মো: আবদুল্লাহ,(বগুড়া):
"সিন্ধুতাই সাপাকাল" এটি সাধারণ কোনো নাম নয়।আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা,আত্নবিশ্বাস,উদ্দীপনার শক্তি স্বরূপ বলা যায়।তিনি ভিক্ষা করেন এটাই তার পেশা শুনে অবাক হতে হয় তবে এটিই সত্যি তিনি পেশায় ভিক্ষুক হবে তিনি ভিক্ষা নিজের জন্য করেননা,তিনি ভিক্ষা করেন অসহায় অজস্র শিশুদের মুখে খাবার তুলে দিতে।
সিন্ধুতাই সাপাকাল ১৯৪৮ সালের ১৪ই নভেম্বর মহারাষ্ট্র এর ওয়ারধা জেলা পিম্প্রি মেঘে গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন।তার সংগ্রাময় জীবনী আমাদের মনে করিয়ে দেয় ইচ্ছা শক্তির দৃঢ় ক্ষমতা সম্পর্কে।তার মাতৃময়ী জীবনের রূপ শীতল করে মনকে।
সিন্ধুতাই সাপাকাল এর পিতা অভিমানজি সাঠে পেশায় ছিলেন একজন গোচারক।সিন্ধুতাই সাপাকাল পিতা-মাতার কাছে ছিলেন একজন অবাঞ্ছিত সন্তান,যার ফলে তার ডাকনাম দেওয়া হয়েছিল 'ছিন্ধি'।সিন্ধুতাই সাপাকাল এর বাবা তাকে শিক্ষিত করতে অনেক উৎসাহী ছিলেন।তিনি গোচারণেের নামে তার মেয়েকে বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার জন্য পাঠাতেন,তবে তার সামর্থ ছিলোনা তার পড়ালেখা চলমান রাখার জন্য ফলে চতুর্থ শ্রেনী পাস করার পরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের ইতি ঘটে সিন্ধুতাই সাপাকাল এর।মাত্র দশ বছর বয়সে তার বিবাহ হয়ে যায়।বিবাহের পরে তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের প্রহর।তার স্বামী তাকে শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে এবং অবশেষে তাকে ছেড়ে চলে যান এমন অবস্থায় সিন্ধুতাই সাপাকাল ছিলেন অন্তস্বত্বা।তার জীবন ভরে উঠে তিক্ততায়। আশ্রয় নেন একটি গোয়াল ঘরে। সেখানেই জন্ম হয় তার মেয়ের। খেয়ে না খেয়ে তার জীবনে যখন ধেয়ে আসে অন্ধকার প্রহর।তিনি নিজের জীবনের ইতির মাঝে প্রশান্তি খুঁজে পাবেন ভেবে আত্মহত্যার পথে মনকে স্থির করে।রেললাইন এ নিজের ইতি টানতে ছুটে যান তার মেয়েকে নিয়ে।কিন্তু হঠাৎ তার চোখ পরে ভাঙা ডাল থেকে নতুন করে ফুটে উঠা পাতার দিকে।তিনি উপলব্ধী করেন জীবন মানে সংগ্রাম।জীবনে ইতির মাঝে প্রশান্তি নেই,প্রশান্তি লুকিয়ে আছে ব্যার্থতার সাথে সংগ্রাম করে অপরাজয়ী হওয়ার মাঝে।
সিন্ধুতাই সাপাকাল জীবনের মানে উপলব্ধী করে হার মেনে নেননি,পিছু পা হননি বরং ভিক্ষা করে কোনোরকম এ তার মেয়েকে লালন-পালন করতে থাকেন।তিনি উপলব্ধী করেন তিনি এ যুদ্ধে একা নন।তার মতো অজস্র মানুষ এরকম যুদ্ধে জড়িয়ে আছে শুধু দুমুঠো খাবার এর তাগিদে।নিজের এমন দুর্বিষহ অবস্থাতে ও তিনি ঠিক করেন তিনি তার মতো অসহায়দেন পথের দিশা হবেন।তিনি এই লক্ষে মনস্থীর করে সকলের দাড়ে দাড়ে গিয়ে ভিক্ষা-সাহায্য এর আবেদন করেন।এবং সেই উপার্জন এ অসহায় বাচ্চাদের পাশে এসে দাড়ান বট বৃক্ষের মতো ছাঁয়া হয়ে।এভাবে তিনি রাস্তা থেকে অনাথ শিশুদের সংগ্রহ করে তাদের মুখে তুলে দিতে শুরু করেন খাবার।
এভাবে সিন্ধুতাই সাপাকাল অাত্মবিসর্জন দিয়ে অনাথ বাচ্চাদের বড় করতে শুরু করেন মাতৃছায়ায়।তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।যেনো অসহায় বাচ্চাদের মুখের হাঁসিই সিন্ধুতাই সাপাকাল এর অাত্নতৃপ্তি।একদিন রেল স্টেশন এ তিনি কুড়িয়ে পান একটি ব্যাগ।তিনি তা স্টেশন এ জমা দেন।ব্যাগটির মালিক তার সততা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে কিছু উপহার দিতে চান,কিন্তু সিন্ধুতাই সাপাকাল বলেন,আমার উপহার চাইনা,পারলে আমাকে একটি থাকার জন্য ঘরের ব্যবস্থা করে দেন যাতে আমি আসহায়দের জন্য একটা বট বৃক্ষের ন্যায় ছাঁয়াস্থল বানাতে পারি।এভাব তিনি গড়ে তুলেন ক্ষুদ্র পরিসরে একটি অনাথ আশ্রম যা ধিরে ধিরে বৃহৎ ব্যাপ্তি লাভ করে।অনেক এ এগিয়ে আসেন তার পাশে তার এই মহৎ কাজে নিজেকে সামিল করতে।এভাবেই গড়ে উঠে সিন্ধুতাই সাপাকালের স্বপ্নের অনাথ অসহায়দের বট বৃক্ষ।
নিজের জীবনে এত দুঃখ-বেদনা থাকা সত্বেও তিনি অনাথদের মাঝে নিজের হাসি খুঁজে নেন।তাদের জন্য নিস্বার্থভাবে কাজ করে যান।তাদের জন্য মানুষের কাছে দাড়ে দাড়ে ভিক্ষুকের বেশে হাত বাড়িয়ে দেন।নিজের সন্তানকে অন্যের কাছে লালন পালন করতে রেখে আসেন যাতে তার বট বৃক্ষের শীতল ছাঁয়ায় থাকা অনাথ বাচ্চারা কখনও এটা মনে না করেন যে সিন্ধুতাই সাপাকাল শুধু তার মেয়েকে ভালোবাসেন।এসব কিছু তিনি নিস্বার্থ ভাবে করেন অসহায়-অনাথ পথ শিশুদের মুখে অাহার তুলে দেয়ার জন্য,তাদের ছাঁয়া হবার জন্য।
এভাবে তিনি হয়ে উঠেন "দা মাদার অব অরফান"।তিনি হয়ে উঠেন অসহায় পথশিশুদের হাঁসির প্রতিচ্ছবি।আজ পর্যন্ত সিন্ধুতাই সাপাকাল ১৪০০ এর ও বেশী অনাথ শিশুকে বড় করে তুলেছেন নিজের অক্লান্ত স্নেহ-পরিশ্রমে।তার মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হয়ে এসব অনাথ শিশুদের সেবায় নিজেকে নিবেদিত করে।সিন্ধুতাই সাপাকাল এভাবে অসহায়দের নিয়ে গড়ে তোলেন স্বপ্ন পূরণ এর ভূবন।এভাবে অসহায় অনাথ পথশিশুদের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দেন সিন্ধুতাই সাপাকাল।
এই রকম নিস্বার্থ ও মহৎ কাজের জন্য সিন্ধুতাই সাপাকাল ১৯৯৬ সালে দত্তক মাতা পুরষ্কার ,২০০৮ সালে বর্ষসেরা নারী পুরষ্কার,২০১২ সালে অহল্যাবাই হোলকার পুরষ্কার,২০১৩ সালে রিয়াল হিরো,দৃষ্টান্তমূলক মায়ের জন্য জাতীয় পুরস্কার,সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য মাদার টেরেসা পুরস্কার,২০১৪ সালে বাসবা ভূষণ পুরষ্কার,২০১৫ - ২০১৪ সালের জন্য আহমদীয়া মুসলিম শান্তি পুরস্কার,২০১৮ সালে নারী শক্তি পুরষ্কার ২০১৭).....ইত্যাদি মোট ২৭৪টি পুরষ্কার অর্জন করেন।
আজ বিশ্বে সবাই করোনা (কোভিড-১৯) ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত।সবাই আজ লক ডাউন হয়ে রয়েছে সুরক্ষার জন্য।তবে দিন মজুর-অসহায় মানুষরা কি করবে?তারা কিভাবে ঘরে বসে থাকবে যেখানে তাদের দিনের রোজগাড় মানে পরিবারের মুখে খাবার!এ জন্য সিন্ধুতাই সাপাকাল তার এলাকায় সকল অসহায়দের জন্য এই দুঃসময় পাশে থাকার তাদের জন্য খাবার সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দেন।
সিন্ধুতাই সাপাকাল এর এই দৃঢ় মনোবল,অসহায়দের জন্য নিজের আত্নত্যাগ আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরনার মূর্তপ্রতিক।তার আত্মত্যাগ প্রমাণ করে দেয় অপরের কল্যান সাধনের জন্য প্রয়োজন ইচ্ছা শক্তি আর মনোবল।অর্থ- সম্পদ,ক্ষমতা কখনোই অসহায়দের জন্য ছায়াঁ হতে পারেনা,অর্থ-সম্পদ থাকলেই অসহায়দের পাশে দাড়ানো যায়না, যদিনা মনে থাকে ইচ্ছা এবং তাদের নিয়ে কাজ করার দৃঢ় মনোবল।যদি মনোবল এবং ইচ্ছা শক্তি না থাকে তবে মানুষের সেবায় নিজেকে আত্ননিয়োগ করা যায়না।নিজেকে সমাজ তথা দেশের অসহায় মানুষের জন্য অাত্মনিয়োগ করার জন্য প্রয়োজন নিস্বার্থ একটা মন।
পরিশেষে মন থেকে আন্তরিক ভালেবাসা রইলো আপনার জন্য সিন্ধুতাই সাপাকাল।
পরিশেষে মন থেকে আন্তরিক ভালেবাসা রইলো আপনার জন্য সিন্ধুতাই সাপাকাল।
'মাদার অব অরফান' সিন্ধুতাই সাপকাল; হাজার অনাথ শিশুর জন্য ভিক্ষা করেন যিনি।
Reviewed by সম্পাদক
on
বুধবার, এপ্রিল ০১, ২০২০
Rating: