ফাতেমা আক্তার মনিরা,(ঢাকা):
ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে সেই সকাল থেকে, নানু বাড়ি বেড়াতে এসেছি বেশ কয়েকদিন হলো।
টিনের চালে টুপ-টাপ বৃষ্টির শব্দ বেশ ভালোই লাগছে। জানালার পাশে বসে,দূরের ওই ধান ক্ষেতের মাঠ গুলোর দিকে তাকিয়ে আছি।
শৈশবের বেশ ভালো একটা সময় কেটেছে এই ধান ক্ষেতে খেলাধুলায়।
আশেপাশের পরিবেশ;গাছপালা,ধান ক্ষেত সব যেনো আগের মতোই আছে।
শুধু হারিয়ে গিয়েছি আমরা!
এক সাথে বড় হয়ে ওঠা কেউ-ই এখন আর একসাথে নেই। এই যে এখন বেড়াতে এসেছি, আগে যাদের সাথে সারাটাদিন কাটতো, তাদের মধ্যে এখন কেউ কেউ বড় বড় ডিগ্রি নিতে দেশের বাইরে, কেউ-বা বিয়ে করে নতুন সংসার সামলাতে ব্যস্ত!
নিজেরও ব্যস্ততার কারণে বেশি একটা আসা হয় না ছোট্ট এই গ্রামে। মাঝে মাঝে ফুরসত মিললেও দেখা হয় না একসাথে বড় হয়ে ওঠা সেই মানুষগুলোর সাথে।
তাকিয়ে আছি আমার শৈশবের সবচেয়ে প্রিয় একটা জায়গার দিকে।
জায়গাটা ঘিরে কত মজার মজার স্মৃতি ভেসে উঠছে চোখের সামনে। কত বিকেল "আলুর দম" রান্না করে নিয়ে একসাথে সবুজ ঘাসের নিচে বসে খেয়েছি।
হয়তো রান্নার স্বাদটা আজকের রান্নার মতো মুখে লেগে থাকার মত হতোনা কিন্তু সেই স্বাদে মিশে ছিলো এক অন্যরকম অনুভুতি।
আজ আমার চারপাশটা বেশ হাহাকার করছে, হারিয়ে যাওয়া সেই অনুভুতি খুজছি বারংবার।
ফজরের পর পর বেরিয়ে পরতাম খেলতে যাওয়ার জন্যে!
কত শত খেলা আর কত শত নাম! "বৌ-চি, কুমির-কুমির, ছোয়াছুয়ি, বৌ-পুতুল,এক্কা-দোক্কা"।
খেলাধুলায় এতো বেশি মগ্ন থাকতাম, কখন সকাল পেড়িয়ে দুপুর হয়ে যেতো, কখন যে সন্ধ্যা নামতো টের পেতাম না।
মা লাঠি নিয়ে ঘরে ফেরার জন্যে যখন বকাবকি করতো, খানিকটা জেদ করে মনে মনে বলতাম " শুধু বড় হতে চাই, স্বাধীনতা চাই!"
তখনও বুঝিনি বড়বেলার স্বাধীনতা আর ছোটবেলার সেই স্বাধীনতার মাঝে কত বিশাল পার্থক্য।
তখনও বুঝিনি বড়বেলার স্বাধীনতার আড়ালে যে শত শত ব্যস্ততার ভিড়!
গ্রীষ্মের ছুটি কাটতো বেশ মজায়,ছুটি শুরু হতেই ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে রওনা দিতাম চিরচেনা ছোট্ট সেই গ্রামে। যাওয়ার পথের সময় গুলোও ছিলো খুব মজার! গাড়ি দিয়ে যাওয়ার পথে, রাস্তায় থাকা গাছগুলো যখন পিছনে চলে যেতো, ভাবতাম সব গাছগুলো বুঝি আমাদের বাসায় যেয়ে জমা হচ্ছে, মাকে ধরে কান্নাও করেছিলাম একদিন, বলেছিলাম - "মা, সব গাছগুলো যদি আমাদের বাসায় চলে যায়, আমরা ফিরে এসে থাকবো কি করে"!
কি অবুজ চিন্তাভাবনা ছিলো!
গ্রীষ্মের দুপুরে,উত্তাপ সূর্যের তাপে খেলা থেকে ঘরে ঢুকেই পাকা আমের মিষ্টি জুস খাওয়ার অনুভূতি ছিলো তুলনাহীন।
নানু বাসায় চলতো কাঠাঁল খাওয়ার প্রতিযোগিতা,কে কার আগে কতটা খেতে পারে চলতো সেই প্রতিযোগিতা। আহা!প্রতিযোগিতাও ছিলো কি মজার!
বর্ষার সময় বিকেলে আম্মু বেশিরভাগ সময় গরম গরম পাকোড়া বানাতো। ঘুম থেকে উঠে চোখ ঢলতে ঢলতে পাকোড়ার ঘ্রাণে টু মাড়তাম রান্নাঘরে। " আমি বেশি খাবো" নামক প্রতিযোগিতা ছিলো ঠিক তখনও।
এখনো বর্ষা আসে, বিকেলের নাস্তা হয় আজও। ভার্চুয়াল জগতে ডুব দিলে কি ছোটবেলার সেই ঘ্রাণ নাকে আসে?
শীত মানে এখন লেপের ভেতর ঢুকে দিব্যি ঘুমানো কিংবা কয়েকশো প্রেজেন্টেশন বানানোর চাপ।
রোজা আসলেই শুরু হয়ে যেতো গণনা করার ধুম,"একটা রোজা গেলো, আর মাত্র ২৯ দিন ঈদের "!
কি সুন্দর কাউন্ট ডাউন।
প্রতিবেশীদের মাঝে ইফতার বিলানোর মতো চিত্র গুলো আজকাল দেখা যায় না। অথচ সেই সময়ে, রান্নাঘর থেকে ততক্ষণ বের হতাম না,যতক্ষণ পর্যন্ত না মা ইফতার রেডি করে হাতে ধরিয়ে বলে " যাও,ওই আন্টির বাসায় দিয়ে আসো"।
ঈদের আগের রাতটা ছিলো ঘুমহীন। কখন যে সকাল হবে, নতুন জামা পড়বো, সাজবো, ঘুরতে যাবো, সালামি নিবো এত অস্থিরতার মাঝে কি ঘুম হয়?
ঈদ তো এখনও আসে, শুধু আসে না সেই অস্থিরতা। ঘুমহীন ঈদের আগে রাত এখনো কাটে শুধু ভার্চুয়াল এক আলাদা জগতে।
সালামি এখন আর পাওয়া হয় না,নতুন জামাটাও পড়া হয় অনেকটা পরে।
আজ অবসরের একটু ফাকে, ছোট্ট বেলার সেই শহরে হারিয়ে গিয়ে বারবার বলতে ইচ্ছে করছে, আবারো যেতে চাই সেই শৈশবে ___
আমি হারিয়ে যেতে চাই সেই ছোটবেলায়,
যেখানে ছিলো না কোনো মন ভাঙ্গানোর খেলা।
যেখানে সময় গুলো কাটতো না এত অবহেলায়!
ফিরে যেতে চাই সেই ছোট্ট বেলায়,
ভেসে যেতে চাই খুশির ভেলায়।
যেই ছোট বেলায় ছিলো না কোনো মন খারাপের মেলা,
ছিলো না কোনো কাজের তাড়া,
ব্যস্ত জীবন বারবার ছুটে যেতে চায়,সেই ছোট্ট বেলায়।
আবারো যেতে চাই সেই শৈশবে।
Reviewed by সম্পাদক
on
মঙ্গলবার, এপ্রিল ২৮, ২০২০
Rating:
