জেবা সামিহা তমা,(রংপুর):
" মধুমাঝির ঐ যে নৌকা খানা
বাঁধা আছে রাজগঞ্জের ঘাটে
কারো কোনো কাজে লাগছে না তো
বোঝাই করা আছে কেবল তাতে
আমায় যদি দেয় তারা নৌকাটি
আমি তবে একশটা দানা দেই
পাল তুলে দেই চারটা, পাঁচটা, ছটা
মিথ্যে ঘুরে বেড়াই নাকো হাঁটে
আমি কেবল যাই একটি বার
সাত-সমুদ্র তেরো নদীর পাড় "
সাধারণত নৌকা বলতে আমরা বুঝি কাঠের তৈরি ইঞ্জিনবিহীন একটি জলজ যানবাহন যা মাঝেমধ্যে আমাদের বিনোদনের একটা উৎস হিসেবেও প্রকাশিত হয়। নৌকার অংশগুলোর আবার অনেক নাম রয়েছে নৌকার মূল অংশকে বলা হয় খোল। এটা কাঠের তৈরি। নৌকার খোল সবসময় পানিতে থাকবে বিধায় এতে আলকাতরার প্রলেপ দেয়া হয় যেনো এই অংশটি সহজে নষ্ট না হয়ে যায়। এছাড়াও নৌকায় রয়েছে ছাউনি, পাল, পালের দড়ি, নোঙর, বৈঠা, লগি, পাটা, গলুই, খুঁটি দুড়। অঞ্চলভেদে এই নাম গুলো ভিন্ন হতে পারে। নৌকা বড় হবে না ছোট হবে তা নির্ভর করে নৌকা কোন কাজে ব্যবহৃত হবে। পণ্য পরিবহণে ব্যবহৃত নৌকাগুলো আকারে বড় হয় অন্যদিকে মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত নৌকা আকারে ছোট হয়, এই নৌকার আরেকনাম ডিঙ্গি নৌকা। নদীমাতৃক বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরণের নৌকা প্রচলিত হয়ে আসছে যেমন : ছিপ, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, গয়না, পানসি, কোষা, ডিঙ্গি, পাতাম, বাচারি, সাম্পান অনেকে আবার ভেলাকে নৌকার আরেক প্রকারভেদ বলে থাকেন।
নৌকা অনেক পুরোনো একটা জলযান এবং এর প্রমাণ পাওয়া ডিঙ্গি শব্দটা থেকে। ডিঙ্গি-ডাঙ্গা-ডোঙ্গা শব্দটা আদি অস্ট্রিক ভাষা থেকে আগত সুতরাং আমরা ভাবনাশক্তি দিয়ে বুঝতে পারি নৌকা ঠিক কতটা পুরোনো। ইতিহাস বিশ্লেষণ করে সমীর সলিলের লেখা থেকে আরও প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রাচীন বাংলার চন্দ্রকেতু গড় থেকে পাওয়া পোড়ামাটির সীলে নৌকার কথা উল্লেখ রয়েছে। ভাবা যায় নৌকা কত আদিম যুগের জলযান। চন্দ্রকেতু গড়ের পোড়ামাটির সেই সীল থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ দুটি নৌকার নাম ও পেয়েছেন। এদের একটি হলো "এপ্প" বা এপ্পগ অন্যটি হলো "জলধিসক্ল" বা জলধিশত্রু। লেখক ধারণা করছেন জলধিশত্রু যুদ্ধের কোনো জাহাজ হবেন। এমনকি খ্রীষ্টাব্দের প্রথম দিকে পেরিপ্লাসের বিবরণীতেও এপ্পগ নামের জলযানের কথা উল্লেখ রয়েছে।
প্রাচীন বাংলার পুঁথি থেকেও একটু প্রমাণ পাওয়া যায়, কবি মুকুন্দ রায় তার চণ্ডিমঙ্গলে " জঙ্গ " নামে একটি জাহাজের কথা লিখেছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও জামালপুরে " ঝঙ্গ " নামে নৌকা দেখা যায়। ধারণা করা হয় এটা " জঙ্গ " এর উত্তরসূরি। পনেরো শতকের শেষের দিকে কবি বিপ্রদাস পিপলয় ও মুকুন্দরায়ের লেখায় পাওয়া গেছে নৌকার আরও কিছু দারুণ নাম সেগুলো হলো - নরেশ্বর, সর্বজয়া, শশিমঙ্গল, মধূকর, নবরত্ন, গুয়ারেখি, শঙ্খচূড়। তবে মুসলিম শাসকরাই এ অঞ্চলে নৌ শিল্পের বিকাশ করেছিলেন। এবং রাজশাহী অঞ্চলে সবচেয়ে বড় আকারের গয়না নৌকা পাওয়া যেতো যার দৈর্ঘ্য ১৪.৬০ থেকে ১৮.২০ মিটার।
