জেবা সামিহা তমা,(রংপুর):
আমরা ছোট বেলা থেকে অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে সবচেয়ে জনপ্রিয় যে অপরাধটা করি তা হলো পরীক্ষায় অন্যের দেখে নিজের খাতায় লেখা। যা এক প্রকার নকল এবং ইংরেজিতে একে বলা হয় Copy ।
নিজেদের উন্নতি বা সুনামের জন্যে অন্যের মেধাশক্তি দিয়ে তৈরি কাজ কে নিজের বলে চালিয়ে দেই যা অনেক বড় একটা অপরাধ। পৃথিবীতে এমনও অনেক দেশ রয়েছে যেখানে নকল করা ধর্মীয় পাপ সমতুল্য মনে করা হয়। যদিও মানুষ ভেদে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস আলাদা তবুও এতটুকু আন্দাজ তো পাওয়াই যায় যে নকল করা কত বড় অপরাধ।
১ বছর আগে জনপ্রিয় মাসুদ রানা সিরিজের জনক নিয়ে ঝামেলা তৈরি হয়। এরপর গত ১৪ই জুন বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস এই নিয়ে শেখ আব্দুল হাকিমের পক্ষে রায় দেন। মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০ টি বই ও কুয়াশা সিরিজের ৫০ টি বইয়ের স্বত্ব পাবেন শেখ আব্দুল হাকিম যদিও এই সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়া এখনো চলমান। শেখ আব্দুল হাকিম কপিরাইট আইনের বলে এই লড়াইয়ে জয়ী হয়েছেন। তো চলুন জেনে আসি কপিরাইট ও কপিরাইট আইন নিয়ে।
পাঠ্য বই থেকে জানা যায় - " লেখক বা শিল্পী কর্তৃক তার সৃষ্টকর্মের ওপর একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে স্থায়ী আইনগত অধিকারকে কপিরাইট বলে। " কপিরাইটের উদ্দেশ্য হলো নকল করা থেকে প্রকৃত লেখক, শিল্পী বা সৃষ্টকর্মের স্বত্বাধিকারী স্বার্থ সুরক্ষা করা ; যা না করা হলে এর স্বত্বাধিকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেধাভিত্তিক কাজগুলোর জন্যে কপিরাইট প্রযোজ্য হয়। যেমন - বই, প্রবন্ধ, নাটক, গান, অডিও, ভিডিও, সাউন্ড, নকশা, ছবি, স্থাপত্য শিল্পকর্ম ও সফটওয়্যার এসবে কপিরাইটের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ যে কাজ গুলোতে মানসিক শ্রম বা মেধা দিয়ে থাকি সেগুলোর স্বত্বাধিকার রক্ষা করে কপিরাইট।
আঠারো শতকের আগেও পৃথিবীতে মেধাভিত্তিক কাজের স্বত্বার গুরুত্ব পাওয়া যায়নি। আঠারো শতকের শুরুর দিকে ছাপাখানা গুলো একচেটিয়া ব্যবসা শুরু করেন এবং বইগুলোর অনৈতিক অনুলিপি তৈরি করেন। ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস যখন এসব সম্পর্কে অবহিত হন তখন রাজকীয় বিশেষাধিকারের মাধ্যমে আইন তৈরি করেন। অর্থাৎ বৃটেনে প্রথম কপিরাইট আইনের জন্ম হয়। রাজা দ্বিতীয় চার্লস ১৬৬২ সালে The Press Act নামে আইন তৈরি করেন যার কারণে অনুমোদনপ্রাপ্ত বইগুলোর একটি নিবন্ধন তালিকা করা হয় এবং এই তালিকাটির একটি করে অনুলিপি সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে জমা রাখতে হয়। এরপর ১৭১০ সালে লেখকসহ বিভিন্ন শিল্পকর্মের মালিকদের বা শিল্পীদের তাদের কাজের উপর ব্যক্তিগত অধিকার সংরক্ষণের জন্যে The British Statute of Anne 1710 নামে একটি আইন পাস করা হয়। এই আইন পাসের ফলে লেখকদের পাশাপাশি বই প্রকাশকদের একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে অধিকার সংরক্ষণের সুযোগ তৈরি হয় এবং লেখক বা শিল্পকর্মের মালিক তার অধিকার অন্যের নিকট হস্তান্তর বা বিক্রয় করার বৈধ উপায় পেয়ে যায়। ১৭১০ সালের বৃটেনের তৈরি এই আইনকে বর্তমান কপিরাইট আইনের ভিত্তি বলে ধরা হয়।
১৮৮৬ সালে সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে বার্ন আন্তর্জাতিক সমঝোতা হয় যেখানে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোকে মেধাস্বত্বের স্বীকৃতি দেয়া হয়। এই সমঝোতা অনুসারে যখন মেধাস্বত্ব দ্বারা কিছু তৈরি করা হবে তখনই তৈরিকৃত সম্পদের মালিকানা তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান বা মানুষ পেয়ে যাবেন। অর্থাৎ মালিকানা পাওয়ার জন্যে অতিরিক্ত কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণ করার প্রয়োজন নেই। মালিকানা এই মালিকানা ততক্ষণ পর্যন্ত কার্যকর হবে যতক্ষণ মালিক তার মালিকানা হস্তান্তর বা বিক্রয় না করে। বিদেশি লেখকদের ক্ষেত্রেও একই বহাল রাখা হয় এই সমঝোতায়
বার্ন আন্তর্জাতিক সমঝোতার বিধিমালা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সাথে চুক্তির মাধ্যমে সারাবিশ্বে এটি ছড়িয়ে দেয়।
বার্ন সমঝোতার পরে ১৯৫২ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় Universal Copyright Convention নামে কপিরাইট সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি করা হয়। বাংলাদেশ এই সমঝোতায় সাক্ষরকারী একটি দেশ।
এখন বাংলাদেশে ২০০০ সালের কপিরাইট আইন ( ২০০৫ সালের সংশোধনীসমেত) ও কপিরাইট বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী এ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।
কপিরাইট আইন ভঙ্গ করা হলে অপরাধের শিকার হওয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইনের দ্বারস্থ হওয়ার পর ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে দুইভাবে এর প্রতিকার করা যায় অর্থাৎ দুটি বিধান রয়েছে।
প্রথমত দেওয়ানি প্রতিকার দ্বিতীয় ফৌজদারি প্রতিকার।
দেওয়ানি প্রতিকারের মতে কপিরাইট ভঙ্গ করা হলে আসল মালিক সমস্ত মালিকানা ও ক্ষতিপূরণ পাবেন। তবে বিবাদী যদি প্রমাণ করতে পারেন তিনি অবগত ছিলেন না বা কপিরাইট বিদ্যমান ছিলো না তখন আদালত কিছুটা নমনীয় হন।
ফৌজদারি প্রতিকার মতে যে ব্যক্তি চলচিত্র ব্যতিরেকে কোনো কাজের কপিরাইট ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করেন বা করতে সহায়তা করেন সেক্ষেত্রে প্রথম লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাসের কারাদণ্ড ও সর্বনিম্ন ৫০০০০ টাকা সর্বোচ্চ ২ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে দ্বিতীয় বা পরবর্তীতে কপিরাইট আইন ভঙ্গ করলে প্রতিবার সর্বোচ্চ ৩ বছর ও সর্বনিম্ন ৬ মাসের কারাদণ্ডে এবং সর্বোচ্চ ৩ লক্ষ ও সর্বনিম্ন ১ লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এমন কিছু করা হলে সেক্ষেত্রে আদালত কিছুটা নমনীয় হতে পারেন।
প্রযুক্তির যুগে মানব সভ্যতা যতটা উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে, পথভ্রষ্ট মানুষের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। মানুষের বিবেক ও আইনের সঠিক প্রয়োগই এসব অন্যায় অপরাধ নির্মূল করতে পারে।
কপিরাইটের বিস্তারিত।
Reviewed by সম্পাদক
on
বুধবার, জুলাই ০৮, ২০২০
Rating: