-->

বন্ধুত্বের পূর্বশর্ত।



সাজ্জাদুল ইসলাম রাকিব,(নোয়াখালী):
আজকাল টিভি বিজ্ঞাপনগুলো বন্ধু শব্দটিকে মহিমান্বিত করতে করতে একেবারে ভিন্ন এক মাত্রায় নিয়ে গেছে, যা অনেকের কাছেই বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার অনলাইনভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে নিতান্তই অজানা-অচেনা কোনো ব্যক্তিকে তথাকথিত বন্ধু বানিয়ে ফেলা সম্ভব বলে, বন্ধু শব্দটি অনেকাংশেই তার চিরাচরিত আবেদন হারিয়ে ফেলেছে।

কিন্তু পারিপার্শ্বিক প্রভাবকসমূহের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে, একদম নির্মোহভাবে যদি আমরা চিন্তা করে দেখি, তাহলে কিন্তু প্রমাণ পেয়ে যাব, সত্যিই বন্ধু ছাড়া জীবন অসম্ভব।

মানুষ হিসেবে যেকোনো খুশির সংবাদ, কিংবা যেকোনো দুঃখবোধ, সবকিছুই আমরা চাই কোনো একজন বিশেষ মানুষের সাথে ভাগ করে নিতে। এবং সেক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই একজন বন্ধু হয়ে থাকে আমাদের প্রথম পছন্দ। কেননা বন্ধুই হলো সেই ব্যক্তি, যে আমাদেরকে চেনে, জানে, বোঝে এবং অনুভব করে।

একজন বন্ধুর সংস্পর্শে আমরা যে মানসিক নৈকট্য লাভ করতে পারি, তা আর কারও সাথেই সম্ভব নয়। বিশেষ করে বয়স বাড়ার সাথে সাথে যখন আমাদের বাবা-মা, ভাই-বোনের মতো রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের সাথে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়, তখনো আমাদের শেষ আশ্রয় হিসেবে রয়ে যায় বন্ধুরাই।

কথিত রয়েছে, সে-ই সত্যিকারের ভাগ্যবান মানুষ, যার একজন সত্যিকারের ভালো বন্ধু আছে। কিন্তু ভালো বন্ধু পাওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়। বিশেষত, ভালো বন্ধু পেতে চাইলে, আগে আমাদের নিজেদেরও বন্ধু হিসেবে ভালো হওয়া প্রয়োজন। আমরা নিজেরাই যদি অন্যের বন্ধু হিসেবে খুব ভালো না হই, তাহলে আমাদের ভাগ্যেও কীভাবে ভালো বন্ধু জুটবে, বলুন!

এখন প্রশ্ন হলো, একজন ভালো বন্ধু হওয়ার উপায় কী? এ ব্যাপারে অসাধারণ কিছু পরামর্শ দিয়ে গেছেন প্রাচীন রোমের দার্শনিক মার্কাস টুলিয়াস সিসেরো। তার লেখা "ডি অ্যামিসিডিয়া" (ইংরেজিতে How to Be a Friend) বইটিকে অনেকেই মনে করে থাকে বন্ধুত্ব বিষয়ক সর্বকালের সেরা বই হিসেবে।

ক্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দে, ষাটোর্ধ্ব বয়সে রোমান সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও বাগ্মী হিসেবে বিবেচিত সিসেরো যখন জুলিয়াস সিজার কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে নির্বাসিত হন, তখন মনের জ্বালা মেটাতে কলম ধরেন তিনি। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি বিবিধ বিষয়ে দারুণ সব রচনা সম্পন্ন করে ফেলেন। এর মধ্যে একটি ছিল বন্ধুত্ব বিষয়ক, যেখানে উঠে এসেছিল প্রিয়তম বন্ধু অ্যাটিকাসের (টাইটাস পম্পোনিয়াস) সাথে তার সম্পর্কের খুঁটিনাটি।

তৎকালীন সময়ে অধিকাংশ রোমানই বন্ধুত্ব বলতে বুঝে থাকত ব্যবহারিক একধরনের সম্পর্ক, যা গড়ে ওঠে পারস্পরিক স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে। অর্থাৎ স্বার্থই ছিল বন্ধুত্বের মূল কাঠামো। এমন বন্ধুত্বের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতেন না সিসেরো। তবে তিনি বিশ্বাস করতেন, মামুলি সব জাগতিক স্বার্থের উর্ধ্বে উঠেও বন্ধুত্ব সৃষ্টি করা সম্ভব। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে নিজের ছোট্ট বইটিতে তিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন ভালো বন্ধু হওয়ার জন্য স্মরণীয় বেশ কিছু নীতি। সেগুলোর মধ্য থেকে সেরা দশটি এখানে তুলে ধরা হলো।

প্রতি মুহূর্তের স্বতঃস্ফুর্ততাই বন্ধুত্বঃ

দু’জন বন্ধুকে সবসময় পাশাপাশি বসিয়ে বন্ধুত্ব করতে হবে বলে বন্ধুত্ব করা যায় না। প্রেমের মতোই বন্ধুত্বও সাবলীল এবং স্বতঃস্ফুর্ত। ফলে প্রিয় বন্ধুরা কখনওই একসঙ্গে চুপচাপ থাকে না। তারা প্রাণবন্ত এবং উচ্ছল থাকে। যদি কথাই বলতে ইচ্ছা না করে তাহলে সেই বন্ধুত্ব না করাই ভালো। জোর করে অন্তত বন্ধুত্ব হয় না।

বন্ধুত্ব চিরকালেরঃ

প্রিয় বন্ধু চিরদিনের। হতে পারে দু’জনে আলাদা কলেজ গিয়েছেন, আলাদা শহরে জীবন-যাপন করেন, প্রাত্যহিক জীবনের নানা কর্মকান্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, কিন্তু এত কিছুর পরও ভালো বন্ধুত্ব কখনোই হারিয়ে যায় না। দুজন ভালো বন্ধু কখনোই একে অপরকে ভুলে যাবে না, বরং আরো বেশি করে একে অপরকে মনে করবে এবং সময় পেলেই একে অপরের সঙ্গে দেখা করে খুনসুটি করবে, এমনই হতে হবে বন্ধুত্ব। রাগ অভিমান করে পরস্পরকে ভুলে গেলে সেটা কখনোই প্রকৃত বন্ধুত্ব নয়। যেকোনো উপায়ে একে অপরের সাথে যুক্ত থাকা এবং মনের ভাব আদান-প্রদান করার চেষ্টার মধ্য দিয়ে বন্ধুত্বকে জিইয়ে রাখতে হয়।

বন্ধুত্বে বিশ্বস্ত থাকাঃ

বন্ধুত্বে বিশ্বাস রাখা খুবই জরুরী। তৃতীয় কোনো পক্ষের কথার সূত্র ধরে বন্ধুত্বের বিশ্বাসভঙ্গ কখনোই কাম্য নয়। প্রকৃত বন্ধুকে এ বিষয়টি সবসময় মাথায় রাখতে হয়, তবেই তো বন্ধুত্ব দীর্ঘায়ু হয়। বন্ধুত্বে কোনো সমস্যা থাকলে মুখোমুখি আলোচনা করা, সরাসরি জানতে চাইলে অনেক ভুল-ভ্রান্তি সহজেই দূর করা যায়। প্রয়োজনে তৃতীয় পক্ষকে সামনে রেখে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা উচিত। অকারণে কখনোই বন্ধুকে দায়ী করবেন না। বন্ধুর কোনো কিছু অপছন্দ হলে অন্যের কাছে সমালোচনা না করে সরাসরি বলাই শ্রেয়।

দুঃসময়ে পাশে থাকাঃ

এক বন্ধুর বিপদে চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই অন্য বন্ধুর সাড়া দেওয়াই হচ্ছে প্রকৃত বন্ধুত্বের পরিচয়। প্রয়োজনে রাত চারটের সময়েও বন্ধুর পাশে থাকা অপর বন্ধুর কর্তব্য। যে বন্ধুর জন্য আপনি এমন করতে পারবেন এবং যে বন্ধু আপনার পাশে সর্বদা থাকতে পারবে, সে-ই আপনার সত্যিকার বন্ধু। ফলে এরকম বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করাই উচিত।

বন্ধুত্বের ইচ্ছেকে সম্মান জানানোঃ

বন্ধুর ইচ্ছাকে সবসময় সম্মান জানানো উচিত। যদি তা পছন্দ না হয়, তবে সরাসরি বলুন। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা অবশ্যই জরুরী। সমালোচনা করুন, তবে কটুক্তি নয়। বন্ধুর সমালোচনা বন্ধুরা করবে না তো কে করবে? তবে সমালোচনার ভাষা ব্যবহারে সচেতন হওয়ায় খুবই প্রয়োজন। একবার ভুল হলে তাকে ছুঁড়ে না ফেলে তা শুধরে নেওয়াই প্রকৃত বন্ধুর দায়িত্ব। বন্ধুর প্রতি বিনয়ী হওয়া বন্ধুত্বের প্রধান হাতিয়ার।

প্রতিনিয়ত বন্ধুর ভালো চাওয়াঃ

ভালো বন্ধু সবসময় বন্ধুর ভালো চায়। নিজের ভালো হোক সকলেই চায়, তবে তার জন্য বন্ধুর ক্ষতি হোক এমন ভাবা কিন্তু প্রকৃত বন্ধুর পরিচায়ক নয়। প্রকৃত বন্ধু চাইবেন তার নিজের উন্নতির পাশাপাশি আপনারও উন্নতি হোক। যেখানে কিংবা যত দূরেই থাকুন না কেন, বন্ধুর কল্যাণ কামনাই প্রিয় বন্ধুর পরিচায়ক।

বন্ধুত্বে সৎ থাকাঃ

বন্ধুত্বে অবশ্যই সৎ থাকতে হবে। মিথ্যা তথ্য কিংবা ধারণা দিয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়া যায়, কিন্তু গড়লেও তা কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আপনি যা সেটাই প্রকাশ করা এবং অযথা কৃত্রিমতা বর্জন করে নিজের ব্যক্তিত্বকে প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে বন্ধুর কাছে স্বচ্ছ ধারণা তুলে ধরাই হচ্ছে প্রকৃত বন্ধুর দায়িত্ব। মনের মতো বন্ধু পেতে সততার কোনো বিকল্প নেই। সততা প্রিজারভেটিভ ছাড়াই সম্পর্কের বৃক্ষকে সতেজ রাখে।

বন্ধুকে সময় দেওয়াঃ

দীর্ঘদিনের বন্ধুরা একে অন্যের পেছনে সময় ব্যয় করে। মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রতিনিয়ত সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। বন্ধুরা হয়তো আগের মতো সময় দিতে পারে না। এর ফলে যে দুই বন্ধুর মধ্যে সম্পর্কের ব্যাঘাত ঘটবে তা কিন্তু না। নতুন বন্ধুদের পাশাপাশি পুরোনো সম্পর্কগুলোকে ঝালাই করে নিতে হয় প্রতিনিয়ত। দৈনন্দিন ব্যস্ততায় পুরোনো বন্ধুত্বকে হারিয়ে ফেলা একদমই উচিত নয়। আপনার বন্ধু আর আপনার মাঝখানে কেবল এক মুঠোফোন দূরত্ব। বন্ধুকে মনে করুন, পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করুন।

ভালো শ্রোতা হওয়াঃ

বন্ধুত্বে ভালো শ্রোতা হওয়াও খুব জরুরি। বন্ধুর সাথে আড্ডায় কেবল নিজের কথাগুলোকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত নয়। বন্ধুকেও কথা বলতে দেওয়া এবং আলোচনায় উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে দুজনের ভালো লাগা, মন্দ লাগা পরষ্পরের বুঝে নিতে সহজ হয়। বন্ধুর সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া, বন্ধুর কাছে গুরুত্বপূর্ণ এমন বিষয় নিয়ে উপহাস না করাই প্রকৃত বন্ধুর দায়িত্ব। বন্ধু মানেই কেবল আমার সবটুকু কথা তাকে বলে ফেলা নয়, বরং তার কথাগুলোকেও আপন করে নেওয়া।

বন্ধুত্বকে টিকিয়ে রাখতে শেখাঃ

একজন প্রকৃত বন্ধুকে অবশ্যই জানতে হবে কিভাবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হয়। অনেকেই জানে না যে বন্ধুত্ব কিভাবে টিকিয়ে রাখতে হয়। ফলে কারণে-অকারণে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়, দূরত্ব তৈরি হয়, বন্ধুত্ব ক্রমেই হারিয়ে যায়। বিপরীতে যারা দীর্ঘদিন বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে, তারা এর মূল বিষয়টি জানে। এতে থাকতে হয় স্বাভাবিকতা, প্রাণ চাঞ্চল্য। বন্ধুত্বের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি, রাগ, অনুরাগ, ব্যস্ততা, এড়িয়ে চলা, নার্ভাস ভাব ইত্যাদি দূরে রাখা শিখতে হয়।

মানুষের নিরন্তর পথ চলায় অক্সিজেনের কাজ করে বন্ধুত্ব। যে কথা কাউকে বলা যায় না, তার আগল অকপটে খুলে দেয়া যায় বন্ধুর সামনে। বন্ধু কখনো শিক্ষক, কখনো সকল দুষ্টুমির একমাত্র সঙ্গী। মনের বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস, আবেগ আর ছেলেমানুষী হুল্লোড়ের অপর নামই তো বন্ধুত্ব। যেতে যেতে বন্ধুত্ব নিয়ে কৃষ্ণকলির এই অসামান্য গানটি শুনিয়ে যাই পাঠকদের যা দুই বন্ধুর মনের চেতনাকে ব্যক্ত করেছে।
বন্ধুত্বের পূর্বশর্ত। বন্ধুত্বের পূর্বশর্ত। Reviewed by সম্পাদক on মঙ্গলবার, আগস্ট ১৮, ২০২০ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.