সাজ্জাদুল ইসলাম রাকিব,(নোয়াখালী):
শিশু কিশোরকে কি খাবার দেয়া হবে তা নিয়ে অনেক মা-বাবা কিংবা অভিভাবকদের চিন্তার কোনো শেষ নেই। কারণ মা-বাবা এবং অভিভাবকরা সব সময় কামানা করেন তার সন্তানটি যেন সুন্দরভাবে বেড়ে উঠে। এ কারণে গরীব বাবা-মা সন্তানের মুখে সাধারণ খাবার দাবার তুলে দেন আর দুশ্চিন্তায় ভুগেন। তার সন্তানটি হয়ত সঠিক পুষ্টি পাচ্ছে না। অথচ খাবারটি সুষম হলে তাই দেহের প্রয়োজনীয় বৃদ্ধির সহায়তা করে। এ জন্য দামি খাবারের কোনো দরকার নেই। অন্যদিকে ধনী মা-বাবা বা অভিভাবকরা এই পুষ্টির যোগান দিতে যেয়ে কথিত দামি এবং তেল-ঘি সমৃদ্ধ মজাদার খাবার অকাতরে সন্তানের পাতে তুলে দেন-যা ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, শিশু থেকে বুড়ো পর্যন্ত যে কোনো বয়সের মানুষের খাদ্য তালিকা সুষম হতে হবে। সুষম বলতে একজন পুষ্টি বা খাদ্যবিদ, শর্করা, স্নেহ, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ উপাদানকে বুঝিয়ে থাকেন। এ সাথে অবশ্য পানির কথাটি এসে যাবে। খাদ্যের সাথে প্রয়োজনীয় পানি গ্রহণেরও প্রয়োজন রয়েছে। আসলে খাবারের দাম থেকে তার পুষ্টিমান যাচাই হতে পারে না। ডাল-ভাত সস্তা খাবার। অন্যদিকে যে কোনো ধরণের গোশতই দামি খাবার। কিন্তু ডাল-ভাত খেলে দেহের বিশেষ করে শিশু এবং কিশোরের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান ঘটতে পারে। অর্থাৎ গোশতের মতো দামি খাবার দেহের জন্য যতোটা আমিষের যোগান দেয় তার প্রায় সবটাই পাওয়া যেতে পারে যে কোনো ধরণের ডাল এবং সাথে আরেকটি শর্করা জাতীয় খাবার থেকে। এই শর্করা জাতীয় খাবার ভাতই হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এটি রুটি বা অন্য কিছু হতে পারে। রুটি হলে তা গমের আটা না হয়ে যদি ভুট্টা বা যবের আটা হয় তাতেও কোনো অসুবিধা হবে না।
বাড়ন্ত শিশু বা কিশোরের জন্য বাড়তি আমিষের প্রয়োজন রয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার কোনো জো নেই। তার এই বাড়তি আমিষের চাহিদাও সহজেই ডাল ও শর্করা জাতীয় খাবারের সংমিশ্রণে প্রস্তুত খাদ্য দিয়ে পূরণ করা যায়। বাংলাদেশে এ জাতীয় একটি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাদ্য হলো খিচুরি। মূল উপাদান ঠিক রেখে এই খাবারকেই নানা ভাবে মুখরোচক এবং উপাদেয় করে সন্তান সহ বাড়ির সবার পাতে পরিবেশন করা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো খাদ্য সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞানের অভাবে একশ্রেণীর মানুষ চারপাশে সস্তায় প্রয়োজনীয় খাবারের মজুদ থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার করতে পারছেন না। আর অন্য একটি শ্রেণী সস্তা খাবারে দিকেই ঝুঁকেন না। তারা দামী এবং সেরা খাবার যোগানোর জন্য যা নিয়ে আসেন একজন খাদ্য বিজ্ঞানী সে সব খাবারকে এক কথায় বাজে ছাড়া আর কিছুই বলতে পারবেন না। তারাও সুষম খাদ্যের কথাটি ভুলে যান তার জায়গায় সন্তানকে দেহের জন্য ক্ষতিকর রিচ ফুড বা সমৃদ্ধ খাবারের যোগান দেন অকাতরে।
স্বাস্থ্য, সুঠাম ও অটুট রাখতে হলে সঠিক খাদ্য নির্বাচন করা খুবই প্রয়োজন। দেখা গেছে: মাছ, মাংস বা ডাল, দুধ, ভাত বা রুটি, ফল-সবজি, পানি এই পাঁচ জাতের খাদ্য আমাদের প্রতিদিনের খাবারে থাকলে আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষা হয়। এই খাবারগুলোর প্রতিটির পরিমাণ এমন হতে হবে, যাতে ক্যারোলি, ভিটামিন, খণিজ-লবণ, পানি- এই চারটি জিনিসেরই দৈহিক চাহিদা ঠিকমত পূরণ হয়; আর এ-রকম খাদ্যই হচ্ছে সুষম খাদ্য।
