জেবা সামিহা তমা,(রংপুর):
হাত থেকে পড়লেও খুব সহজে ভেঙ্গে যায় না, ওজন কম; এসব প্লাস্টিকের বৈশিষ্ট্যে পড়ে। আমাদের প্রতিদিনের সাধারণ জিবনযাপনে প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেক বেশি চোখে পড়ে। যেমন পানির বোতল, টিফিন বক্স এমনকি চোখের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ চশমাও প্লাস্টিকের হয়। কিন্তু প্লাস্টিক কি শুধু ব্যবহারের বস্তু হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ?
খাতা-কলমের ভাষায় প্লাস্টিক হলো এমন বস্তু যা কোনো সিন্থেটিক বা আধা সিন্থেটিক জৈব যৌগ দ্বারা তৈরি। ব্যবহারের জন্যে বা নমনীয়তার জন্যে এটিকে গলিয়ে বিভিন্ন শক্ত জিনিসে দেয়া যায় এবং অনেক ধরণের আকৃতি দেয়া সম্ভব হয়। প্লাস্টিকের আবার অনেক ধরণের প্রকারভেদ আছে। প্রকারভেদগুলো হলো - পলিমাইডস অথবা নাইলন, পলিকার্বনেট, পলেস্টার, পলিইথিন, পলিপ্রপাইলেন, পলিস্ট্রিন, Polyurethanes, polyvinyl chloride, Acrylonitrile butadiene styrene.
ইতিহাসের মতে খ্রিস্টের প্রায় দেড়শত শতক আগে মেক্সিকোতে পলিমারের বল ব্যবহার করা হয়েছে। এরপর আরও কয়েকশো বছর পর "পারকেসিন" নামে আরও প্লাস্টিকের মতো আরও একটি দ্রব্য আসে। সেসময় এসব দ্রব্য সাধারণত জাহাজ তৈরিতে ব্যবহার করা হতো। তবে এতো কিছুর পরেও প্লাস্টিকের পূর্ণাঙ্গ রূপে জন্ম নিতে সাহায্য করে লিও।
বেলজিয়ামে মুচির ঘরে জন্ম নেয়া লিও হেনরি বায়েকল্যান্ড ছোট থেকেই পড়াশোনার প্রতি অনেক আগ্রহী ছিলেন। মায়ের অনুপ্রেরণা ও প্রচেষ্টায় ২০ বছর বয়সে রসায়নের উপর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর লিও নিউইয়র্কে এসে বিয়ে করেন এবং নিজের আবিষ্কৃত ফটোগ্রাফিক প্রিন্টিং পেপার বিক্রি করে বেশ সচ্ছল জিবনযাপন করা শুরু করেন। কিন্তু এতো সচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও রসায়নের প্রতি ভালোবাসার কারণে হাডসন নদীর পাশে নিজের বাসার সাথে গবেষণাগার তৈরি করে শুরু করেন গবেষণা। লিও তখন সেখানে ফরমালডিহাইড ও ফেনল নিয়ে পরিক্ষা চালাচ্ছিলেন এবং না চাইতেই ৪৩ বছর লিওর এই পরিক্ষা নতুন আবিষ্কারের সূচনা করে। লিও তার এই নতুন আবিষ্কারের নাম দেন " বেকলাইট "। ১৯০৭ সালের ১১ জুলাই একটি জার্নালে লিও তার নতুন উদ্ভাবিত পদার্থ নিয়ে বলেন " আমি যদি ভুল না করে থাকি, আমার এই উদ্ভাবন ভবিষ্যৎে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হবে। "
লিও'র সেদিনের আবিষ্কৃত পদার্থটি ছিলো প্লাস্টিক।
১১৩ বছর আগের লিও হেনরি বায়েকল্যান্ড এর গর্ব করে বলা উক্তিটি আজ সত্য বলে বিশ্বাস হয়। রাসায়নিক শিল্পের একটি বড় অংশের লাভজনক পন্য বা উপাদানই হচ্ছে প্লাস্টিক। বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাসায়নিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, জার্মানির BASF এর পণ্য হলো প্লাস্টিক। ২০১২ সাল পর্যন্ত BASF এর মুনাফা ৪.৮৭৯ বিলিয়ন ডলার। এ থেকে বোঝা যায় প্লাস্টিক কত গুরুত্বপূর্ণ আজকের সময়ে।
আবার এই প্লাস্টিকই বিশ্ব নেতাদের দুঃশ্চিন্তার একটি কারণ, এ থেকেও আন্দাজ পাওয়া যায় প্লাস্টিক কতো গুরুত্বপূর্ণ। বেশিরভাগ প্লাস্টিকই টেকসই, প্লাস্টিক ধীরেধীরে ক্ষয় হয়, এতোটাই ধীরে যে এর সময় লাগে ৫০০ বছর। তাই আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহার করা প্লাস্টিক দ্রব্যগুলো যখন আমরা আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেই তখন তা শুধু পরিবেশের ক্ষতিই করে। ওশান কনজারভেন্সি জানিয়েছে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম অন্যান্য দেশগুলোর চেয়ে বেশি পরিমাণে প্লাস্টিক দ্রব্য সমুদ্রে ফেলে এবং বিশ্বের ৮৮-৯৫% প্লাস্টিক এই দেশগুলোর নদী ও সমুদ্র বহন করে। অর্থাৎ আমরা আন্দাজ করতে পারি জলজপ্রানিগুলো কি রূপ হুমকির মুখে রয়েছে। ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে। তাই প্লাস্টিক যখন মাটিতে ফেলা হয় বা মাটিতে মিশে যায় তখন তা মানুষের খাদ্যচক্রে মিশে যায় এবং মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্লাস্টিকের অপকারের পরিমাণ এতো ছোট করে বলে শেষ করা যাবে না।
তাহলে কি করবেন? প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করে দিবেন? বেশ কিছু দেশ ইতিমধ্যে প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য ব্যবহারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। কিন্তু তাহলে রাসায়নিক শিল্পের কি হবে? পরিবেশ নাকি শিল্প? উত্তর - দুটোই।
উপায় Recycle অর্থাৎ রাসায়নিক পদ্ধতি ব্যবহার করে একটি জিনিসকে পুনঃরায় ব্যবহার উপযোগী করে তোলা। কিন্তু অনেক প্লাস্টিক রিসাইকেল করলেও দাম কমে যায় তাই অনেকে করতে চায় না। কিন্তু ফ্রান্সের তুলুস ইউনিভার্সিটির গবেষক কম্পোস্ট করা পাতা থেকে একধরণের এনজাইম আবিষ্কার করেছেন যা একদিনেরও কম সময়ে পলিমার বা বড় জটিল আকারের কণাকেও ক্ষুদ্র করতে পারে। এটি জৈব ডিপলিমারাইজড প্লাস্টিকে রূপ নেয় যা থেকে প্লাস্টিকের বোতল তৈরি করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে কম খরচে রিসাইকেল করে নতুন পণ্য তৈরি করা সম্ভব। আবার জার্মানে ব্যবহৃত হচ্ছে বায়োপ্লাস্টিকের ব্যাগ। বায়োপ্লাস্টিক উদ্ভিদের পঁচে যায় এবং এটিকে মিশ্র সারের উপাদান হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এ ধরণের অনেক উন্নত দেশগুলোতে প্লাস্টিক রিসাইকেলে সফলতা এসেছে। আশা করছি খুব দ্রুত এ সফলতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে।
বাজারের পণ্য বাসায় নিয়ে আসা থেকে শুরু করে আইফোনের কভারেও প্লাস্টিকের প্রয়োজন হয়। মানুষের উন্নত জিবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছে প্লাস্টিক। তাই প্লাস্টিকের সঠিক ব্যবহার ও সঠিক রিসাইকেল পদ্ধতিই আমাদের কাম্য।