সানজিদা আক্তার(রংপুর):
এক দেশে ছিল এক জাদুকর। তার ছিল একটা একটা জাদুর পেন্সিল। সেই পেন্সিল দিয়ে সে যা আঁকত তাই জীবন্ত হয়ে উঠত। তারপর একদিন হলো কি, আচ্ছা থাক আরেকদিন বলবো। এ তো গেল রূপকথা কিন্তু তোমরা কী জানো, পেন্সিল আসলে কিভাবে আমাদের হাতে এলো!
বলছি তাহলে, সময়টা ১৫৫০ এর দশক, ইংল্যান্ডের রাখালরা খেয়াল করলো যেগাছে নিচে অনেকগুলো কালো ছাই রয়েছে। সেগুলো উড়ে যায় না বা পুড়ে না। এগুলো আসলে ছিল গ্রাফাইট। তাই তারা এই অজানা ছাই বা গ্রাফাইট ব্যাবহার করতো ভেড়ার গায়ে দাগ কেটে ভেড়া চিহ্নিত করতে। সেসময় বোরোডেল অঞ্চলে বিশাল গ্রাফাইটের খনি আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু তখন গ্রাফাইটের ব্যবহার ছিল সীমিত। এক সময় দেখা গেল, লেডের চেয়ে গ্রাফাইট অনেক গাঢ় ও স্থায়ী দাগ কাটতে পারে, তাই লেখালেখির কাজে এটি ব্যবহার শুরু করলো মানুষ। তখন কিন্তু হাতে ধরে লিখবার জন্য কাঠ বা অন্য কেস ছিলো না বরং সরাসরি গ্রাফাইট এর দন্ড হাতে ধরে বা সুতা পেঁচিয়ে লেখা হত।
ইংরেজি 'পেন্সিল' শব্দটি প্রাচীণ ফারসি ভাষার 'পিন্সেল' অথবা ল্যাটিন শব্দ 'পেনিসিলাস' থেকে এসেছে। যার আক্ষরিক অর্থ 'ছোট লেজ'। এই নামকরণের পেছনে অবশ্য একটি কারণ আছে। সেই যুগে তো লেখার বা ছবি আঁকার কোন বস্তু ছিল না। তাই ব্রাশ হিসেবে উটের চুল বা লেজের অংশ ব্যবহার করা হত। ধারণা করা হয়, লেখার জন্য সেই পদ্ধতি স্মরণ করেই নামকরণ করা হয়েছিলো পেন্সিলের।
বর্তমানের পেন্সিল প্রাচীণ রোমানে 'স্টাইলাস' নামক লেখনী বস্তু হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৫৬০- ৬৫ সালের সময়েই ইতালিয়ান এক দম্পত্তি প্রথম পেন্সিলের নীলনকশা বানান। তারা হাতে ধরার সুবিধার্তে দুটি কাঠের মাঝে গ্রাফাইটের দন্ড রেখে আঠা লাগিয়ে দেন।
কিন্তু আধুনিক পেন্সিলের যাত্রা শুরু হয় একটু অন্যভাবে। ১৭৯০ সাল থেকে ইংল্যান্ডে পেন্সিল ব্যবহার শুরু হয়। বোরোডেলের সেই কয়লার খনির কথা বলেছিলাম না! সেখান থেকে তখন গ্রাফাইট ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যেতে থাকে। ১৭৯৩ সালে যখন ফ্রান্সের সাথে ব্রিটেন ও ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয় তখন সময়টা ছিল নেপোলিয়নের। ঠিক সেসময়টাতেই ইংল্যান্ডের পেন্সিলের বাজারে ধস নামতে শুরু করে। কিন্তু এই যুদ্ধের শেষের দিকে ইংল্যান্ড ফ্রান্সের উপর একটি বোঝা চাপিয়ে দেয়। তা হলো ইংল্যান্ড ফ্রান্স থেকে পেন্সিল আমদানি করবে এবং সে বাজারে ইংল্যান্ড ই হবে মূখ্য। ফলে কিছুদিনেই ফ্রান্স পেন্সিল ও গ্রাফাইট সংকটে পড়ে যায়।
এমন সময়ে এ সংকট নিরসনের জন্য ফ্রান্স দায়িত্ব দেয় তার যুদ্ধমন্ত্রী জ্যাকুইস কোন্ট কে। অর্থাৎ তাকে এমন একটি সমাধান করতে হবে যাতে ফ্রান্স গ্রাফাইট ও পেন্সিলের এই সমস্যা থেকে মুক্তি পায়। কোন্ট কিন্তু এর সমাধান বের করেছিলেন। তিনি মাটি থেকে প্রাপ্ত গ্রাফাইট ও কাদামাটি মিশিয়ে আগুলে তাপ দিয়ে মাত্র আট দিনে তৈরী করেছিলেন একটি অভিনব পেন্সিল। যেটিতে পেন্সিলের রঙের ঘনত্ব তিনি নিজেই নিয়ন্ত্রন করতে পারেন। অর্থাৎ চাইলেই তিনি এটির কালির রং হালকা বা গাঢ় করতে পারেন। কোন্টের বানানো এই ফর্মূলাই ১৮০২ সালে কোহিনূর কোম্পানি কিনে নেয় এবং এটি হয়ে ওঠে বিশ্বের আদর্শ ফর্মূলা। এরপর ১৮৪৭ সালে দ্যা জোসেফ ডিক্সন কোম্পানি আমেরিকায় বড়সড় একটি পেন্সিল কারখানা স্থাপন করে যেখানে যন্ত্রের সাহায্যে প্রতি মিনিটে ১৩২ টি পেন্সিল উৎপাদন করা যেত।
তোমরা যে রাবার লাগানো পেন্সিল ব্যবহার করো, সেটি কিন্তু এত আগে তৈরী হয় নি। ১৮৫৮ সালে হাইমেন লিপম্যান নামের এক ভদ্রলোক পেন্সিলের পেছনে একটুকরো রাবার বসিয়ে দেন। জেনে অবাক হবে, চার বছর পর অর্থাৎ ১৮৬২ সালে সেই রাবার জুড়ে দেয়া পেন্সিলটি এক লক্ষ ডলারে বিক্রি হয়!
পেন্সিলের জন্মলগ্ন থেকেই যে আমরা একই রকম পেন্সিল ব্যবহার করে আসছি তা কিন্তু নয়। গত ৫০০ বছরে পেন্সিলে এসেছে বিশাল পরিবর্তন। বাজারে এসেছে হরেক রকম পেন্সিল। জানা যায়, পুরো বিশ্বজুড়ে ১৫ রকম পেন্সিল সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। বিশ শতক বা উনিশশো সালের পরে জাপানিরা নিয়ে এসেছে সেরা মানের পেন্সিল। ফিনিশিং, কাঠের ফ্রেম, চকচকে আবরণ, মনকাড়া ডিজাইন, ১৪ ধাপে রঙিন নকশা ইত্যাদি শৈল্পিক দিকগুলো প্রাধান্য পেয়েছে। আমরা সাধারণত পড়াশুনায় বা স্কেচে যে পেন্সিল ব্যবহার করি, সেটি আসলে গ্রাফাইট পেন্সিল, এছাড়াও স্কেচের জন্য শুধু গ্রাফাইট দিয়ে তৈরী পেন্সিল ও আছে। তোমরা সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকে যে পেন্সিল দিয়ে রং করো, সেটি রংপেন্সিল আর পানিতে মেশানো যায় এমন পেন্সিলগুলির নাম জলরং পেন্সিল। কাঠের কাজ করার জন্য রয়েছে কাঠমিস্ত্রী পেন্সিল। কাঠকয়লা ও গ্রাফাইট মিশিয়ে বানানো হয় কার্বন পেন্সিল, এটিও স্কেচে ব্যবহার করে শিল্পীরা। স্কেচের জন্য আরো এক প্রকার বিশেষ পেন্সিল আছে যার নাম কাঠকয়লা পেন্সিল। শুধু তা নয় ছোটদের জন্য আলাদা করে বানানো হয়েছে প্লাস্টিক পেন্সিল, যেটি তুমি চাইলে বাঁকিয়েও ফেলতে পারো। এই প্লাস্টিক পেন্সিলটি ১৯৬০ সালে তৈরী করেন গ্রসম্যান। এরপর কিন্তু থেমে থাকেনি পেন্সিলের পরিবর্তনের যাত্রা। পেন্সিল তৈরী কোম্পানি গুলো বিভিন্ন সময়ে নিয়ে এসেছে নিত্য নতুন ডিজাইন বা কার্টুনের প্লাস্টিকে মোড়ানো পেন্সিল। এছাড়া তাতে জুড়ে দিয়েছে খেলনা, পুতুল এমনকি টর্চ লাইট ও। এসেছে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত পেন্সিল, যেটি চোখা করার দরকার পরেনা। একটি শেষ হয়ে গেলে আরেকটি শিষ ব্যবহার করা যায়। মানুষ যত উন্নত হয়েছে তত স্বয়ংক্রিয় মেশিন তৈরী করেছে, এ থেকেও বাদ যায় নি পেন্সিল। স্বয়ংক্রিয় পেন্সিল ও এসেছে বাজারে! যেটি নিজেই চোখা হয়ে যেতে পারে। শার্পনারের প্রয়োজন ই পড়েনা।
আচ্ছা, তোমরা কি জানো? বর্তমানে ব্যবহৃত কাজল ও একটি পেন্সিল! কিন্তু এই কাজলের পেন্সিল আমরা চোখের নিচে বা উপরে, টিপ হিসেবে কিংবা বাচ্চাদের নজর এড়াতে ব্যবহার করি।
এরপর যুগের সাথে তাল মিলিয়ে হয়তো পেন্সিলে আসবে আরো ভিন্ন ভিন্ন রূপ। হয়ত আমাদের কথার সাথে কিংবা চিন্তার সাথে পেন্সিল নিজেই এঁকে বা লিখে ফেলবে সব। কিন্তু এখনো পর্যন্ত লিখতে, আঁকিবুঁকির খাতায় কিংবা বড় বড় নির্মাণ নকশা তে পেন্সিল আমাদের চাই ই চাই।