-->

গণিতশাস্ত্রের আদ্যোপান্ত।


জেবা সামিহা তমা,(রংপুর):
ছোট বেলা থেকে আমাদের অনেকেরই ভীষণ প্রিয় নাহয় ভীষণ অপ্রিয় বিষয় গণিত। আমি জানিনা কেনো আমার সবচেয়ে অপ্রিয় বিষয় ছিলো গণিত এবং আমি এই বিষয়ে ভালো করতেই পারতাম না। নবম শ্রেণিতে অনেক কষ্টে সাধারণ গণিত থেকে ছুটি পেলেও উচ্চমাধ্যমিকের পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্যে গণিত আবশ্যক হয়ে উঠলো। বাধ্য হয়ে আমি আবার গণিত পড়া শুরু করলাম। হঠাৎ একটা কঠিন সমস্যা সমাধানে বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন জাগলো এই গণিতের আবিষ্কারক কে? কেনোই বা এই গণিত আবিষ্কার করলো? উত্তর খুঁজতেই পেয়ে গেলাম। আপনারাও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন কি না তাই ভাবলাম আপনাদেরও জানিয়ে দেই এই উত্তর। 

গণিত হলো পরিমাণ, সংগঠন পরিবর্তন ও স্থান বিষয়ক গবেষণা। বিশৃঙ্খল ও জটিল সংখ্যার সমস্যার সমাধান করা হয় গণিতে। গণিতের আরেকটা নাম আছে তা হলো ' বিজ্ঞানের ভাষা '। এই নামকরণের কারণ হলো গণিতের সার্বজনীন ভাষা ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা একে অপরের সাথে ধারণার আদান-প্রদান করে। পৃথিবীর নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলে গণিতের প্রথম সূত্রপাত ঘটে তা বলা মুশকিল কারণ আমরা ইতিহাসের যত গভীরে যেতে থাকি ইতিহাসের সাক্ষ্য-প্রমাণ তত কমতে থাকে।
অনেকের মতে খ্রিস্ট-পূর্ব ৫৫০০ এর সময়ে দক্ষিণ ইরানের একটি অংশ যার তৎকালীন নাম ছিলো মেসপোটমিয়া, সেই স্থানে প্রথম গণিতের জন্ম হয়। ধরা হয় মেসপোটমিয়ার বাসিন্দা যাদের আমরা প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার মানুষ বলে জানি তারা পৃথিবীর প্রথম সংগঠিত ও শহুরে বসবাসকারী মানব সম্প্রদায় সুমেরীয়রা তাদের দৈনন্দিন ক্রয়-বিক্রয়ের প্রয়োজনীয়তা থেকে প্রথম গণনা শুরু করে। নিজেদের আদান-প্রদানের স্বার্থে তৈরি করেন মাটির তৈরি টোকেন যা দেখতে অনেকটা পেরেকের মতো ছিলো।এরপর ধীরেধীরে মিশর, ব্যাবিলন, চীন ও ভারত। এবং পূর্ণতা লাভ করে আজকের গণিত। যদিও গণিত ইতিহাসে এর প্রমাণ খুব একটা চোখে পড়ে না। 

কিছু পণ্ডিতদের মতে পৃথিবীতে ৩৪০০ খ্রিস্ট-পূর্বে মিশরে প্রথম গণিতের অস্তিত্ব পাওয়া যায় আবার কিছু পণ্ডিতদের মতে ৩০০০ খ্রিস্ট-পূর্বে ব্যবলিনে প্রথম গণিত জন্ম নেয়। দুই ধরণের মতামতের ব্যাখ্যা করছি-
১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত ' আহমেস প্যাপিরাস ' এর অর্থ উদঘাটন করা হয় তখনই জানা যায় এটি মিশরের সবচেয়ে পুরাতন গণিত গ্রন্থ তবে এটি মূল গ্রন্থ নয়। আনুমানিক ১৬০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে মিশরে হিকোকাস রাজত্বকালে ' ফারাও আ-আসরে ' এর সময় আহমেস নামে জৈনিক পুরোহিত কোনো গ্রন্থ বা প্যাপিরাস থেকে সঙ্কলন করেন। এখন কিছু পণ্ডিতদের মতে এটির মূল গ্রন্থ খ্রিস্ট-পূর্ব ১৮৪৯ থেকে ১৮০১ এর মধ্যে রচিত হয়েছিলো আবার কিছু পণ্ডিতদের মতে এটির মূল গ্রন্থ ৩৪০০ খ্রিস্ট-পূর্বে রচিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো একটি মতামত পাওয়া যায়নি। 
এদিকে ব্যাবিলনের অবস্থিত মানুষগুলো কাদামাটিকে চাকতির রূপ দিয়ে সেটাতে শলার সাহায্যে কিছু লিখে তা শুকিয়ে, পুড়িতে সংরক্ষণ করতো। মূলত লেখাগুলো ছিলো কিউনিফরম লিপির। পরবর্তীতে অসুরবনিপালের ( অসুরবনিপালের মৃত্যু হয়েছে ৬২৬ খ্রিস্ট-পূর্বে ) গ্রন্থাগার ও নিপপুর মন্দির খনন করে ২২০০০ ও ৫০০০০ চাকতি পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে এই চাকতিগুলো লেখা হয়েছে ৩০০০ থেকে ৪৫০ খ্রিস্ট-পূর্বে। উদ্ধারকৃত চাকতিগুলোর মধ্য থেকে যেই গণিত সংক্রান্ত চাকতিগুলো পাওয়া যায় সেইগুলোর অস্তিত্ব ছিলো ২০০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্ট-পূর্ব পর্যন্ত। এবং এই গবেষণার ভিত্তিতে বলা হয় প্রাচীন ব্যবলিন ৮০০ বছর গণিত চর্চায় প্রসিদ্ধ ছিলো। 
বলে রাখি কিউনিফরম সুমেরীয় সভ্যতার তৈরি লিপি এবং ব্যাবিলন সভ্যতা শুরু হওয়ার সাথে শেষ হয়ে যায় সুমেরীয় সভ্যতা। 
বিশেষজ্ঞরা নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন যে আজকের গণিত শাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও অসামান্য অবদান রয়েছে ভারতীয় গণিতবিদের। ধারণা করা হয় মেসপোটমিয়া থেকে ভারত এবং ভারত থেকে আরবে গণিত পৌছায়। ভারতীয়রা গণিতবিদেরা মিশরের সামান্য সৌন্দর্যের প্রতীককে পুরো বিশ্বের কাছে শূন্য নামে পরিচিত করেন যে শূন্য আজ সকল সংখ্যার ভিত্তি এবং যাকে ছাড়া বীজগণিতের সমীকরণ সম্ভব নয়। সর্বপ্রথম পৃথিবীর ব্যাস নির্ণয়ও তারাই করেন। 

ব্যবসা বাণিজ্যের জন্যে গ্রীসের সাথে মিশর ও ব্যবিলনের যোগাযোগ ছিলো এবং সেজন্যে পীথাগোরাস গ্রীস থেকে মিশরে যান পড়াশোনা করতে। মিশরীয়দের দালান ও অট্টালিকা তৈরি এবং তাদের প্রযুক্তি ও গণিতের জ্ঞান দেখে গণিতকে ভালোবেসে ফেলেন পীথাগোরাস। এরপর তিনি গ্রীসে এসে নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে শুরু করেন গণিত চর্চা। 
পীথাগোরাস মনে করতেন পৃথিবীর সব লুকায়িত সৌন্দর্যে রয়েছে সংখ্যা। তিনি লক্ষ্য করলেন দুটি আলাদা বস্তুর ওজন যদি কাছাকাছি কোনো পূর্ণ সংখ্যার অনুপাত হয় তাহলে তাদের আঘাত করলে সাদৃশ্যপূর্ণ আওয়াজ হয়। অর্থাৎ সঙ্গীতের মাধুর্যপূর্ণ ধ্বনির মিলনের পিছনেও রয়েছে সংখ্যার অপূর্ব বিন্যাস। জোড়-বিজোড় ও সংখ্যার লিঙ্গ নির্ধারণ ( যেমন ১ পুরুষ সংখ্যা, ২ নারী সংখ্যা ) আবিষ্কার করেন পীথাগোরাস। এই পীথাগোরাসের উপপাদ্য ছাড়া বর্তমানে আমাদের দেশে অষ্টম উত্তীর্ণ করা অসম্ভব। 
পীথাগোরাস গ্রীসে সংখ্যা এত জনপ্রিয় করেন যে গ্রীকরা ১ কে দেবতা হিসেবে গ্রহণ করেন। 
পীথাগোরাসের মৃত্যুর ২০০ বছর পর গ্রীসে জন্ম নেয় প্রাচীন যুগের প্রখর গণিতবিদ আর্কিমিডিস। ইনি প্রথম প্রমাণ করে বৃত্তের ক্ষেত্রফল তার ব্যাসার্ধের বর্গ পাইয়ের গুনফলের সমান। এছাড়াও আধুনিক ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাসে ব্যবহৃত অতি ক্ষুদ্র সংখ্যার ধারণা ও অতি বৃহৎ সংখ্যাকে ছোট আকারে প্রকাশ করার পদ্ধতি  আর্কিমিডিসই দিয়েছেন। আর্কিমিডিসের মৃত্যুর পরে রোমনরা ক্ষমতায় এসে গ্রিকদের উদ্ভাবিত গাণিতিক পদ্ধতি পুরোদমে ব্যবহার করে গণিত শাস্ত্রকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। 

আনুমানিক ৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয়রা ইরাকে পাড়ি দেয়ার মাধ্যমে আরবে গণিত পৌছায়। সেসময়ের মনিষীদের জ্ঞান চর্চার প্রধান কেন্দ্র ছিলো ইরাকের রাজধানী বাগদাদ। দূর-দুরান্ত থেকে বিজ্ঞানী পাড়ি জমাতেন সেখানে শুধু জ্ঞান চর্চার জন্যে। এভাবে ইরাকে আসেন আধুনিক বীজ গণিতের জনক আল খোয়ারিজমি যার জন্মস্থান নিয়ে রয়েছেন মতভেদ। যিনি গুন ভাগের সহজ প্রক্রিয়া অ্যালগরিদম আবিষ্কার করেন এবং সেই অ্যালগরিদমের ফর্মূলার উপর দাঁড়িয়ে গোটা ডিজিটাল বিশ্ব। 

বাণিজ্যের কারণেই আরব থেকে আফ্রিকা মহাদেশে যায় গণিত। ১১০০ সালের শেষের দিকে ইতালি বংশোদ্ভূত আলজেরিয়ান নাগরিক তরুণ গণিতবিদ ফিবোনাচ্চি ইউরোপ মহাদেশে শূন্য এর পরিচয় করিয়ে দেন। ফিবোনাচ্চি ১২০০ সালে ইতালিতে ' লিবার আবাচি ' যার ইংরেজি নাম The book of calculation এর দ্বারা আল খেয়ারিজমীর বীজগণিত ইউরোপে নিয়ে আসেন।
এরপর আর গণিতকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। 
সপ্তদশ শতকে গটফ্রিড ভেলহেন্ম নামে জার্মানি গণিতবিদ যখন বাইনারি সংখ্যা উদ্ভাবন করেন তখন থেকে পৃথিবী পেয়েছে প্রযুক্তির এক নতুন রূপ। 
এছাড়াও ইউক্লিডের জ্যামিতি, নিউটনের ক্যালকুলাস, কেইসের ম্যাট্রিক্স, হিপ্পারচাসের ত্রিকোণমিতি, জর্জ ক্যান্টরের সেটতত্ত্ব, আর্যভট্টের পাটিগণিত আবিষ্কার ছাড়া গণিত অসম্পূর্ণ।

গণিত শাস্ত্রের উজ্জ্বল ইতিহাস জানার পরে বিরক্তি বোধহয় নেই আমার। আশা করবো বর্তমান প্রজন্মের গণিত বিশেষজ্ঞরা তাদের উদ্ভাবনে এই দশক করে তুলবে গৌরবময়।

গণিতশাস্ত্রের আদ্যোপান্ত। গণিতশাস্ত্রের আদ্যোপান্ত। Reviewed by সম্পাদক on মঙ্গলবার, জুন ১৬, ২০২০ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.