-->

বিশ্ব কাঁপানো সুইসাইডাল অপারেশন; অপারেশন জ্যাকপট।


নাবিলা আক্তার বুশরা,(ঢাকা):

আচ্ছা আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়  পৃথিবীর  কতো গুলো এমন দেশের নাম বলেন তো যারা কি না জীবন দিয়ে আর জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতা এনেছে এমন কয়েকটি দেশের নাম বলুন তো।
ঠিক সেই মুহূর্তে আপনার মাথায় প্রথমেই   আপনার দেশের নামটি স্পষ্ট ঝলক দিয়ে উঠবে। চট করে উত্তর ও দিয়ে ফেলবেন আপনি-"বাংলাদেশ"। আমাদের এই স্বাধীনতা পাওয়ার পিছনে সবার গভীর দেশপ্রেম আর যুদ্ধই মূল ছিলো। এই যুদ্ধের মাঝে এক ঐতিহাসিক অংশ হলো  অপারেশন জ্যাকপট। আমাদের গর্ব করার মতো একটি অপারেশন।

অপারেশন জ্যাকপট হলো একটি এমন গেরিলা হামলা যা কি না পুরো পাকিস্তান সেনা আর বিশ্ব দরবারে তুমুল সমলোচনা আর সাহসীকতার পরিচায় বহন করে,  সাথে পাক বাহিনীর ভীতির কারন হয়ে দাঁড়ায় এবং বর্হিবিশ্বের দৃষ্টি আর্কষণ করে ।
চলুন জেনে আসি ইতিহাসের এক প্রাণঘাতি এক সুইসাইডাল অপারেশনের কথা।


২৫শে মার্চ কালরাত্রি তে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর এক ঘটনা যখন পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো।
অপরদিকে তখন পশ্চিম পাকিস্তানের নৌবাহিনীর সাবমেরিন এ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল সুদূর দক্ষিণ ফ্রান্সের উপকূলীয় শহর তুলনে। এবং সেখানে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল  ৪৫ জন ক্রুকে যাদের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাঙালি।যখন এই বাংলাদেশিরা ২৫ শে মার্চের কথা জানতে পারলো তখনই পশ্চিম পাকিস্তানের উপর চরম ঘৃণা আর ক্ষোভের সৃষ্টি হলো।
তখনই তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেয়ার। এবার তাদের মাঝে ৯ বাংলাদেশি রাজি হয় নিজ দেশে যেকোনো মূল্যতে  ফিরে যুদ্ধে যুক্ত হওয়াতে। তাদের মাঝে সাবমেরিনার মোঃ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী ছিলো জরুরী ও গোপন নথি রাখার সিন্দুকের নিরাপত্তার দায়িত্বে। এই সুবাদে তিনি
৪৫ জন ক্রু এর পাসপোর্টই নিজের লকারে নিয়ে আসেন,  কারন তিনি যদি কেবল ৯ জন বাংলাদেশির পাসর্পোট নিয়ে আসেন তাহলে তা সন্দেহের উদ্রেক করতো। কিন্তু বাংলাদেশি সাবমেরিনারদের এতো সর্তকতার পরও তাদের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান ইনটেলিজেন্স একজন কে খুন করে এবং বাকি আটজন এই যাত্রায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।  সেই আট বাংলাদেশি ৩০ মার্চ বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তারপর ফ্রান্সের বিভিন্ন  শহর ঘুরে শেষ পর্যন্ত  স্পেনের মাদ্রিদ শহরে গিয়ে ভারতীয় দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলে তাৎক্ষণিকভাবে ভারত সরকার তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করে। তারপর দ্রুত ভারতে নিয়ে আসার লক্ষ্য ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ তাদের ইতালির রোমে নিয়ে যায়,তারা রোমে পৌঁছবার পর দেখেন শ্রমিক ধর্মঘটের জন্য বিমানটি দেরী করে আসবে। এদিকে ভারতীয় দূতাবাস থেকে গণমাধ্যমে তাদের পালিয়ে আসার খবরটি চলে গেলে পাকিস্তান দূতাবাস থেকে তাদের নিয়ে যেতে অনেকে ছুটে আসেন। তারা জবাব দেন, “২৬ শে মার্চ আমরা নতুনরূপে জন্ম নিয়েছি। আমরা আমাদের দেশের জন্য লড়তে যাচ্ছি। পরে ইতালির সাথে তখন   পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো ছিলো তাই তারা তাদের সাথে হাত মিলিয়ে বিমান ১০ ঘন্টা পর ছাড়বে বলেছে।  এখানে ঝুঁকি আছে বুঝে তারা  জেনেভায় চলে  আসে। তারপর  সুইজারল্যান্ডের জেনেভা হয়ে ভারতের বম্বে নিয়ে আসা হয়  ৯ এপ্রিল এবং শেষ পর্যন্ত আট সাবমেরিনারকে বম্বে থেকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং দিল্লির বিভিন্ন স্থানে রাখা হয় তাদের।
অতপর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো  যে, এই ৮ জন নৌকমান্ডো হিসেবে কাজ করতে যাচ্ছেন।

ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা সেই ৮ জন  হলেন: মোঃ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, মোঃ সৈয়দ মোশাররফ হোসেন, মোঃ রহমতউল্লাহ, মোঃ শেখ আমানউল্লাহ, মোঃ আবদুর রকিব মিয়া, মোঃ আহসানউল্লাহ, মোঃ বদিউল আলম, মো আবদুর রহমান আবেদ। 


ঐ দিকে বাংলাদেশের মানুষেরা আক্রমণ করতে পারছে না তেমন সব একটু  স্থির হয়ে পড়েছিলো কারন পাক-বাহিনীর কাছে অস্ত্র  আর রসদে ভরপুর ছিলো আর তার সবই আসছিল নৌ পথে কারন আকাশ পথে বিমান যোগে ভারতের উপর দিয়ে আসা বন্ধ করে দেয় ভারত। আর তারা যেহেতু জলপথে তাদের রসদ আসতো তাই তাদের প্রয়োজনীয় যোগান বন্ধ করতে এবং তাদের প্রতি বাড়িয়ে দেয়া বৈদেশিক সাহায্যের হাত রুখতেই এই বন্দরগুলো আক্রমণ করে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হয় এই অপারেশনের মাধ্যমে।


১৯৭১ সালের ২৩ শে মে নদীয়া জেলার পলাশীর স্মৃতিসৌধের পাশে ভাগীরথী নদীর তীরে হরিনা ক্যাম্পে গোপন প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়, যার সাংকেতিক নাম দেয়া হয় সি-টু-পি। প্রশিক্ষণে যারা ছিলো সবাইকে বলা হলো এটি একটি প্রাণঘাতি অপারেশন এখানে জীবন হাতে নিয়ে অপারেশন করা লাগবে। আর তাই প্রশিক্ষণের শুরুতেই এই মর্মে স্বাক্ষর নেয়া হয় যে- “আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি, আর যুদ্ধে আমার মৃত্যু হলে কেউ দায়ী থাকবে না।”
সেই সাহসী তরুণদেরকে ভারতীরা ট্যাংকে করে নিয়ে যায়। আর হাসনাবাদ ক্যাম্প হতেও দুই ট্যাংক মানুষ এসেছে তাও ১/২ দিন পর পর করে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে।
যেখানে তাদের ক্যাম্প হলো তার আশেপাশে চরের মতো আর সেখানে তখন চাষাবাদ করতে বন্ধ করে দেয়া হয়। সেখানে লোকালয়ও কম ছিলো তার উপর সেখানের কয়েকটা রাস্তা জনসাধারণের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় আর বাদবাকি রাস্তায় একটা নিদিষ্ট সময়  অব্দি চলাচলের নিয়ম করে দেয়া হয়। ক্যাম্পের চারপাশে মোটামুটি আখক্ষেত আর আরেক পাশে খরস্রোতা ভাগীরথী নদী, সব মিলিয়ে এমন এক পরিবেশের তৈরি হয়েছে যাকে বলে কঠিন পরিবেশ।

এই নৌ সেক্টরের কোন সেক্টর কমান্ডার ছিলো না, তারা সরাসরি মুজিবনগর সরকারের অধীনে কাজ করতেন। নৌ-কমান্ডোদের ওই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ভারতের নৌ বাহিনীর কর্মকর্তা কমান্ডার এম এন সামানত ও প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন লে. কমান্ডার জি এম মার্টিসসহ আরও ২০ জন ভারতীয় প্রশিক্ষক। প্রায় তিনশ’র বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এই ক্যাম্পে  এবং দিনে ১৮ ঘণ্টা করে প্রায় ৩ মাস চলেছিল এই প্রশিক্ষণ।

প্রশিক্ষণের ছিলো দুটি অংশ একটি হলো স্থলযুদ্ধ প্রশিক্ষণ  আরেকটি হলো জলযুদ্ধ প্রশিক্ষণ।
এর মাঝে স্থলযুদ্ধে যে কলাকৌশল রপ্ত করতে শিখানো হতো তা হলোঃ গ্রেনেড নিক্ষেপ, স্টেনগান চালানো, এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার, রিভলবার চালানো, আন-আর্মড কমব্যাট ইত্যাদি।
আর অপরদিকে জলযুদ্ধ প্রশিক্ষণ চলতো  তীব্র খরস্রোতা ভাগীরথী নদীর বুকে ৫-৬কেজি ওজনের পাথর বেধে সাঁতার করতে হতো, চিৎ সাঁতার, কোন রকমে পানির উপরে নাক ভাসিয়ে একটানা অনেকক্ষণ সাঁতার কাটা, সাঁতার এবং ডুব সাঁতার দেয়া অবস্থায় লিমপেট মাইনের ব্যবহার(এটায় শক্তিশালী ৬ টা ম্যাগনেট ছিলো এবং এর ওজন ৫ কেজি), স্রোতের প্রতিকূলে সাতার, জাহাজের কেবল ভাঙা ইত্যাদি কঠিন সব প্রশিক্ষণ দেয়া হত জলযুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য। তাদের আরো শিখানো হয়েছে কিভাবে নিরঅস্ত্র থেকে শত্রু হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায় এবং শত্রুকে ঘায়েল করা যায় এমন ৪০ টি পন্থা।
সকল যোদ্ধাকে একটানা ৪৮ ঘণ্টা পানিতে থাকার অভ্যাস করতে হত। তাদের মূলত এই সাঁতারের উপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে।
তাদের ভোর ৬ টায় উঠিয়ে প্রথমের প্যারেডে নিতো তারপর জাতীয় সংগীত বাজানো হতো এটা তাদের মাঝে দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে আরো সাহায্য করতো ঠিক সেই সময় তাদের দুই চোখে পানি চলে আসতো দেশের প্রতি ভালোবাসা কাজ করায়।

এভাবে করেই আগস্টের প্রথম সপ্তাহে এ তাদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়। তাদের এমন অনুভূতি ছিলো যে ৩ বছরের প্রশিক্ষণ  তারা করেছে ৩ মাসে। ত্রিপুরায় তাদের চূড়ান্ত নির্দেশ দেয়া হয়। প্রস্তুতির শুরুতে  প্রত্যক নৌ-কমান্ডাকে একটি করে লিমপেট মািন,ছুরি, এক জোড়া সাতারের ফিন আর কিছু শুকনো খাবার  আর প্রতি তিন জনকে একটি করে স্টেনগান ও কমান্ডারদের দেওয়া হয় একটি করে গ্রেনেড আর দলনেতার কাছে  ছিলো একটি করে ট্রানজিস্টর রেডিও।
আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৬০ জনের চট্টগ্রামগামী দলকে সাহায্যকারী হিসেবে সেক্টর-১,প্রতিটি ২০ জনবিশিষ্ট চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ এলাকাগামী দলকে সেক্টর-২ এবং ২৬০ জনের (৬০ জন নৌ এবং ২০০ জন সি.এন্ড.সি কমান্ডো) মংলাগামী দলকে সাহায্যের জন্য সেক্টর-৯ নিযুক্ত হয়েছিলো।
অপারেশন জ্যাকপট কবে হবে এটা জেনারেল ওসমানীর কাছেও জানানো হয় নি। ঠিক করা হয় ১৪ আগষ্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে অপারেশন চালানো হবে কিন্তু পর মুহূর্তে মনে পড়লো তারা সেই দিন আরো বেশি সচেতন থাকবে,  এই দিনে অপারেশন চালালে তা ব্যর্থ হওয়ার সম্ভবনা বেশি। তাই সময় বদলিয়ে ১৫ আগষ্ট মধ্যরাতে অর্থাৎ ১৬ তারিখ প্রথম প্রহরে অপারেশন চালানো হবে।


এই অপারেশনের একটি চমকপ্রদ দিক হলো অপারেশন প্রস্তুতি এবং শুরু কখন হবে সেই সংকেত  দেয়া। এই সংকেত গুলো আকাশবাণীতে প্রচার করার কথা ছিল- প্রথম সংকেত ছিল “আমার পুতুল যাবে শ্বশুরবাড়ি” গানটি যার অর্থ  ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণ করতে হবে বা আক্রমণের সময় কাছাকাছি। পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া “আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যত গান” গানটি ছিলো দ্বিতীয় সংকেত যার অর্থ আক্রমণের জন্য ঘাঁটি ত্যাগ কর। অর্থাৎ সুস্পষ্ট নির্দেশনা, আক্রমণ করতেই হবে।সকাল ৬টা থেকে ৬:৩০ মিনিট অথবা রাত ১০:৩০ মিনিট থেকে রাত ১১টায় এই সময়ের মাঝে।


এবার চলুন ঘুরে দেখে আসি কোন সেক্টর কিভাবে পৌঁছায় এবং  তাদের অপারেশন  শুরু করে।

চট্টগ্রামে সাবমেরিনা আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ছিলো।  তার নেতৃত্বে থাকা ৬০ জনের দলটিকে ২০ জনের মোট তিনটি দলে ভাগ করে দেয়া হয়েছিলো। এরা হরিনা ও শ্রীনগর ক্যাম্প পারি দিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত পার হয়। তারপর তারা ফেনী থানার কৃষ্ণমন্দার গ্রামের মঈন ভূঁইয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তারপর দুটো দলকে নির্দেশ দেয়া হলে তারা সেই মোতাবেক এগিয়ে কর্ণফুলি নদীর পূর্বতীরের নির্ধারিত বেইজক্যাম্প চরলক্ষ্যায় পৌঁছায়  এবং দ্বিতীয় সংকেতটি পায় অর্থাৎ পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া “আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যত গান” গানটি । তৃতীয় দলটি সময়মত এসে না পৌঁছনোয় এবং তাদের কোন হদিশ পাওয়া যায়নি  তাই তাদের ছাড়াই অপারেশনটি চালানো হয়। আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর অপারেশনে যাবার আগে কমান্ডোদের উদ্দেশ্য করে বলেছে এটা কিন্তু একটা সুইসাইডাল অপারেশন  এখনও সময় আছে চাইলেই তোমারা সরে যেতে পারো তখন  ৯ জন কমান্ডো অপারেশনে অংশ নিতে পিছ পা হলো। অতপর চট্টগ্রাম অপারেশনে অবশেষে মোট ৩১ জন কমান্ডো অংশ নেন।  ১৬ তারিখ রাতের প্রথম প্রহরে পৌনে দুটা থেকে সোয়া দুটার মধ্যে কমান্ডোরা সন্তর্পণে জাহাজে মাইন লাগিয়ে সরে আসেন। অতঃপর সেই প্রতিক্ষিত সময় এলো সময়টা ঠিক ১ টা ৪০ এ
আর তখনই প্রথম মাইন বিস্ফোরিত হয়। এরপর ক্রমাগত বিস্ফোরণে ৩ টি বড় অস্ত্রবহনকারী জাহাজ- এই বড় জাহাজ গুলো হলো (১) ভি হরমুজ—এটি ১৪ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। ৯৯১০ টন অস্ত্র ও গোলা–বারুদবাহী এই জাহাজটি ১৩ নম্বর জেটিতে নোঙর করা ছিল (২)এম ভি আল-আব্বাস—এটি ১০ হাজার ৪১৮ টন সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে ৯ আগস্ট ১২ নম্বর জেটিতে অবস্থান নেয়। (৩) ওরিয়েন্ট বার্জ নম্বর ৬—এটি ৬ হাজার ২৭৬ টন অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে ফিস হারবার জেটির সামনে অবস্থান করছিল।


চাঁদপুরে অপারেশনে সাবমেরিনার বদিউল আলমের নেতৃত্বে ছিলো তারা আগরতলার শালবন নিউ ক্যাম্প থেকে বক্সনগর বর্ডার হয়ে কুমিল্লার ময়নামতি ও নারায়নপুরের ভিতর দিয়ে দাশাদি গ্রামে পৌঁছায়। দুইজন শেষ মুহূর্তে  অংশ নিতে অসম্মত হলে ১৮ জন তিনটি দলে ভাগ হয়ে এ অপারেশনে অংশ নেন।  মোট ৪ টি জাহাজে তারা মাইন লাগিয়ে দেন এবং ৩ টি স্টীমার-জাহাজসহ আরো কিছু নৌযান ডুবে  যায়।


নারায়ণগঞ্জে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাবমেরিনার আবেদুর রহমানের তার  নেতৃত্বে ২০ জনের দল ছিলো।
নারায়ণগঞ্জের দলটি আগরতলার শালবন নিউ ক্যাম্প থেকে কসবা বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে (নবীগঞ্জের ২ জন গেরিলা ফারুক আর সোবাদ এরা পথ চিনাতে গাইড হিসেবে ছিলো)।  গাইডের সহায়তায় কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের প্রধান সড়ক অতিক্রম করে শত্রুর মাঝ দিয়ে বিপদকে উপেক্ষা  করে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর ইউনিয়ন পরিষদের তিনগাঁও নামের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেয়(বাড়ির মালিকের নাম তমিজউদদীন কন্টাকটার)। শহরের ভেতর অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এ অপারেশনে অংশ নেন। ৪ টি জাহাজ-বার্জ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হন এই নৌ-কমান্ডোরা।


মংলা বন্দর ছিলো সাবমেরিনার আমিনুর রহমান খসরুর নেতৃত্বাধীন  দলটি ছিলো ২৬০ জনের। সাবমেরিনার খসরুর তার গ্রুপসহ ব্যারাকপুর ক্যান্টমেন্ট হতে হালদা নদী বন্দরে গিয়ে ৬ টি নৌকা যোগে ২৭ জুলাই  ক্যানিং বন্দর হয়ে হাড়িভাঙা নদী ও রায়মঙ্গল নদী হয়ে কৈখালী গ্রামে পৌঁছায় আর এই যাত্রাটা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে পার করতে হয়েছে তাদের।
কৈখালীতে এক রাত্রি যাপনের পর আবার সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে প্রকৃতিক প্রতিকূলতা পারি দিতে দিতে মংলা সমুদ্র বন্দরের কাছাকাছি সুতারখালি গ্রামে এসে পৌঁছায় ১৩ আগষ্ট । সুতাখালীতে গিয়ে তারা সবাই মৌল্লিক বাড়ি নামে এক পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তারপর তারা সেখান থেকে মংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। মাইন লাগানোর শেষ সময় রাত দুটো হলেও পথনির্দেশক আফজালের ভুলের কারণে সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে ৪ টা বেজে যায় তাদের। আর অন্যান্য জায়গায় সবার অপারেশন ততক্ষণে শেষ ফলে  এই কারনে পাকিস্তানিরা সর্তক হয়ে যায় বন্দরে নোঙর করা ১৪ টি জাহাজের সবগুলোকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। সেই মুহূর্তে খুব তাড়াতাড়ি আমিনুর রহমান সিদ্ধান্ত নেন যে ৬ টি জাহাজে মাইন লাগানো হবে। এই অপারেশনে ২৪ জন নৌ-কমান্ডো অংশ নেন। আর দলের ২০০ জন সি.অ্যান্ড.সি কমান্ডো ৩ জনের ৬৬ টি উপদলে ভাগ হয়ে নৌ-কমান্ডোদের কভার দিতে মংলা বাঁধের পেছনে অবস্থান নেন। এ দলের সাব-কমান্ডার রাজা ও খিজির নৌ-কমান্ডোদের সহায়তাকল্পে পশুর নদীর হাঁটুপানিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেশিনগানসহ নেমে আসেন।
অতপর অপারেশন শুরু হয় ৪ টা ৩০ মিনিটে। ২৪ জন নৌ-কমান্ডো ৬ টি ছোট ছোট দলে বিভক্ত হন (প্রতিটি ছোটদলের ১ জন করে দলনেতা ছিল) এবং ৬ টি বিদেশী জাহাজে মাইন লাগান। ঘড়িতে তখন  ভোর ৬ টা ৩০ বাজে এবং সাথে সাথে শুরু হয় জাহাজগুলোর বিস্ফোরণ আর তখন জাহাজগুলো ধ্বংস হতে শুরু করে। এই জাহাজ গুলোর মধ্যে একটি করে সোমালীয়, মার্কিন, জাপানি ও পাকিস্তানি জাহাজ এবং দুইটি চীনা জাহাজ ছিল। এ অপারেশনে পশুর নদীতে মোট ৩০,০০০ টন গোলা-বারুদ ও যুদ্ধের সরঞ্জাম ডুবে যায়। মংলা অপারেশনে অপারেশন কমান্ডার আমিনুর রহমান খসরু এবং আরো ২ জন নৌ- কমান্ডো মংলা বন্দরের অতিরিক্ত বাধা পার হয়ে অপরিসীম সাহসের সহিত সোমালীয় ৭,০০০ হাজার টনের অস্ত্রবাহী জাহাজ এসএস লাইটং এ মাইন লাগিয়ে তা ধ্বংস করে ফেলেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি  এই অপারেশনে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা নিখোঁজ হন ধারনা করা হয় তারা স্রোতে ভেসে যায় অথবা গুলির আঘাতে নিহত হয়েছে।


সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো সব গুলো জায়গায় ধরতে গেলে  একই ধরনের আক্রমণ পরিচালনা করে পাকবাহিনীকে ভীত করে ফেলে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করা হয়।


মুক্তিযুদ্ধ শেষে সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের  নানা খেতাবে ভূষিত করা হয়- আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী (বীর উত্তম), মোহাম্মদ শাহ আলম (বীর উত্তম), মোশাররফ হোসেইন  (বীর উত্তম), মোজাহার উল্লাহ (বীর উত্তম), শেখ মোহাম্মদ আমিন উল্লাহ (বীর উত্তম), আবেদুর রহমান (বীর উত্তম), মোহাম্মদ খবিরউজ্জামান (বীর বিক্রম), মমিন উল্লাহ পাটওয়ারী (বীর প্রতীক), শাহজাহান কবীর (বীর প্রতীক), ফারুক-এ-আজম (বীর প্রতীক), মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ (বীর প্রতীক), মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেইন (বীর প্রতীক), আমির হোসেইন (বীর প্রতীক), মোহাম্মদ খোরশেদ আলম (বীর প্রতীক)।


আগষ্ট থেকে ডিসেম্বরের মাঝের এই সময়টায় বাংলাদেশের মানুষ বিজয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু করে এই কমান্ডো বাহিনীর কারনে। তারা এই সময়ের মধ্যে ৪৫ টিরও বেশি নৌযান ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হন নৌ-কমান্ডোরা। তাদের কোনো রকম নিজস্ব নৌযান না থাকা সত্ত্বেও তারা কমপক্ষে ১০০,০০০ টন নৌযান ডুবানো বা বিকল করার পাশাপাশি, জেটি এবং বন্দর গুলো অকার্যকর করতে এবং চ্যানেলসমূহ বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়ে যান, এতে করে পাকবাহিনীর ক্ষমতায় দুর্বল হয়ে যায়। এছাড়াও বিবিসি, ভয়েস অফ অ্যামেরিকা সহ অনেক গণমাধ্যমে পূর্বপাকিস্তানের প্রকৃত পরিস্থিতি প্রচার করা হয় এবং তারা যে কতোটা শক্তিশালী ভূমিকায় আছে এই যুদ্ধে তাও প্রকাশ পায়।

কিন্তু দুঃখজনক হলো এই কমান্ডোদের মাঝে   ৮ জন শহীদ হন আর আহত হয় ৩৪ জন হন এবং ১৫ জন ধরা পড়ে পাকবাহিনীর কাছে।
সেই সাথে বাংলাদেশের  মুক্তিযুদ্ধ বহির্বিশ্বে পায় অন্যরকম পরিচিতি।
আর এভাবেই মৃত্যুকে হাতে নিয়ে এই বিশাল এক অপারেশন চালানো হয় যা বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় গৌরব আর সন্মানে সাথে লিখা আছে। এই অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জানাই অসীম সম্মান  ও শ্রদ্ধা।



বিশ্ব কাঁপানো সুইসাইডাল অপারেশন; অপারেশন জ্যাকপট। বিশ্ব কাঁপানো সুইসাইডাল অপারেশন; অপারেশন জ্যাকপট। Reviewed by সম্পাদক on বৃহস্পতিবার, মে ১৪, ২০২০ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.