সৌহাত রাশেদিন সৌখিন:
ধরো তুমি একটি টাইমেশিনে চড়ে প্রায় বেশ কয়েক দশক পিছিয়ে অতীতে চলে গেলে । সেই টাইমমেশিন তোমাকে নিয়ে গেলো অতীতের চট্টগ্রামে। সেখানে গিয়ে দেখলে তুমি দাঁড়িয়ে আছো একটা প্রকান্ড বটগাছের নিচে এবং তোমার চারপাশে বহু লোক তন্ময় হয়ে বটগাছের বেদীর উপর দাঁড়ানো চোঙা হাতে বেশ জাঁদরেল টাইপ লোকের কথা শুনছে। তুমিও একটু কান পেতে শুনতে পেলে লোকটি তার হাতের চোঙা দিয়ে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে বলছে - "আজিয় ফজর দশট্টাতুন দুইয্যে বারটা লতিক হাজী সাবর নাতির আকিকা অনুষ্ঠান জইন্যে মেজ্জান আছে, অনরা বেক্কুনুর দঅত" । নেহাত তোমার চট্টগ্রামের কয়েকজন বন্ধু আছে, সেই সুবাদে তুমি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাটা একটু আধাটু জানো। তাই বুঝছে পারলে লোকটি বলছে- "আজ সকাল দশটা হইতে দুপুর বারোটা পর্যন্ত হাজী সাহেবের নাতির আকিকা উপলক্ষে মেজ্জান আছে আপনাদের সবার আমন্ত্রণ" তো তোমার হাতে বেশ কয়েক ঘন্টা সময় আছে, সেজন্য তুমি বাকি লোকগুলোর সাথে হাজী সাহেবের বাসায় চলে গেলে। গিয়ে দেখলে সেখানে হইহুলুস্হুল কাজকারবার! মস্ত উঠোনজুড়ে বাঁশের চাটাই আর খড় বিছানো হয়েছে,লোকজন এসে তাতে বসছে, একপাশে চুলার গনগনে আগুনের উপর প্রকান্ড পেতলের ডেকচিতে রান্নাবান্না হচ্ছে,চারদিক গোসত রান্নার একটা চমৎকার সুঘ্রাণে একেবারে ম ম করছে! তোমার পেটের ক্ষিদেটা চড়চড় করে বেড়ে গেলো। তুমি একটু খাদ্যরসিক কিনা! জ্বিভের জল আটকিয়ে তুমিও চটপট বাঁশের চাটাইয়ের উপর বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে বসে পড়লে, কিছুক্ষণ পরেই ব্যস্তহাতে একজন তোমার হাতে একটা মাটির থালা ধরিয়ে চলে গেলো তুমিও অন্যদের মতো ঘটির পানিতে তালাটা ধুয়ে নিলে প্রায় সাথে সাথেই তোমার থালা পরিপূর্ণ হয়ে গেলো ধবধবে শাদা ভাতের স্তুপে। তারপর একেএকে তোমার থালায় চলে এলো ঝোলসমেত গোসত,গরুর পায়ের হাড়ের ঝোল বা "নলা কাজি",বুটের ডাল আর মাষকালাইয়ের ঘুনা ডাল। তুমি কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে পরম তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে টাইমমেশিনে চড়ে ফেরত চলে এলে। এসেই তোমার মাথায় ভুত চাপলো আজকের অভিজ্ঞাতার ইতিহাস ঘাটার। তুমিও বসে গেলে কম্পিউটারের সামনে গুগোল করতে।
গুগোলে তুমি দেখলে- শতবর্ষের পরিক্রমায় তোমার সদ্য পরিচিত "মেজ্জান" শব্দটির ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে শুধু চট্টগ্রাম আঞ্চল ব্যাতিত সারা দেশে শব্দটি "মেজবান" হয়ে দিব্যি সবার কাছে পরিচিতি লাভ করছে। তুমি দেখলে মেজবান একটি ফারসি শব্দ। এর অর্থ নিমন্ত্রণকর্তা। চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী অঞ্চলেও মেজবানি জেয়াফত নামে মেজবানের রেওয়াজ আছে। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায়ও বিভিন্ন উপলক্ষে ভোজের আয়োজন করা হয়। তবে মেজবানি চট্টগ্রাম অঞ্চলেই অধিক জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত। এই অঞ্চলে পূর্বে হাটেবাজারে ঢোল পিটিয়ে বা টিনের চুঙ্গি ফুঁকিয়ে মেজবানির নিমন্ত্রণ প্রচার করা হতো। বর্তমানে মাইকে ঘোষণা দেয়া হয় সেই ঘোষণা যতদূর পর্যন্ত শোনা যায় সবাই আমন্ত্রিত হয়। মেজবানের উৎপত্তির সঠিক সময় নির্ণয় করা যায় নি। তবে এই প্রথা সুদীর্ঘকাল ধরে চর্চিত হয়ে আসছে।মেজবানের রান্নার রয়েছে আলাদা বিশেষত্ব। মূল পদ গরুর মাংস হলেও এই মাংস রান্নার ধরন আলাদা। মসলাও ভিন্ন। শুধু তা-ই নয়, রান্নার ডেকচি থেকে শুরু করে চুলা পর্যন্ত আলাদা। এতে থাকে মাংসের আধিক্য।
গরুর মাংসের গোড়া ও নেহারি (চট্টগ্রামের ভাষায় নলা) দিয়ে তিন-চার রকমের আইটেমে অনন্য উপাদেয় খাদ্যের আয়োজন হয়ে থাকে মেজবানে। এই কাজে দক্ষ চট্টগ্রামের বাবুর্চিরা। বংশপরম্পরায় তাঁরা এই ঐতিহ্যের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। মূলত গরুর মাংসের উদার ও আয়েশি পরিবেশন হওয়ায় মেজবানের জন্য কোনো প্রকৃত বাজেট নিয়ে আয়োজন করা যায় না। এর পরও একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মানুষকে উপলক্ষ করে আয়োজন শুরু করলেও অতিথি সমাগমে পর্যালোচনা করে তাতক্ষণিকভাবে গরু জবাই দেয়া হয় অনুষ্ঠানস্থলেই। অর্থাৎ সামর্থ যা-ই থাকুক না কেন, ধনী-গরীব যে-ই মেজবানের আয়োজন করবে তার অতিথির সংখ্যা নিরূপণ করা চলবে না। অর্থাৎ অতিথির সংখ্যা গুনে মেজবানের আয়োজন সম্ভব নয়। যত অতিথি আসবে এবং যে পরিমাণ খেতে চাইবে ততটুকু পরিবেশন করাই হলো পরিপূর্ণ মেজবানের বৈশিষ্ট্য। রন্ধন প্রণালির বৈচিত্র ও পরিবেশনের অকৃপণতা মেজবানকে অতুলনীয় করে তুলেছে। ঐতিহ্যে লালিত মেজবান চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকেও করেছে সমৃদ্ধ। নানা উতসব-পার্বণ ছাড়াও যেকোনো কারণে যে কেউ মেজবানের আয়োজন করতে পারেন। উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্মবিত্ত পরিবারগুলোতেও মেজবানের রেওয়াজ প্রচলিত আছে।
অনেকে এই মেজবানি ভোজকে শুধু মাত্র মুসলমান বাঙালিদের রেওয়াজ বলে ভূল করে কিন্তু চট্টগ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ও এই ভোজের রেওয়াজ আছে । তাই তুমি ইতিহাসের আর একটু গভীরে গিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মেজবানি ভোজের ইতিহাসটকু ঘেটে বের করলে। তুমি জানতে পারলে- ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ফেনী জেলার উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চল (পূর্বে ইসলামাবাদ) ও ত্রিপুরার চকলা-রোশনাবাদের জমিদার শমসের গাজী, তার মা কোয়ারা বেগমের নামে একটি বড় পুকুর খনন করেছিলেন এবং সে উপলক্ষে ভোজের আয়োজন করেছিলেন। এই ভোজের জন্য চট্টগ্রামের নিজামপুর এলাকায় প্রতিবেশী পুকুর হতে মাছ ধরে আনা হয়। হিন্দু ঐতিহ্যে মেজবান রান্নার সময় গরুর পরিবর্তে মাছ ব্যবহার করা হয়। এরপর থেকে চট্টগ্রামের হিন্দু সম্প্রদায় প্রতি বছর "চট্টগ্রাম পরিষদ" ব্যানারের অধীনে মেজবানি আয়োজন করে, মাছ, সবজি এবং শুকনো মাছ থেকে তৈরি কারি দিয়ে।
এখন এত কিছু জানার পর তুমি মোটামুটি একজন মেজবানি ইতিহাসবিদ হয়ে গেলে। তাই বর্তমানের মেজবানি ভোজের স্বাদ পেতে চাইলে তুমি কোন একদিন সময় করে চট্টগ্রামের পথে রওনা হয়ে যেতে পারো।
অনরা বেক্কুনুর মেজ্জান!
Reviewed by সম্পাদক
on
সোমবার, মে ১৮, ২০২০
Rating:
