জেবা সামিহা তমা,(রংপুর):
এটা ২০২০ সাল। আচ্ছা এখনো কি আমরা গল্প শোনার জন্যে বায়না ধরি? কিশোর-কিশোরী বায়না ধরবে না কিন্তু শিশুরা? না, করে না। বিংশ শতাব্দী অর্থাৎ প্রযুক্তির যুগে শিশুরা গল্প শোনার জন্যে বায়না করে না। একটা ইলেকট্রনিক ডিভাইস হাতে ধরিয়ে দিলে শিশুরা শান্ত। কিন্তু ডিভাইসে কি করে? গল্পের ভিডিও দেখে আনন্দিত হয়। আচ্ছা কোন গল্প? সৎ কাঠুরে গল্প বা কাকের তৃষ্ণা মিটানোর গল্পের ভিডিও বা রাখাল বালকের গল্প বা খেঁকশিয়ালের আঙ্গুর ফল খেতে না পারার গল্প।
এই গল্পগুলো আপনারা বড়দের মুখে শুনেছেন বা পাঠ্যবইয়ে পড়ে বড় হয়েছেন। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে না এই গল্পগুলোর জনক কে? এর উত্তরটা আমরা বেশিরভাগই জানি। ' ঈশপ ' ইতিহাস আবার এই মানুষটিকে ' এসপ ' বলে থাকেন। ' ঈশপ ' আমাদের বাঙ্গালির করা উচ্চারণ। আজকে শুনি ঈশপের গল্প।
ঈশপের জন্মস্থান নিয়ে এখনো বির্তক রয়ে গেছে। তবে ইতিহাসবেত্তাগণ মনে করেন দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের থ্রেস অঞ্চলে ক্রীতদাস পরিবারে খ্রিস্টপূর্ব ৬২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। থ্রেস বর্তমানে গ্রীস ও তুরষ্কের মধ্যবর্তী একটি অঞ্চল। তবে ঈশপ গ্রিক লেখক হিসেবেই পরিচিত। মানব শিশু হয়ে জন্মানোর পর মানুষ হয়ে ওঠার জন্যে যেসব নীতিকথা আমাদের প্রয়োজন ঈশপ সেসব নীতিকথাগুলোকে গল্পে বন্দী করতো। কল্পনাপ্রিয় মানুষদের কাছে ঈশপ অনেক প্রিয় কারণ ঈশপ ছিলেন উপকথার জনক এবং সে চমৎকার ভঙ্গিতে সেসব উপকথা মানুষের কাছে উপস্থাপন করতেন। উপকথা হলে সাহিত্যের একটি ধরন, যাতে বিভিন্ন প্রাণী,কিংবদন্তিতুল্য সৃষ্টি, উদ্ভিদ, জড় বস্তু এবং প্রাকৃতিক উপাদানকে মানুষের ক্ষমতা প্রদান করা হয় (যেমন মানুষের ভাষায় কথা বলা) এবং তাদের জবানিতে গদ্য বা পদ্য ছন্দে ছোট কাল্পনিক গল্প বিবৃত হয়। এবং এই গল্পগুলোর পরিণতিতে একটি বিশেষ নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতেন ঈশপ, যা তাকে এখনো অমর করে রেখেছে। খ্রিস্ট-পূর্ব ষষ্ঠ শতকে ঈশপ যখন এসব উপকথা মুখেই রচনা করতেন তখন মানুষের মুখে তার জয়গান এবং উপকথাগুলো উচ্চারিত হতো। এরপর গ্রীক ও রোমান লেখক ঈশপের উপকথাগুলোকে গদ্যের মাধ্যমে লিখিত রূপ দেন। ইন্দো-ইউরোপিয়ানরা এ অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করায় তাদের মুখের গল্পেই হয়তো ঈশপের পরিচিতি এ অঞ্চলে হয়েছে তবে খ্রিষ্ট পরবর্তী চতুর্থ শতকে ভারতীয় লেখক বিষ্ণুশর্মা ল্যাটিন ভাষা থেকে সংস্কৃত ভাষায় উপকথাগুলো অনুবাদ করেন। এরপর আরও অনেকেই ঈশপের উপকথা বা গল্পগুলো অনুবাদ, সংস্করণ করে লিখিত রূপ দেন।
ঈশপের জীবন রহস্য এখনো সমাধান করা সম্ভব হয়নি। তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় এশিয়ার মাইনর উপকূলের নিকটবর্তী সামোস দ্বীপে দাসত্বজীবনে আবদ্ধ ছিলেন। জান্থাস নামের এক ব্যক্তিকে তার প্রভু হিসেবে অনুমান করা হয়। দাস হয়ে থাকা সত্ত্বেও ঈশপ তার প্রভুর সহকারী হিসেবে আবির্ভূত হতেন। তৎকালীন আদালতে তিনি তার সহজাত উপকথা বলার দক্ষতা ও বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তিসঙ্গতা নিরূপণ করতে পারদর্শীতা দেখান। বলা হয়ে থাকা যে ঈশপ ফ্রিজিয়া থেকে এসেছেন এবং তিনি গ্রীক দাস ছিলেন। বিভিন্ন ব্যক্তিকে প্রভু মেনে তাদের সেবা করেছেন। ঈশপ সামোসের সামিয়ান ইয়াদমন নামীয় এক প্রভুর ক্রতীদাস ছিলেন এবং পরবর্তীতে তার থেকে মুক্তি লাভের মাধ্যমে তিনি তার দাসত্ব জীবনের ইতি করেন। মতান্তরে ঈশপকে তার দ্বিতীয় প্রভু জ্যাডমন তার গুণকে ঈশ্বর প্রদত্ত বলে তা চর্চা করার জন্যে তাকে মুক্ত করে দেন। এরপর ঈশপ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে তার গল্প শোনাতে থাকেন এবং মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে থাকেন নীতিবাক্য। যত দিন যায় ঈশপের জনপ্রিয়তা তত বাড়তেই থাকে। লোকমুখে ঈশপের সুনাম শুনে লাইডিয়ার রাজা ক্রোসাইসের তার দরবারে ঈশপকে আমন্ত্রণ জানালে ঈশপ তা গ্রহণ করেন। রাজা তার ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিমত্তা যাচাই করেন মুগ্ধ ও আশ্চর্য হয়ে তাকে সভাসদ হিসেবে নির্বাচিত করেন এবং মানুষের মাঝে নৈতিকতা বিস্তারে ঈশপকে বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেন।
খ্রিস্ট-পূর্ব ৫৬০ এর কথা রাজা ক্রোসাইস অন্য সভাসদগণ ঈশপকে হিংসা করতে শুরু করেন। তারা ঈশপের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন। সভাসদগণের কথা শুনে রাজা ক্রোসাইস ঈশপকে ডেলফিতে পাঠায় রাজার হয়ে ডেলফিবাসীদের স্বর্ণমুদ্রা দেয়ার জন্যে। ডেলফিতে দেবতা অ্যাপোলোর মন্দির ছিলো বলে ডেলফির মানুষদের মধ্যে একটা অহংকার বিরাজ করতো। রাজা ক্রোসাইস ভেবেছিলো ঈশপ স্বর্ণমুদ্রা দেয়ার মাধ্যমে গল্প শুনিয়ে তাদের মধ্যে নৈতিকতা ছড়াতে পারবে। স্বর্ণমুদ্রা কে কতটা নিবে তা বিশাল হট্টগোল বেঁধে যায় ডেলফিতে। এই হট্টগোলকে রাজা ক্রোসাইসের চরম অবমানোনা মনে করে স্বর্ণমুদ্রা বিতরণ না করে ঈশপ ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। অহংকারী ডেলফিবাসী ঈশপের এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। তখন ডেলফির কিছু পুরোহিত অ্যাপোলো মন্দিরের রূপার তৈরি একটা পেয়ালা লুকিয়ে ঈশপের থলিতে রেখে দেন। পরবর্তীতে ঈশপ যখন ডেলফি ছেড়ে চলে আসছিলো তখন তাকে চোর সন্দেহে তার থলেতে তল্লাশি চালিয়ে রূপার পেয়ালা খুঁজে বের করা হয়। অ্যাপোলো মন্দির ডেলফিতে অনেক পবিত্র বলে মনে করা হয়। পবিত্র মন্দিরের জিনিস চুরির অপরাধে ঈশপকে ডেলফিবাসী পাহাড় থেকে নিচে ধাক্কা দিয়ে হত্যা করে।
ইতিহাসবেত্তা অ্যারিস্টটল, হিরোডোটাস ও প্লুটার্ক ঈশপের মৃত্যুর নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করেনি। তবে অনেক লেখক উপরোক্ত ঘটনাটিকে ঈশপের মৃত্যুর কারণ বলে মনে করেন। হতেই পারে জনপ্রিয়তার কারণে ঈশপের প্রতি যাদের হিংসা জন্ম নেয়া শুরু করছিলো তাদের ক্রোধের ফল ঈশপের নির্মম মৃত্যু।
ঈশপ মৃত্যু তার গল্পের জনপ্রিয়তাকে রুখতে পারেনি। এতবছর পরেও পুরো বিশ্বে ঈশপের গল্প এখনো জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ঈশপ তার কর্মের জন্যে হয়েছেন অমর। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে তার নাম। ঈশপের গল্প শুধু শিশুদের জন্যে নীতি শিক্ষায় আবদ্ধ নেই প্রচলিত প্রবাদ বাক্যেও রয়েছের তার ছোঁয়া। বর্তমান যুগে যেভাবে মানুষ ধীরেধীরে নৈতিকতা বিসর্জনে মেতে উঠছে তাতে করে আমার ঈশপকে অনেক মনে করে। বা বলতে পারেন ঈশপের গল্প বলার এবং গল্প রচয়িতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। হয়তো কোনো একসময় ঈশপের গল্প থেকে নীতি ছড়ানোর যাদু হারিয়ে যাবে তখন অনুভূতিহীন ভাবে বা নিজ স্বার্থে ঈশপের গল্পগুলো উচ্চারিত করবে মানুষের মধ্যে নৈতিকতা।
মনে পড়ে 'ঈশপ' কে?
Reviewed by সম্পাদক
on
মঙ্গলবার, মার্চ ২৪, ২০২০
Rating: