-->

মিনিয়েচার রাজ্য; যেখানে সব কিছু ছোট।


সানজিদা আক্তার,(রংপুর):
ছোট মেয়ে রিহানার ৪র্থ জন্মদিনে বাবা তাকে উপহার দিলেন একটা প্লাস্টিকের ডলহাউজ। বড় মেয়ে ১০ বছর বয়সী সুহানা ডলহাউজটা বেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলো। কী সুন্দর ছোট বিছানা, টেবিল, চেয়ার, খাবারের প্লেট,  গ্লাস এমনকি এইটুকু প্লাস্টিকের খাবার ও!
পরেরদিন বাবার পাশে বসে রিহানা তার ডলহাউজ নিয়ে খেলছিলো। এমন সময় সুহানা বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বললো: " আচ্ছা বাবা, একটা কথা বলতে পারো?"
বাবা পত্রিকা পড়ছিলেন, মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন: "হ্যাঁ মামনি বলো..."
সুহানা: " বাবা, রিহানার ডলহাউজটা কি সুন্দর! আচ্ছা, মানুষ ডলহাউজের এই ছোট জিনিসগুলো বানানোর বুদ্ধি কি করে পেলো?"

বড় মেয়ের এই প্রশ্নে বেশ অবাক হলো বাবা। বললো: "জানতে চাও? পাশে বসো চুপটি করে তাহলে বলছি।"
সুহানা কে বাবার পাশে বসতে দেখে রিহানাও ছুটে এসে বাবার কোলে বসে পড়লো।
একটা মুচকি হাসি দিয়ে বাবা শুরু করলেন : "এই যে ছোট ছোট সব জিনিসপত্র দেখছো, এগুলোকে আসলে বলা হয় মিনিয়েচার অর্থাৎ, ছোট আকৃতির শিল্প। এই শিল্পের বিভিন্ন অংশ আছে। যেমন: ছোট ছোট চিত্র, ছাপচিত্র, ভাস্কর্য কিংবা আলোকচিত্র। আমাদের উপমহাদেশে কিন্তু মিনিয়েচার শুরু হয় পাল আমলেই অর্থাৎ আরো ১২০০ বছর পূর্বে। তখন তারা বিভিন্ন পটে সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকত, যেগুলো হত অনেক ছোট। তবে পাল আমলের ৭০০ বছর পর মুঘল আমল শুরু হয়। এই মুঘল আমলের মিনিয়েচার গুলো ছিলো অন্যতম। তবে হ্যাঁ, সেসব কিন্তু এই ডলহাউজের মত বড় ছিল না। সেগুলো ছিল আরো অনেক ছোট। খালি চোখে দেখাই যেত না। এর জন্য ব্যবহার করা হতো আতশ কাঁচের।"
সুহানা: " আতশ কাঁচ! সেটা আবার কি?"
বাবা: "এটা এক ধরনের বিশেষ কাঁচ,যেটি দিয়ে দেখলে অনেক ছোট জিনিসকে বড় দেখায়।"
সুহানা: " ও আচ্ছা! মিনিয়েচার নিয়ে আরো কিছু বলো না শুনি।"
বাবা: " আচ্ছা বেশ! শোন তাহলে,  মুঘল সময়েই কিন্তু বাংলায় বিশাল বড় বড় আশ্চর্য দালান স্থাপনার নিদর্শন রয়েছে। তবে সেসময়ে মানুষ কিন্তু মিনিয়েচারেও বেশ নজর দিয়েছে। ইরানি, পার্সিয়ান, তুর্কি ও চীনা ঐতিহ্যের সাথে ভারতের হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ চিত্রকলার মিল ঘটিয়ে অপূর্ব ও অভিনব মুঘল মিনিয়েচার উদ্ভব হয়েছে এই আমলেই। তাই তো ১৬ শতক থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় মিনিয়েচার চিত্রের স্বর্ণযুগ।
এ তো গেলো মিনিয়েচার চিত্রের কথা, মিনিয়েচারের অন্যান্য শাখাগুলোও তো কম নয়। জানো? সাধারণ কাঠপেন্সিলের ডগায় খোদাই করে তৈরি করা যায় অভূতপূর্ব সব প্রতিকৃতি! যেগুলো মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার দীর্ঘ। ২-৩ সেন্টিমিটার কাঠ খোদাই করে বানানো হয় ভাষ্কর্য। এছাড়াও চাল, ধান, লাউয়ের বিচি এমনকি সর্ষে দানাও বাদ যায় নি মিনিয়েচার থেকে। এতটুকু দানার মাঝে কত সুন্দর নকশা আর ছবি এঁকেছে শিল্পীরা। আছে এক মিলিমিটার এর ও ছোট ক্যানভ্যাস। কয়েকশো পেজ সহ ছোট পিচ্চি বই কিংবা ধর্মগ্রন্থ ও। আতশ কাঁচের সাহায্যে এগুলো পড়েও ফেলতে পারো। জেনে অবাক হবে যে সুঁচ এর ডগার এইটুকু জায়গায় যেখানে সুতো পুরতেই সময় লেগে যায় সেখানে ও শিল্পীরা তৈরী করে ফেলেছে বিভিন্ন কার্টুন চরিত্র! মিনিয়েচার শিল্পকর্ম এতই জনপ্রিয় যে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন শিল্পী প্রতিদিনের ব্যবহার করা প্রায় সকল জিনিসের ই মিনিয়েচার বানিয়ে ফেলেছেন।

সুহানা: " তাহলে আমাদের দেশে এরকম শিল্পী নেই, বাবা?"

বাবা:" আছে তো, আমাদের দেশ ও মিনিয়েচার শিল্পে পিছিয়ে নেই। শিল্পী পলাশ উদ্দীন খলিফা আছেন যিনি আমাদের দেশের ঐতিহ্য কে তুলে ধরার জন্য বাংলার ইতিহাস নিয়ে মিনিয়েচার প্রদর্শনী করে আসছেন সেই ২০১১ সাল থেকেই। এছাড়াও এই লকডাউনের সময়ে ৯ জন শিল্পী মিলে  ৩রা জুলাই, ২০২০ থেকে শুরু করেছেন মিনিয়েচার প্রোজেক্ট। আবদুল্লাহ আল ওসামা নামের ঢাকার এক তরুণ আছে, যে তার করোনাকালীন ছুটির সময়টিকে কাজে লাগিয়েছে কল্পনার লাইব্রেরীর মিনিয়েচার বানিয়ে। অবাক করা সেই লাইব্রেরী তে শোভা পাচ্ছে অনেক রকম বই আর লাইব্রেরীর আসবাবপত্রের মিনিয়েচার। লাইব্রেরী খুবই নিখুঁত ভাবে সাজানো। তোমরা দেখলে বুঝতেই পারবেনা যে সেটি একটি মিনিয়েচার। এতটা নিখুঁত এবং ডিটেইলস গুলো চমৎকার। মনে হবে সব কিছু যেন কোন যাদুমন্ত্রে ছোট হয়ে গেছে!"

সুহানা: " তাহলে কি সব বড় জিনিসের ছোট ভার্সনই মিনিয়েচার?”

বাবা: " অবশ্যই, একটা স্বাভাবিক বস্তুকে ছোট করে বানালেই তাকে মিনিয়েচার বলা যায়। তবে বেখেয়ালে কোন ছোট  বাচ্চাকে আবার মিনিয়েচার বাবু বলে বসো না যেন! হাহাহা!"
মিনিয়েচার রাজ্য; যেখানে সব কিছু ছোট। মিনিয়েচার রাজ্য; যেখানে সব কিছু ছোট। Reviewed by সম্পাদক on রবিবার, জুলাই ১২, ২০২০ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.