এবার ইতিহাস থেকে নৌকায় করে আনন্দের দিকে যাই। নৌকাবাইচ, অনেক পুরাতন ও ঐতিহ্যবাহী একটি জনপ্রিয় খেলা যা সব বয়সী মানুষের প্রমোদের উৎস। নৌকাবাইচ খেলা মূলত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হয়ে থাকে। নৌকাবাইচের নৌকাগুলো ১৫০-২০০ ফুট লম্বা হয়। একটি নৌকায় ২৫ থেকে ১০০ জন মাঝি থাকতে পারে। নৌকাকে ঘিরে রচিত হয়েছে অসংখ্য জারি ও সারি গান। নদীর সৌন্দর্য আর মাঝিমাল্লাদের দরিয়া কণ্ঠে কত গান বাঁধা পড়েছে। হাজারো গীতিকারের গানের খাতা ভরে উঠেছে শুধু নৌকাকে কেন্দ্র করে। ১২.৮০ থেকে ১৪.৬৫ মিটারের দৈর্ঘ্য ও ৪.৬০ থেকে ৫.২০ মিটারের প্রস্থ সাম্পানকে নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক লোকগীতি। আগে নৌকার মধ্যে ফুটে উঠতো কারুকাজ যা নৌকার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলতো। আপনার আমার ছোটবেলার প্রথম শিল্প কিন্তু কাগজের নৌকা তৈরি করা, আর সবচেয়ে আনন্দের ছিলো বৃষ্টির পানিতে সেই কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দেয়া। তারপর বড় হয়েও আবার কাগজের নৌকা ভাসাই ছোটবেলার স্মৃতিতে হারিয়ে যেতে। কবিগণ তো এই কাগজের নৌকাকে নিয়ে কতশত কবিতা লিখছেন। নৌকা নিয়ে এত উপন্যাস, গল্প, সিনেমা রয়েছে যা লিখতে গেলে আমাকে বেশ বেগ পেতে হবে তাই এই অধ্যায় এখানেই শেষ হোক।
নৌকা সাধারণত ইঞ্জিনচালিত না হলেও বিশ শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশের নৌকাগুলোতে ইঞ্জিন লাগানো শুরু হয়। অন্যান্য জলযানের সাথে পাল্লা দিয়ে নৌকা হয়ে ওঠে ইঞ্জিনচালিত জলযান। তবে ইঞ্জিনচালিত নৌকা মানুষের শ্রম লাঘব করতে যতটা উপকার করেছে নদী দূষণ করে ততটা ক্ষতি করছে। এরপর থেকে বর্তমান সময়ে নৌকার এত হালনাগাদ হয়েছে যা শুধু মানুষের ক্ষতি থেকে রক্ষা নয় বরং প্রকৃতিরও যত্ন নিচ্ছে। ইউরোপ মহাদেশের দেশগুলোতে ব্যবহৃত ও ফেলে দেওয়া পলিথিন এবং যেসব দ্রব্য মাটিতে মিশে যেতে অসক্ষম সেসব জিনিস দিয়ে নৌকার মতো জলযান তৈরি করা হচ্ছে এবং সেগুলো দিয়ে অনায়াসে ছোটখাটো সমুদ্র মন্থনও হতে পারে। মজা করে বললাম।
নদীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আর যেসব অর্ধমৃত হয়ে বেঁচে আছে সেসবের উপর তৈরি হচ্ছে ব্রিজ, কালভার্ট, সেতু। এতে মানব সভ্যতা উন্নত হলেও হারিয়ে যাচ্ছে নৌকা। এবং এক অপ্রিয় সত্য হলো আমাদের প্রজন্মের অনেকে এখনো নৌকায় উঠেনি বা বাস্তবে দেখেওনি। দাদু-নানুর কাছে গল্প শুনেছে তাদের নৌকাযাত্রার আর প্রযুক্তির শহর বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেলে হয়তো টিভির খবরে নৌকা দেখে ঠাট্টা করছে। তবে আমরা নৌকাকে হারাতে যেতে দিচ্ছি কোথায়? বাংলাদেশের বিভিন্ন যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে নৌকা। আপনারা জানেন বোধহয়, বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরে যে বিশাল আকারের নৌকা আছে। বাংলার ঐতিহ্যবাহী সকল নৌকার রেপ্লিকা আছে সেখানে। এবং প্রমাণসরূপ একটা নৌকা রয়েছে যা সম্পূর্ণ একটি কক্ষ জুড়ে রয়েছে অর্থাৎ নৌকাটি কক্ষের দুটি দেয়াল স্পর্শ করে রয়েছে। জাদুঘরের সাবেক পরিচালক ডা: এনামূল স্যার বলেছিলেন জাদুঘরের ভবন যখন বানানো হয়েছিলো সেই তলার কাজ চলাকালীন সময়ে ক্রেন দিয়ে নৌকাটি ঐ কক্ষে স্থাপন করা হয়। এত কষ্ট করে নৌকা সংরক্ষণ করেছে পরবর্তী প্রজন্মের সাথে নৌকার পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে। তবে দেখে শুধু ইতিহাস জানা যাবে, উপভোগ করা সম্ভব নয়।
নৌকার মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের পূর্ব সময়ের অর্থনীতি। শুধু জলযান হয়ে নৌকা তার জীবনাবসান ঘটায়নি, হয়েছে আমাদের আনন্দের মাধ্যম। বেঁচে থাক নদী আর তার মধ্যে রাজত্ব করুক মাঝি তার প্রিয় নৌকাকে নিয়ে।
নৌকার সেকাল থেকে একালের যাত্রা।
Reviewed by সম্পাদক
on
শনিবার, মে ০২, ২০২০
Rating:
