-->

ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট; আপনি কি নিজেকে অতিজ্ঞানী ভাবেন?


জেবা সামিহা তমা,(রংপুর):
"ওহ ঐ অধ্যায়? আমি তো ঐ সম্পর্কে সব জানি। আরে আপনি কি বলছেন এসব? আমি বলছি আপনি শুনেন, আমি এই বিষয় সম্পর্কে সব জানি। আমিই ভালো বলতে পারবো অন্য কেউ নয়। আপনি কাজটা এভাবে করেন। আরে আমি এটা সম্পর্কে সব জানি। আমি ঠিক জানি, আপনি ভুল জানেন। " মাঝেমধ্যে আমাদের চারপাশের কিছু মানুষের কাছ থেকে এমন ধরণের কথা শোনা যায়। প্রথমে মনে হয় সে অনেক জ্ঞানী কিন্তু এমন ধরণের কথা বেশ কিছুক্ষণ শোনার পর আমাদের সেই মানুষগুলোর উপর বিরক্ত অনুভব হয়। মনে হয় কেনো তারা এমন করছে? 
তাদের এমনভাবে কথা বলার কারণ হলো ডানিং-ক্রুগার প্রভাব।

সাধারণভাবে বলতে গেলে ডানিং-ক্রুগার প্রভাব একটি মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। মনোবিজ্ঞানীর গবেষণায় ডানিং-ক্রুগার প্রভাব কে বলায় হয়েছে অলীক উচ্চতর বোধ (ILLUSORY SUPERIOR) বা জ্ঞানীয় পক্ষপাত। এই তত্ত্ব অনুসারে মানুষ নিজের বাস্তব ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে মানুষ তাদের যোগ্যতা গুলোকে মাত্রাতিরিক্ত মূল্যায়ন করে অর্থাৎ একজন মানুষ একটি বিষয় নিয়ে যতটুকু জানে তার থেকেও বেশি প্রকাশ করার চেষ্টা করে। এমনও হয় একজন ব্যক্তির একটি বিষয় নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞান রয়েছে কিন্তু তার জ্ঞান বহিঃপ্রকাশের ধরণ ভুল, তাহলেও এটাকে ডানিং-ক্রুগার প্রভাব বলা যায়। সবশেষে ডানিং-ক্রুগার এর সংজ্ঞা দাঁড়ায় একজন অজ্ঞ ব্যক্তির অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ এবং জ্ঞানি ব্যক্তির জ্ঞানের ভুল প্রকাশ। ডানিং-ক্রুগার প্রভাবে থাকা মানুষ তার নিজস্ব বিশ্বাসে বন্দী থাকে। অর্থাৎ সে বিশ্বাস করে - তার যে ধারণা রয়েছে সেটিই সঠিক বাকি সব ভুল। মেটাকগনিশন অর্থাৎ চিন্তা শক্তির অভাব বা সঠিক চিন্তা করার অক্ষমতার কারণে তারা তাদের দক্ষতার পরিমাপ বা জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে জানতে পারে না; যেকারণেই তারা ডানিং-ক্রুগার প্রভাবে থাকে। ডানিং-ক্রুগার প্রভাব তত্ত্বে এও বলা হয়েছে জ্ঞানীরা সাধারণত চুপচাপ থাকে আর অজ্ঞরা নিজেদের জ্ঞান বেশি করে প্রকাশ করতে চায় বা করে। ডানিং-ক্রুগার প্রভাব মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আগে বা আবিষ্কৃত হওয়ার অনেক আগে থেকেই বিখ্যাত মনিষীরা এ সম্পর্কে অনেক উক্তি প্রদান রয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় মানবসভ্যতার শুরু থেকে ডানিং-ক্রুগার প্রভাব সমস্যা রয়েছে।

১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গ শহরে ম্যাকআর্থার হুইলার নামে একজন ব্যক্তি দিনের বেলায় কোনো অস্ত্র এবং কোনো মুখোশ না পরেই ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়েছিলেন। একজন ডাকাত বা একজন চোর নিজেকে ধরা পড়া থেকে রক্ষা করতে যে নিরাপত্তাটুকু নেয় হুইলার তা নেননি। বরং একজন সম্পূর্ণ সাধারণ ভাবে ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়েছিলেন। প্রথম ব্যাংক সফলভাবে লুট করার পর হুইলার যখন দ্বিতীয় ব্যাংক ডাকাতি করছিলো তখনই সে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যায় এবং এই ধরা পড়ার ঘটনায় ম্যাকআর্থার হুইলার অনেকটা বিস্মিত হয়ে যায় এবং সে বলে - " আমি তো আমার সম্পূর্ণ শরীরে লেবুর রস মেখেছিলাম। " হুইলারের বিশ্বাস যদি শরীরে লেবুর রস মাখা হয় তাহলে সে অদৃশ্য হয়ে যাবে এবং তাকে সিসি ক্যামেরায়ও দেখা যাবে না। তাই পুলিশ কিভাবে তাকে গ্রেফতার করলো সেটা নিয়েই হুইলার অনেক অবাক হয়েছে। এরপর পুলিশ হুইলারকে তার সিসি ক্যামেরার ডাকাতি করার ফুটেজটি দেখানো হলে হুইলার দৃঢ়তার সাথে সেটিকে মিথ্যা বলে। কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিভ ডানিং এই ঘটনাটি সংবাদপত্রে পড়ে বেশ আশ্চর্য হয় এবং এই বিষয়টি গবেষণা করা শুরু করে দেন। সেসময় তার এই গবেষণার সঙ্গী হয়েছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর গবেষণায় থাকা জাস্টিন ক্রুগার। প্রথমে তারা এই গবেষণার নাম দেন অদক্ষ ও অসচেতন সমস্যা ( Unskilled & Unaware Problem). পরে ডেভিভ ডানিং এর নাম দেন Anosognosia of Everyday Life. তবে গবেষণার ফল প্রকাশিত হওয়ার পরে তারা এটির নাম দেন Unskill & Unaware of it এবং এই নামেই এটি ব্যাপক প্রচারিত হয়েছিলো। এরপর ২০০০ সালে এই গবেষণার কারণে ডেভিভ ডানিং ও জাস্টিন ক্রুগার ইগ নোবেল পুরস্কার (IG Noble Prize) পান। 

১৯৯৯ সালে ডেভিভ ডানিং ও জাস্টিন ক্রুগার কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর উপর একটি গবেষণা করেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের একটি বিষয়ের উপর পরীক্ষা নেয়া হয়েছিলো। পরীক্ষার পরে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো - তাদের পরীক্ষার ফলাফল কিরকম আসতে পারে বা কত নাম্বার পেতে পারে। যেসকল শিক্ষার্থী বলেছিলো তারা বেশি নাম্বার পাবে তারা কম নাম্বার কম নাম্বার পেয়েছে এবং যারা বলেছিলো তারা কম নাম্বার পাবে তারাই সবচেয়ে বেশি নাম্বার পেয়েছিলো। এই প্রভাব শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে নয় বরং সব ক্ষেত্রেই বিদ্যমান। 

ডানিং-ক্রুগার প্রভাবে থাকা মোটেই উচিত নয়। ব্যক্তিজীবনে বা কর্মজীবনে ডানিং-ক্রুগার প্রভাবে নেতিবাচক বাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই যারা বুঝতে পারছেন আপনি নিজে বা আপনার পরিচিত কেউ ডানিং-ক্রুগার প্রভাবে রয়েছেন তাহলে উচিত হবে তাকে এই প্রভাব থেকে বের করে আনা। যদি কেউ আপনার সমালোচনা করেন তাহলে তাকে করতে দিন। আপনার কাজ হবে সেই সমালোচনা থেকে ভুল গুলো খুঁজে বের করা এবং শুধরে যাওয়া। প্রতিদিন না হলেও প্রায়ই নিজের কাজ গুলো নিয়ে ভাবুন। নিজে নিজের সমালোচনা করুন। আপনাকে সবসময় এটা বুঝতে হবে একটা সাধারণ সবসময় ঠিক হতে পারে না তাই নিজের ভুল গুলো খুঁজে শুধানোর চেষ্টা করা মানুষ হিসেবে বাধ্যতামূলক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে হবে। যার জ্ঞান যত কম তার পৃথিবী ততই ছোট। আমাদের নিজেদের জ্ঞানই শেষ এমনটা নয়। ৪৫৪ কোটি বছর যে পৃথিবী তৈরি হয়েছে নিঃসন্দেহে সেখানে জ্ঞানের পরিমাণ অগাধ। একটি বিষয় সম্পর্কে একজন মানুষ হয়ে যতটুকু জানি তার বাহিরেও সেই বিষয় সম্পর্কে অনেক কিছু জানার রয়েছে। জানার সীমা পরিসীমা নেই। তাই আমরা যা জানি তা নিয়ে কখনোই বড়াই করবো না বরং নতি স্বীকার করে আরও বেশি জানতে চাইতে। আপনার নিজের সম্পর্কে সম্পূর্ণ পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে। বাস্তবের সাথে নিজের দক্ষতা আর জ্ঞানের পরিধি নিজেদের জানতে হবে। যেহেতু সঠিক চিন্তা শক্তির অভাবে ডানিং-ক্রুগার প্রভাব মানুষের মধ্যে দেখা দেয় সেহেতু মানুষের উচিত হবে অবশ্যই অবশ্যই নিজের চিন্তা শক্তি বৃদ্ধি। 

ডানিং-ক্রুগার প্রভাব একটি মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা মাত্র। অন্যের কাছের উপহাসের বস্তু হিসেবে বিবেচিত হওয়ার আগে সামান্য কিছু পন্থা অবলম্বন করেই মনস্তাত্ত্বিক এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। সঠিক ও প্রচুর জ্ঞান অর্জনে মানব জীবন হোক ধন্য।
ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট; আপনি কি নিজেকে অতিজ্ঞানী ভাবেন? ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট; আপনি কি নিজেকে অতিজ্ঞানী ভাবেন? Reviewed by সম্পাদক on বৃহস্পতিবার, জুলাই ২৩, ২০২০ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.