-->

গল্প: দুষ্টু সাদাফের ঘড়ি।


গল্প: দুষ্টু সাদাফের ঘড়ি।

লেখা:ফারহান ইবনে রফিক,(চাঁপাইনবাবগঞ্জ)।

সেদিন সবাই নিরব মনে ক্লাসে বসে রুবেল স্যারের ক্লাস করছি। কারণ স্যার যদি টের পাই তার ক্লাসে কোনো একজন ছাত্র অমনোযোগী তাহলে তার বাঁচর কোনো উপায় নেই। ঘড়ি দেখে ৫ মিনিট কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এই শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ক্লাসের সব ছাত্র স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে ভালো ছেলের মত স্যারের কথা শুনছে। ঠিক সে সময় দরজার দিক থেকে একজন বলল, "আসতে পারি?"


এবার আমাদের সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো দরজার দিকে। আমাদের বয়সের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে নীল শার্ট আর প্যান্ট। স্যার নাকের উপর চশমা ধরে দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, "আই। কী চাই তোর?"


     ছেলেটি ভিতরে এসে বলল, "স্কুলে ভর্তি হতে চাই।"


     "স্কুলে ভর্তি হতে চাইলে তো কিছু নিয়ম আছে। তুই নিচে অফিস রুমে দেখা কর।"

ছেলেটি চলে গেল। কিন্তু ছেলেটি ১০ মিনিট পরে আবার এলো। হাতে একটা ভিজা কাগজ। স্যার সেটা দেখে প্রশ্ন করলেন, "কী এটা তোর হাতে?"


     "ভর্তি ফরম।"


     "ভিজা কেন?"


     "নিচে মুখ ধুছিলাম তখন পানিতে পড়ে গিয়েছিল।"


     "তাহলে নিচে গিয়ে আরেকটা ফরম নিয়ে নে।"


     "তার দরকার নেই স্যার। আমি এটা রোদে শুকিয়ে নিব।"


ছেলেটির কথা শুনে ক্লাসের সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। স্যার ধমক দিয়ে সবাইকে থামালেন। স্যার কথা না বাড়িয়ে ছেলেটিকে নাম জিজ্ঞেস করলেন।

 ছেলেটি বলল, "সাদাফ"


"যা পিছনের ঐই ফাঁকা বেঞ্চে বস।"


পরদিন সাদাফ পাঁচ মিনিট দেরি করে স্কুল এলো। কিন্তু নতুন ছাত্র হওয়ায় স্যার কিছু বললেন না। আমি সেদিন সাদাফের পাশে বসেছিলাম। সাদাফকে প্রশ্ন করলাম, "আমার বন্ধু হবে?"


"আমি তো গতকাল ভর্তি হলাম। আমি কেমন দেখলে না জানলে না আমার বন্ধু হতে চাইছো?"


"বন্ধু হতে চাইলে এগুলো জানা লাগেনা।"


"ঠিক আছে। কিন্তু আমার সাথে বন্ধুত্ব করার আগে একটু ভেবে নিও।"


একটু চিন্তিত হয়ে বললাম,"আমার ভাবার দরকার নেই। আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু।"


সেদিন থেকে আমি আর সাদাফ একই বেন্ধে বসতাম। সাদাফ প্রতিদিন ৫ মিনিট দেরি করে আসতো। তাই সাদাফকে প্রতিদিন ৫ মিনিট কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। সাদাফ মাঝে মধ্যে রুবেল স্যারে সাথে তর্ক করতো। আমরা তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। যে স্যারের ক্লাসে আমরা কথা বলার সাহস পাইনা সে স্যারের সাথে সাদাফ তর্ক করার সাহস কোথায় পেয়েছে!


প্রথম দিকে মনে হতো সাদাফ ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। কিন্তু দিন যেতে যেতে সাদাফ হয়ে গেল দুষ্টু সাদাফ। প্রতিদিন মারামারি করাটা সাদাফের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছিল। সুযোগ পেলেই স্কুলের জানালা, লাইট ভাঙ্গতো। শয়তানির জন্য সাদাফ প্রায়ই স্যারের মার খেত। কিন্তু ক্লাস চলার সময় সাদাফ মন দিয়ে ক্লাস করতো। আমি অনেক বার সাদাফের কাছ থেকে তার পরিবার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু বলেনি।


এভাবে চলতে চলতে ১ম সাময়িক পরীক্ষা হয়ে গেল। সবাই ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করল কিন্তু একজন পাশ করতে পারেনি সেটা হলো সাদাফ। একদিন সাদাফকে প্রশ্ন করলাম, "তুই এত শয়তানি করিস কেনো? একটু ভালোভাবে পড়ালেখা করতে পারিস না?"


"আমাকে পড়ালেখার বিষয়ে কিছু বলবি না। দেখবি একদিন এমন রেজাল্ট করব সবাই অবাক হয়ে যাবি।" সাদাফের কথাটা শুনে ক্লাসের সবাই হাসছিল।


তারপর একদিন হঠাৎ সাদাফ কয়েকদিন স্কুলে এলো না। প্রায় ১৫ দিন পর সাদাফ স্কুল এলো। আমি সাদাফ কে প্রশ্ন করলাম, "এতদিন কি হয়েছিল তোর?"


কোনো উত্তর দিলোনা সাদাফ। জানি কোনো উত্তর দিবে না তাই আর জোর করিনি। 


সেদিন স্কুল শেষে দেখলাম সাদাফ মাঠের শেষ প্রান্তে বসে আছে। আমি গিয়ে দেখে সাদাফ কাঁদছে। আমার উপস্থিত বুঝতে পেরে সাদাফ চোখ মুছে নিল। 

আমি বললাম,  "আর চোখ মুছিস না। আমি দেখলাম তুই কাঁদছিলি।"


সাদাফ উঠে গিয়ে বলল, "তোর সাথে পরে কথা বলবো। এখন আমি বাড়ি যায়।"


"না। আজ তুই বলে যাবি কী হয়েছে তোর?"


"আমার মা মারা গেছে।"


"কী?" আমি হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।

সাদাফ আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,"১০ দিন আগে আমার মা মারা গেছে। মায়ের অনেক জ্বর হয়েছিল।"

আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম। সাদাফ বলতে থাকল,"মায়ের অনেক স্বপ্ন ছিল আমাকে নিয়ে। মায়ের ইচ্ছা ছিল আমি বড় অফিসার হবো।"

সেদিন থেকে সাদাফ অনেক বদলে গেছিল। মারামারি, ভাঙ্গাভাঙ্গি সব বাদ দিয়ে দিয়েছিল সাদাফ। সময় পার হতে হতে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। শেষ পরীক্ষার দিন সাদাফকে বলললাম, "পরীক্ষা তো শেষ। কোথায় ঘুরতে যাবি?"


"কোথাও না।"

"আমি ঢাকা যাবো। তোর জন্য কিছু নিয়ে আসবো?"

"আমার জন্য একটা ঘড়ি নিয়ে আসিস। আমি কখনো ঘড়ি হাতে দেই নি।"


কয়েকদিন পর ঢাকা  থেকে ঘুরে চলে এলাম। আগামীকাল আমাদের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল। সকালে সময়মত স্কুলে চলে গেলাম। সাদাফের জন্য নিয়ে আসা ঘড়িটাও সাথে নিয়ে গেলাম কিন্তু সাদাফ এলোনা। আমরা রীতিমতো জানতাম প্রতিবারের মতো এবারও সজল পরীক্ষায় প্রথম হবে। কিন্তু এবার প্রথম হয়েছিল সাদাফ। সবাই শুনে অবাক। কিন্তু আমি অবাক হয়নি। কারণ সাদাফ তার মা মারা যাওয়ার পর থেকে অনেক বদলে গেছিল। সে চাইছিল যেন তার মায়ের স্বপ্নটা পূরণ করতে পারে সে।  সেদিন ফলাফল দেওয়া হয়ে গেল তবু সাদাফ এলোনা। 


স্কুল শুরু হওয়া ১০ দিন হয়ে গেল তবুও সাদাফের কোনো পাত্তা নেই।


সাদাফের জন্য আমার মন অস্থির হয়ে আসছিল। কারণ সাদাফ যাই হোক স্কুল বাদ দেওয়ার মতো ছেলে ওই না। সেদিন স্কুল শেষ সাদাফের বাড়ি গেলাম। সাদাফের বাড়িতে কেউ নেই। পাশে একটা চাচাকে পেয়ে সাদাফের কথা জিজ্ঞেস করলাম  চাচা কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলেন, "সাদাফ আর নেই।  কথাটা শুনে আমার মনে হলো আমার উপর পুরো আকাশ ভেঙ্গে পারল। তারপর সাদাফের চাচা আমাকে সবটা বললেন। 

পরীক্ষা শেষদিন রাতে সাদাফ তার মায়ের জন্য অনেক কেঁদেছিল।  তাই সাদাফের অনেক জ্বর এসেছিল। পাঁচ দিন জ্বর থাকার পর সাদাফ সবাইকে ছেড়ে  চলে যায় না ফেরার দেশে। মায়ের স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় সাদাফ।

সাদাফ এখন আর আমার পাশে বসেনা। আমার সাথে কথা বলেনা। আমার মন খারাপ থাকলে কেউ আস্থাও দেয়না। সাদাফের জন্য নিয়ে আসা ঘড়িটা  এখন আমিই ব্যবহার করি। যখন ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সময় দেখি তখন মনে পরে যায় দুষ্ট সাদাফের কথা। মনে হয় দুষ্টু সাদাফ আমার সাথেই আছে।


গল্প: দুষ্টু সাদাফের ঘড়ি। গল্প: দুষ্টু সাদাফের ঘড়ি। Reviewed by সম্পাদক on শনিবার, মে ১৬, ২০২০ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.