আমাদের বর্তমান সময়ের কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে প্রাণিজ প্রোটিন ৬-৮ মাসের বাচ্চার কাছে অচ্ছুৎ। আট মাসের একটি শিশুকে সঠিক পুষ্টিমূল্য বজায় রাখতে দিনে ছয় থেকে আটবার শক্ত/নরম ফর্টিফায়েড খাবার খাওয়ানো প্রয়োজন। একটি প্রামাণ্য গবেষণা জানাচ্ছে, ভারতে মাত্র ৪২% ভাগ্যবান শিশুকে দৈনিক ৬-৮ বার খাওয়ানো হয়। ২ বছর বয়স পর্যন্ত পুষ্টিপ্রাচুর্যে ভরপুর খাবার শিশুর একান্ত প্রয়োজন; শিশুর বৃদ্ধি বিকাশ যেমন এই সময়টাতে সর্বাধিক ত্বরান্বিত হয় তেমনি শিশুর ভবিষ্যত খাদ্যগ্রহণের সুচারু অভ্যেসটিও তৈরি হয় এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’বছর সময়কালে। শুধু পুষ্টি নয়, মায়ের দুধের বিকল্প হিসাবে ধীরে ধীরে শক্ত বা নরম কমপ্লিমেন্টারি ফিডিং শিশুকে খাদ্যের স্বাদ ও গন্ধের ব্যাপারেও সচেতন করে তোলে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসে যার ভূমিকা অপরিসীম।
কোন ধরনের খাবার শিশুর জন্য উপযোগী :
ভাত, রুটি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, পাতাসবজি, সবজি, মৌসুমি ফল, শুকনা ফল, পানি ও পানীয় সব ধরনের খাবারের সঙ্গেই শিশুকে অভ্যস্ত করতে হবে এবং দৈনিক খাদ্য তালিকায় তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে শিশুভেদে খাবার তৈরিতে কিছুটা পার্থক্য রাখা যায়। যেমন_ কোনো শিশু সরাসরি ডিম খেতে না চাইলে তাকে ডিমের হালুয়া, পুডিং, কাস্টার্ড ইত্যাদি তৈরি করে দেওয়া যায়। মাছ-মাংসের পরিবর্তে খিঁচুড়ি দেওয়া যায় কিংবা ফিশফিঙ্গার, কাবাব তৈরি করা যায়। আবার সবজি বড়া তৈরি করে সবজির চাহিদা মেটানোর ব্যবস্থা করা সম্ভব।
এ ছাড়াও মনে রাখা দরকার, নতুন নতুন খাবারে শিশুকে অভ্যস্ত করা প্রয়োজন। বিশেষ করে মৌসুমি ফল, সবজি অবশ্যই শিশুর খাদ্যে সংযোজন করা প্রয়োজন। তবে জাঙ্ক ফুড শিশুর সুস্বাস্থ্যের অন্তরায়। ফলে এসব খাবার শিশুর খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়া বাঞ্ছনীয় এবং যে খাবারই দিই না কেন সেটা যেন টাটকা হয়।
ডিমের পুষ্টির মান:
ডিম শুধুমাত্র মানুষের জন্য দুধের পরে সেরা মানের প্রোটিনের প্রধান উৎসই নয়, একটি ডিমের মধ্যে রয়েছে তেরোটি অতি প্রয়োজনীয় ভিটামিন। ডিমের মধ্যে তামা, জিংক, সেলেনিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং আয়রনের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ রয়েছে, এতে প্রোটিন, কোলেস্টেরল, ফ্যাট, ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ভিটামিন ডি, বি১২, ই, কোলাইন ও ফোলেট রয়েছে, উপরের সমস্ত পুষ্টি বৃদ্ধির জন্য এবং শিশুদের ভাল থাকার জন্য প্রয়োজনীয়।
বাবা-মায়ের ভূমিকা :
শিশুকে খাওয়ানোর ব্যাপারে বাবা-মায়ের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। খাওয়ানোর সময় শিশুর সঙ্গে সংবেদনশীল আচরণ করতে হবে। খাবারকে শিশুর কাছে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করতে হবে। শিশুর খিদে না থাকলেও তাকে জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করা অনুচিত এতে রুচি কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, জোর করার কারণে খাবারের প্রতি শিশুর মনে ভয় ও অনীহা জন্ম নেয়। তাই জোর না করে নিয়মমতো খাওয়ার ব্যাপারে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে।
ভাবনা যখন শিশুর খাবার।
Reviewed by সম্পাদক
on
মঙ্গলবার, মে ১২, ২০২০
Rating:
