেই তাদেরকে বিরত রাখা যাচ্ছে না এই ভয়ংকর মোহ থেকে। অনেক সময় ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, হচ্ছে অনেক দুর্ঘটনা। বাবা-মার উপর রাগ করে অনেকেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, নিজের উপর করছে শারীরিক নির্যাতন, অনেকেই করছে আত্নহত্যা। কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে রাস্তা পার হতে গিয়ে কিংবা সেলফি তুলতে গিয়ে মারা পড়ছে অনেকেই। মোবাইল নিয়ে বাজি কিংবা দামী মোবাইলের লোভে খুন হচ্ছে বন্ধুর হাতে।
পিছনে প্রশ্ন থেকে যায়, কেনো হচ্ছে এমনটা? দোষটা আসলেই কার? সমাধানটাই বা কি?
জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি সাধনের সাথে সাথে মানুষ তার দৈনন্দিন জীবন-জীবিকা আরও সুষ্ঠু ও কার্যকরীভাবে নির্বাহ করতে গিয়ে আবিষ্কার করেছে নানান কিছু। এহেন কোন জিনিস আমাদের আশে পাশে নাই যে সেটা বিজ্ঞানের চশমা পরে নতুন ভাবে দেখার চেষ্টা করা হয়নি বা বোঝার চেষ্টা করা হয়নি। এই দেখা আর বোঝার কাজ করতে যেয়ে আবিষ্কৃত হয়েছে হাজারো-লক্ষ যন্ত্র। আর হিন্দি চলচ্চিত্র "থ্রি ইডিয়টস" এর কল্যাণে যন্ত্র কিংবা মেশিনের খুব সহজ-সাবলীল-সুন্দর একটা সংজ্ঞা আমরা শিখেছি,"যা কিছু মানুষের কাজকে সহজ করে, তা-ই যন্ত্র"।
ছোট একটি কাপড় সেলাইয়ের সুই থেকে শুরু করে অন্তরীক্ষে গমনকারী সুবিশাল রকেটটি পর্যন্ত সব কিছুই হচ্ছে যন্ত্র বা মেশিন। সুই মানুষের কাপড় সেলাই করে জামা বানানোর কাজে লাগে, আর অন্যদিকে রকেটে চড়ে মানুষ চাঁদ জয় করে এখন মঙ্গল গ্রহের দিকে ছুটছে। আদি মানবের হাতে প্রথম তৈরি যন্ত্রটি কি ছিলো তা জানা যায়না। হতে পারে ক্ষুদার তাড়নায় শিকার ধরার জন্য ছুড়ে মারা পাথরের টুকরোটিই হয়তো প্রথমতম কোন যন্ত্র। আর ওই ঘটনার পর মানুষ পার করে এসেছে লক্ষ লক্ষ বছর। ধারণা করা হয় বর্তমান বুদ্ধিমান মানুষের বয়স দুই লক্ষ বছর। আর আমাদের আদি মানবের বয়স ষাট লক্ষ বছরের কম হবে না। আর সভ্যতা মাত্র ছয় হাজার বছর পুরনো। অথচ এর মধ্যেই মানুষ বানিয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন মেশিন বা যন্ত্র। সব কিছু তৈরির পিছনের চাহিদাটা হচ্ছে মানুষকে দ্রুত কাজ করতে সাহায্য করা, ভালোভাবে কাজটা সমাধা করা। আর এই বিলিয়ন বিলিয়ন মেশিনের কিছু লেগেছে ভালো কাজে, আবার কিছু লেগেছে মন্দ কাজে। আর যে কোন সৃষ্টির সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয়টি হচ্ছে, এটার সার্বজনীনতা। একটা যন্ত্র খারাপ না ভালো তা নির্ভর করছে কে এটাকে ব্যবহার করছে, কিভাবে ব্যবহার করছে, কি উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে, চূড়ান্ত ফলাফল কি হচ্ছে তার উপরে। একই ফুল থেকে নাকি মৌমাছি মধু নেয়, আর প্রজাপতি নেয় বিষ। দোষ বা গুন ফুলের না, কে নিচ্ছে, কি জন্যে নিচ্ছে তা দেখতে হবে।
প্রথম প্রশ্ন, কেনো হচ্ছে এমনটার উত্তর বলতে গেলে আমরা দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর টাও পেয়ে যাই। একদম সহজ ভাবে বলতে গেলে দোষটা বাবা-মা কিংবা অভিভাবকদের উপরেই আসবে? জ্বী হ্যাঁ, আসলেই তাই, অবাক হবার কিছু নেই! বাচ্চাদের শুধু ভালো খাবার, বড় বাসা, সুন্দর জামা-কাপড়, নামী-দামী স্কুল কলেজ দিলেই হয়না, তাদের মানসিকতা ও দক্ষতা গঠনে আছে অভিভাবকদের অনন্য ভূমিকা। জন্মের পরপরেই নবজাতকরা প্রথম চিনে মা এর চেহারা, তারপর বাবার, তারপর আশে পাশে যারা থাকে, যেমন দাদা-দাদী, নানা-নানী। তাদের মুখের কথা শুনে শুনেই রপ্ত করে ভাষা। তারা ধীরে ধীরে কথা বলার চেষ্টা করে, মুখ দিয়ে শব্দ তৈরি করে সবার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে। যেখান থেকেই শব্দ আসে, সেখানেই তার মনোযোগ আটকে যায়। এটা মানুষের আদিমতম অভ্যাস। ঠিক ওই সময়টাতেই তারা দেখে যে তাদের আশেপাশের প্রিয় মানুষ গুলোর বাহিরেও আরও কিছু উৎস থেকে মানুষের শব্দ আসে। যেমনঃ টেলিভিশন, মোবাইল, কম্পিউটার ইত্যাদি।
বাবা হয়তো অনলাইনে ভিডিও কলের মাধ্যমে তার গ্রামে অবস্থিত আরেক আত্মীয়কে তার নবজাতক বাচ্চাকে দেখাচ্ছেন কিংবা মোবাইলটি বাচ্চার কানে ধরছেন। সবার অজান্তেই নবজাতক বাচ্চাটি মানুষের শব্দ আসে কিংবা ছবিও দেখা যায় এমন নতুন একটা জিনিসের সন্ধান পায়! অবাক হয়, বিস্মিত হয়, জিনিসকে ধরে দেখতে চায় সে!
আর বাচ্চারা হচ্ছে অনুকরণ প্রিয়। বড়রা কিভাবে মোবাইল কিংবা ইলেকট্রনিক ডিভাইসটি ধরে, চালায়, কল দিয়ে কথা বলে, এগুলা সে পর্যবেক্ষণ করে। ফলশ্রুতিতে দেখা যায়, কোমড়ে ভর দিয়ে বসার আগেই বাচ্চারা হাতের কাছে মোবাইল বা এই সদৃশ্য কোন কিছু পেলেই তা হাতে নিয়ে বড়দের অনুকরণ করে, কানে লাগিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে। মোবাইল, ল্যাপটপ বা টিভির পর্দায় তাকিয়ে নড়াচড়া দেখে, শব্দ শুনে, প্রতুত্তর দেয়, শব্দ করে, ডাক দেয়, হাতে ইশারা দিয়ে পর্দার অবাস্তব চরিত্র গুলোকে কাছে ডাকে। ছোট্ট বেলার এই কৌতুহল গুলোই একদিন নেশায় পরিনত হবে, তার অনেক সেন্সকেই দুর্বল করে দিবে, তার শারীরিক-মানসিক অনেক ক্ষমতাকেই ম্রিয়মাণ করে দিবে, আমরা বড়রা তা কোনদিন টের পাই না, বুঝতে পারিনা। আসলে এর শুরুটা হয়তো আরও আগেই। মাতৃ গর্ভ থেকেই তারা যে এগুলার প্রতি আকর্ষণ নিয়ে আসছে না, তা কিভাবে বলবো?
বিশ্বায়ন, শিল্পায়ন, নগরায়ন এর এই যুগে উন্নত জীবনের আশায় সামাজিক বন্ধন ছিন্ন করে গড়ে উঠছে একক পরিবার। খুব বেশিদিন আগে না, হয়তো বিশ-পঁচিশ বছর আগেও দেখা যেতো শহরে চাকরি করা ছেলের বাসায় এসে তার বৃদ্ধ বাবা-মা এক সাথে বসবাস করতো। এখন এই দৃশ্য কমে যাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী যৌথভাবে সংসারের জন্য আয় করছে। তার একটা অংশ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাদের বৃদ্ধ বাবা-মা সেখানেই ভালো আছেন। আর এদিকে শহরে একক পরিবারের ছোট্ট বাচ্চাটা বড় হচ্ছে বুয়ার আদরে। পরিবারের কর্তা-কত্রী তারা তাদের ক্যারিয়ার-অফিস নিয়ে ব্যস্ত, সন্তান সারাদিন থাকছে বাসার কাজের লোকের সাথে। সব বাসার দৃশ্য আবার এমন না। অনেক বাসায় যে বৃদ্ধ বাবা-মা থাকছেন না এমনটাও না। কিন্তু সংসারের সবচেয়ে ছোট যে সদস্য, তার সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য যতোটুকো সময় অন্যান্যদের কাছ থেকে পাবার কথা ছিলো, ঠিক ততটুকু সে পাচ্ছেনা। সময় বললে ভুল হবে, এটা হবে গুনগত সময় বা কোয়ালিটি টাইম। আসলে করারই বা কি আছে? বাচ্চাদের ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই স্কুলে যাবার তাড়া, ব্যাগ গোছাও, নাস্তা করো, ড্রেস পড়, গাড়ি ধরো; ওই দিকে স্কুলের কড়া রুটিন, ক্লাসের পর ক্লাস, পিটি প্যারেড, এক্সট্রা কারিকুলার এ্যাক্টিভিটিজ; স্কুল শেষে কোচিং-টিউশন, ম্যাথের ভাইয়া, ইংরেজির স্যার, আরবির হুজুর; কাধে বড় ব্যাগ, ভারী বোঝা, খাতা ভর্তি বাড়ির কাজ, সি ডাব্লিউ, এইচ ডাব্লিউ। দিন শেষে পাগলপ্রায় বাচ্চা একবার বাবার কাছে যায়, বাবা ল্যাপটপে ব্যাস্ত; তো আবার মায়ের কাছে যায়, মা সারাদিন অফিস করে এসে রান্না কিংবা ঘর গৃহস্থালীর কাজে ব্যস্ত; দাদা-দাদু সারাদিন একই গল্প করে, ভালো লাগে না; বারান্দায় গেলেও কিছু দেখা যায়না, সামনের বিল্ডিং এর দেয়াল ছাড়া; পাশের বাসার বন্ধুর সাথেও সন্ধ্যার পরে দেখা করা বারন, তখন নাকি পড়া লেখার সময়; ঠিক এমন সময় হাতের কাছে বিনোদনের জন্য বলি আর সময় কাটানোর জন্য বলি ইলেকট্রনিক ডিভাইসের থেকে সহজলভ্য আর কিছু নেই। সব ঘাট ঘুরে বাচ্চা বিরক্ত হয়ে কথা বলার কাউকে না পেয়ে সময় কাটানোর জন্য অবশেষে মোবাইল বা ট্যাব হাতে তুলে নেয়। যাক, কিছু একটা তো পাওয়া গেলো, এখন তো আর বাচ্চা ডিস্টার্ব করবে না, বাবা-মাও হাফ ছেড়ে বাঁচে!
সাদাফের দেখাদেখি রাহাত, রাহাতের দেখাদেখি আনান। এক হাত দুই হাত আর এক কান দুই কান করে পুরা বিল্ডিংয়ে, দুই দিন পরে পুরো সোসাইটিতে। বাচ্চাদের মধ্যে একজন শুরু করলেই হলো বাকিদেরও তা লাগবে। অমুকে আইফোন নিছে, আমারও তা লাগবে। তমুকে প্লে স্টেশন ভার্সন ফোর কিনেছে, আমার ফাইভ লাগবে। একদিন দুই দিন করে বছর চলে যায়, গেজেট হয়ে যায় বাচ্চাদের জীবনের অংশ। খেলাধুলা, যোগাযোগ, পড়া লেখা, অবসর বিনোদন সব কিছুই পাওয়া যায় এক যায়গায়। একটা সময় তা হয়ে উঠে অপরিহার্য। সব কিছুই ঠিক ছিলো, যদি না এটা আসক্তিতে পরিনত না হতো। কখন এটা আসক্তি বা নেশার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে? যখন দেখা যাবে ডিভাইস ছাড়া বাচ্চারা অন্যান্য আর কোন কাজই করতে পারছে না। ডিভাইসটি একদিনের জন্য সরিয়ে রাখলে কিংবা ব্যবহার হরতে মানা করলে সে অন্যরকম আচরণ করছে, রাগ দেখাচ্ছে, অভিমান করছে, বারবার পীড়াপীড়ি করছে, ভাত খাচ্ছে না, কথা শুনছে না! ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই সুখকর না।
এখন উপায়টা কি! সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছে। একটা প্রবাদ আছে, কাঁচায় না নোয়ালে বাশ, পাকলে করে ঠাশ ঠাশ! শিশু বয়সে বাচ্চাদের মন থাকে কাদা মাটির মতো নরম। তখনই থাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া আর পরিমিত অনুশাসনের মধ্যে রেখে ভবিষ্যতের জন্য যথোপযুক্ত করে গড়ে তোলা সম্ভব। যে কাজটা প্রথম দিকে অনেক সহজ ছিলো, সেটা একটা সময় পর অনেক কঠিন হয়ে যায়। একদম ছোট বেলা থেকেই তাদের ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সংস্পর্শে যতো কম আসতে দেওয়া যায়, ততোই মঙ্গল। টিভিতে কার্টুন না দেখিয়ে জীবন্ত কোন কিছু দেখিয়ে খাওয়ানোর অভ্যাস করতে পারলে ভালো হয়। বারান্দায় নিয়ে বাহিরের গাছ-পালা, কিংবা পাখি-বিড়াল ইত্যাদি দেখানোর মাধ্যমে তার সাথে খেলাধূলা করতে হবে। বাবা-মার এখানে একটু বেশি শ্রম দিতে হবে। ছোট বেলা থেকেই কাগজ-পেনসিলের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। রঙিন কাগজ, রং-পেনসিল, লেগোস, কার্ড-পাজল, ব্লক-পাজল ইত্যাদি নানা ধরনের খেলনা বাজারে পাওয়া যায়। খেয়াল রাখতে হবে খেলনা গুলো একই রঙের না হয়ে যেনো বিভিন্ন রঙের হয়। টিভিতে কার্টুন দেখতে দিলেও তা সব সময়ের জন্য না। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কিংবা এনিমেল প্লানেট এর মতো চ্যানেল গুলোও তাদের দেখানো। সবচেয়ে ভালো হয় কমিকস বই, ছড়ার বই যেগুলোতে রঙিন ছবি আছে এমন বই তাদের সামনে দেওয়া। বাবা-মায়েদের উচিৎ তাদেরকে বিভিন্ন প্রাণী, বস্তু, চরিত্র নাম ধরে ধরে বলা, অভিনয় করে দেখানো। বাচ্চারা বিরক্ত করবেই, কিন্তু বড়দের তা সহ্য করতে হবে। বিরক্তির হাত থেকে বাঁচতে তাদেরকে টিভি সেটের সামনে কিংবা মোবাইল হাতে দিয়ে বসিয়ে দেওয়া উচিত না। অদূর ভবিষ্যতে তাদের পাঠাভ্যাস, শিক্ষা গ্রহনের যোগ্যতা ও আকাঙ্ক্ষা, একাডেমিক পড়া লেখার ফলাফল এবং সর্বোপরি তাদের পেশা সহ মানবিক ও মানসিক চরিত্রের অনেক কিছু নির্ভর করছে এখানে।
তবে দেরি কখনও দেরি নয়। মানুষ হচ্ছে অভ্যাসের দাস। যে বয়েসেই অভ্যাস করানো যাবে, তখন থেকেই তা কাজে দিবে। হতাশ হওয়া যাবে না। ধৈর্য ধরে বাচ্চাদের বুঝাতে হবে। খারাপ দিক গুলো যতোটুকু পারা যায় তাদের বুঝাতে হবে। তাদের সাথে থাকতে হবে, তাদের ভিতরে ঢুকতে হবে, বাচ্চাদের মতো করে চিন্তা করতে হবে। যেসব বাচ্চারা প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে আছে, তাদেরকে মোবাইল বা ট্যাব ব্যাবহারের সময় বেঁধে দিতে হবে। দৈনিক দুই বেলা করে ত্রিশ মিনিটের বেশি নয়, এবং ছুটির দিন গুলিতে তা পয়তাল্লিশ মিনিট থেকে বাড়িয়ে এক ঘন্টা করা যেতে পারে। ডাক্তারের সিরিয়াল, বাস-ট্রেনের অপেক্ষাগার কিংবা যাত্রা পথে এমন সব যায়গায় যেখানে অনেকক্ষন বসে থাকতে হয়, কোন কাজ থাকে না, তখন বাচ্চারা মোবাইল ব্যাবহারের জন্য বিরক্ত করে। এমন সব পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য সব সময় ব্যাগে কলম-পেনসিল-কাগজ রাখা উচিত। কাগজ কলম নিয়ে তারা আঁকি বুকি কিংবা কাটাকাটি খেলা খলেতে পারে। কিংবা, তখন তাদের সাথে আশেপাশের কোন বিষয় বস্তু নিয়ে মুখে মুখে অনেক ধরনের খেলা শুরু করা যেতে পারে। যেমনঃ আমি যা দেখি, তুমি কি তা দেখো? সব সময় আবেগ নয়, বুদ্ধি দিয়ে সমাধান করতে হবে। বাসায় থাকাকালীন সময়ে মাঝে মাঝেই তাদেরকে দিয়ে শারীরিক কসরত হয় এমন কাজ করানো। নিজের জামা গুছিয়ে রাখা, টিফিনবক্সটা ধুয়ে পরিষ্কার করা, বাসার নিচে গ্যারেজে সাইকেল চালানো, বারান্দায় গাছে পানি দেওয়া ইত্যাদি। তাদের সাথে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বোর্ড গেম খেলা ক্যারাম, দাবা, লুডু, ধনী হবার মজার খেলা, চোর-পুলিশ ইত্যাদি। আরেকটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, সেটা হচ্ছে বাচ্চাদের পড়ার সময়ে অন্য কারো টিভি না দেখা। টিভির রুম কিংবা বসার ঘরের বাহিরে শোবার ঘরে টিভি স্থাপন না করা, এটা খারাপ উদাহরণ তৈরি করে। পড়াশোনা বা বাড়ির কাজ শেষ করলে টিভি কিংবা ইউটিউব দেখতে না দিয়ে আইকিউ কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক গেমস খেলতে দেওয়া। মাঝে মাঝেই তাদের নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া। যথা সময়ে বাড়ির কাজ করলে কিংবা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলে নতুন কোন ইলেকট্রনিক গেজেট কিনে না দিয়ে উচিত তাদের নিয়ে বিনোদন বা থিম পার্কে ঘুড়তে যাওয়া। এতে শরীর ও মন দুটোই চাঙ্গা হয়, বাচ্চাদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়।
যথাযথ বয়স না হলে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেওয়া মোটেই উচিত না। দিলেও ব্লকিং বা বিভিন্ন প্যারেন্টাল কন্ট্রল সফটওয়ার ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে তারা তো খুব সহজে কোন অজানা জিনিস শিখতে পারবেনা, খুব দ্রুত ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে না। অন্য বাচ্চাদের থেকে পিছিয়ে যাবে। "ডিজিটাল লিটারেসি" বাধাগ্রস্ত হবে। এই ব্যাপারটা নিয়ে আরেকদিন লেখা যাবে, ব্যাপারটি অনেক বড়। শুধু এতোটুকু বলা যেতে পারে, বুড়ো দাদুও ইংরেজি পড়ে পড়ে মোবাইল বেশ ভালোই চালাতে জানেন। কম শিক্ষিত অনেকের হাতেই এখন স্মার্টফোন আছে। সুতরাং বলা যায়, ডিজিটাল লিটারেসি প্রয়োজনের সময় ঠিকই অর্জন হয়ে যাবে, তার জন্য বাচ্চার হাতে ছোট বেলাতেই মোবাইল বা ট্যাব তুলে দেওয়া তাকে বিপদগ্রস্ত করার শামিল। সমস্যার সমাধান কিন্তু বাবা-মায়েদের হাতেই। যে ফ্যামিলিতে বড়রা নিজেরাই সারাদিন মোবাইল-ইন্টারনেট-টিভি-ইউটিউবে ব্যস্ত থাকে, সেখানে ছোটরা হঠাৎ করে এগুলা থেকে দূরে থাকবে তা আশা করাটা কঠিন। পূর্ববর্তী প্রজন্ম গুলোর মতো এখনকার বাবা-মায়েরা বাচ্চা লালন-পালন কিংবা তাদের সাথে থাকার ব্যাপারে এতোটা আগ্রহী না। ভোগবাদের এই দুনিয়াতে বাচ্চারা হচ্ছে মেশিন, রেজাল্ট তৈরির যন্ত্র, ভবিষ্যতের ডিপোজিট। তাদেরকে মানবীয় গুনাবলীর চাদরে জড়িয়ে পরিপূর্ণ ভালো মানসিকতার ছাচে ঢেলে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ইচ্ছাটা বোধহয় এই জেনারেশনের বাবা-মায়েদের কমই আছে!
তবে যেদিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, তাতে সবারই খারাপ হবে বলে মনে হয়। এটা তো মোটেই আশার কথা না, সুন্দরের কথা না। এমনটা কোন মতেই কাম্য হতে পারেনা। সুন্দর আগামীর জন্য আমাদের সবারই উচিত বাচ্চাদের সামনে উদাহরণ হওয়া। নিজের পরিবর্তনের মাধ্যমে ছোটদেরকে ভালোর দিকে ধাবিত করার রাস্তা দেখিয়ে যাওয়া। যোগ্যতা সম্পন্ন মানবিক যে কোন মানুষই স্মার্ট মানুষ। এখনকার স্মার্ট বাবা-মায়েদের জেনারেশন ভবিষ্যতে আরও বেশি স্মার্ট একটা জেনারেশন দেশ ও জাতির জন্য দিয়ে যাবে, আমরা তাই আশা করি।
লেখক: উর্ধ্বতন কর্মকর্তা,
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড