-->

গল্প: ঘোর।


গল্প: ঘোর।
লেখা: সৌহাত রাশেদিন সৌখিন,(রংপুর)



প্রায় প্রতিদিনেই ছোটবোনের ধাক্কাধাক্কিতে সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গে আমার। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না ।
প্রতিদিনেই ছোটবোনের এই রকম বড় বড় অত্যাচার সহ্য করতে হয় আমায়।
অত্যাচার গুলোকে বড় বললেও ভুল হবে রীতিমত এক গ্যালাক্সি সমান অত্যাচার। এই অত্যাচারে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা। মনে হয় আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার জন্য সে মাইনে পায়।

কাল রাতে চুপিচুপি ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম।কেন জানি বৃষ্টি আমাকে
অসম্ভব রকম কাছে টানে। রাত প্রায় ১২টার দিকে কাকভেজা হয়ে রুমে আসলাম।
চোখ জ্বালাপোড়া করছিল। এখনেই শুয়ে পরলে রিপভ্যান উইংকেল এর মতো এক ঘুমে রাত কাবার করে দেওয়া যেত।
কিন্তু কেন জানি রিপভ্যান উইংকেল এর মতো ঘুমাতে ইচ্ছে করল না। প্রায় জোর করে জানালার ধারে বসে রইলাম। উঠানের হাসনাহেনা ফুলের গাছটা তীব্র সুবাস ছড়িয়ে অন্ধকারের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিলো। বৃষ্টি ভেজা হাসনাহেনার মাতাল করা অন্যরকম সুবাসের নেশায় বুঁদ হয়ে রইলাম কিছুক্ষণের জন্য।
ইতিমধ্যে চোখ বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিয়েছে। বারবার বন্ধ হয়ে আসছে। সব কৃত্রিম বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রন করা যায় , কিন্তু প্রকৃতির বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব নয়। প্রকৃতি আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং আমাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য একেবারে উঠে-পরে লেগেছে। আমার চোখ আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে আসছে। আমি আর জেগে থাকতে পারছি না। ইচ্ছে করছে জানালার ধারেই ঘুমিয়ে পড়ি। মানুষের মন বড়ই আজব! একটু আগে যে মন ঘুমাতে সায় দিল না সেই মন এখন বলছে   "কয়েক রাতের জন্য রিপভ্যান হয়ে যাও সমস্যা নেই!" অগ্যতা রিপভ্যান হতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। একটু শীত শীত করছে কিন্তু কম্বলটা টেনে যে গায়ে দেবো তার আর ইচ্ছা করছে না। চোখ বন্ধের সাথে সাথে আমি ঘুমের সাগরে তলিয়ে গেলাম।

ঘুমের মধ্যে কি জেনো একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। বোনের ধাক্কাধাক্কিতে স্বপ্নটা শেষ না হতেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।আচমকা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে কি স্বপ্ন দেখছিলাম তার বিন্দু মাত্র মনে নেই।অথচ স্পষ্ট মনে আছে আমি স্বপ্ন দেখেছি।স্বপ্নটা কি ছিল সেটা মনে করতে না পেরে মনটা খুব খচখচ করছে।জাঁদরেল বোনটার কান ইচ্ছেমতো মলে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু আম্মুর জন্য তা করাও যাবে না।

কিছুক্ষণ পর...
বিশিষ্ট নালিশকারী শোভা (আমার জাঁদরেল ছোটবোনের নাম) এসে নাকি সুরে আম্মুর কাছে নালিশ করতে লাগল “মাঁআ ভাঁইয়া এঁখনো বিঁছানা থেঁকে নাঁমে নিঁ।”
আম্মু রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল “ইবু তারাতারি হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়।”

দুঃখিত আপনাকে তো এখনো বলাই হয় নি "ইবু" আমার ডাক নাম। আসলে আমার নাম ইব্রাহীম। এই ইব্রাহীমই কি করে যে "ইবু" হয়ে গেল তা আমার জানা নেই।

সে কথা থাক এখন গল্পে ফিরে আসি।
আমি তারাতারি বিছানার মায়া ত্যাগ করে হাতমুখ ধুয়ে খেতে গেলাম। মাত্র একটু রুটির টুকরো মুখে দিয়েছি তখন বুঝলাম।আমার মুখ খেতে চাইছে না। মুখটা তেতো হয়ে গেছে। অ্যাঁ! জ্বর হলো নাকি? না!  জ্বর হলে সেটা মোটেই ভালো হবে না। জ্বরের কথা মা শুনলেই একটা হুলুস্থুল আয়োজন শুরু করবেন আমার জ্বর সারানোর জন্য। যত তারাতারি সম্ভব মা কিছু বোঝার আগেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হবে।
আমি স্কুলের যাওয়ার জন্য খুব তারাতারি বাসা থেকে বের হয়ে এলাম।রিকশায় উঠেই বুঝলাম মাথাটা বিচ্ছিরি রকম ব্যাথা করছে।স্কুলে পৌঁছে আমাদের ক্লাসের একদম শেষ ব্রেঞ্চ বসে ব্যাগের উপর মাখা রাখলাম। অদ্ভুতভাবে আমি ঐ মুহূর্তেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
"চটাশ" "চটাশ" "উহ!" শব্দে আমার ঘুম ভাঙ্গল। তাকিয়ে দেখি রাতুল অঙ্ক স্যারের সামনে রক্তশূন্য চেহারা নিয়ে হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে আর স্যার তাঁর চার নম্বরি বেতটার সদ্ব ব্যবহার করছেন। অঙ্ক স্যার ভয়ংকর রকম পেটাতে পারেন। যদিও সরকার শিক্ষার্থীদের পেটানো নিষিদ্ধ করেছেন। তবুও স্যার আমাদের বলদের মতো পেটান। স্যারকে কখনো বেত ছাড়া দেখা যায় নি। এমনকি বাজারে গেলেও নাকি সঙ্গে করে বেত নিয়ে যান। বাজারে কোন ছাত্রের দেখা পেলে বেতটার ভালোরকম ব্যবহারিক দিক দেখা যায়। স্যার নাকি তার চাকরির প্রথম দিনেও বেত নিয়ে স্কুলে এসেছিলেন। এক কথায় অঙ্ক স্যারকে বেত ছাড়া কল্পনা করাও অসম্ভব। স্যারের এই অন্যতম গুনের জন্য তিনি ছাত্র সমাজে "গুন্ডা স্যার" নামে ব্যাপক পরিচিত।
স্যারের মেজাজটা মনে হয় আজ খারাপ তাই রাতুলকে পেটাচ্ছেন। রাতুল আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্র। এর আগে অঙ্ক স্যার কি? কোন স্যারই রাতুলকে একটা ফুলের টোকা দেন নি। বরং অঙ্ক স্যারের প্রিয় ছাত্র রাতুল। সেই রাতুল কিনা আজ বেধম পিটুনি খাচ্ছে তাও আবার অঙ্ক স্যারের হাতে! রাতুলে চোখ ছলছল করছে। এই বুঝি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবে।
তক্ষুনি ঘন্টা পড়লো আর স্যার ক্লাসে সবার দিকে খটমট করে তাকিয়ে চলে গেলেন। স্যার বেড়িয়ে যেতেই ক্লাসটা মাছের বাজারে পাল্টে গেল। এই মাছের বাজারের মাছ , না মানে কেন্দ্রবিন্দু হলো রাতুল। রাতুল চুপচাপ তার জায়গায় বসে আছে। সবাই আরচোখে রাতুলকে দেখছে আর একে অন্যের সাথে কানাকানি করছে। ক্লাসের কয়েকজন দরদী রাতুলকে সান্তনা দিতে গেল। এই সান্তনা রাতুল সহ্য করতে পারল না এইবার সত্যিই হাউমাউ করে কেঁদে দিল। সকলেই তখন রাতুলে কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
আর আমি ভাবতে লাগলাম পুরো একটা ক্লাস পিরিয়ড আমি ঘুমিয়ে কাটালাম! অঙ্ক স্যার যদি দেখত তাহলে খবর হয়ে যেত। ভাগ্যিস পিছনে বসেছি তাই স্যার দেখতে পারে নি। নাহলে রাতুলে যায়গায় এখন আমাকে কাঁদতে হতো।
ব্রেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। আমি আবার বসে পরলাম। মুগ্ধ আমার পাশে বসেছে। মুগ্ধ আমাদের ক্লাসের কবি। এই বয়সেই মুগ্ধ অনেক পাকনা পাকনা বড়দের কবিতা লিখে ফেলেছে। "অপূর্ব সরকার" ছদ্দনামে মুগ্ধর বেশ কয়েকটা কবিতাও পত্রিকায় বেরিয়েছে। মুগ্ধকে আমরা সবাই সুকান্তের ডুপ্লিকেট কপি বলে ডাকি। এতে অবশ্য সে রাগের বদলে খুশিই হয় কিন্তু সেটা বুঝতে দেয় না।   মুগ্ধর সাথে গল্প করতেছি হঠাৎ দেখি মুগ্ধর চেহারা এক পলকের মধ্যে পাল্টে কবি সুকান্তের চেহারা হয়ে গেছে। কি সর্বনাশ! সুকান্ত রূপি মুগ্ধ আমাকে বলতেছে "দোস্ত একটা নতুন কবিতা লিখেছি দেখবি?" ঠিক তখনি হেডস্যার ক্লাসে ঢুকলেন সাথে সাথে পুরো ক্লাস একসাথে চেঁচিয়ে "আসসালামু ওয়ালাইকুম স্যার" বলল।
স্যার আমাদের একনজর দেখে, ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে বইপড়া কর্মসূচি না কি জেনো একটা হবে, সেটা নিয়ে লম্বা বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন। আমরা সবাই স্যারের কথা মনযোগ দিয়ে শুনছি।  হঠাৎ খেয়াল করলাম হেডস্যারের চেহারা পাল্টে আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ স্যারের মতো হয়ে গেছে। স্যার কিছুক্ষণ বক্তৃতা দিয়ে চলে যাওয়ার সাথে সাথে বাংলা স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। আর কি আশ্চর্য বাংলা স্যার এর চেহারা পাল্টে হুমায়ূন আহমেদ এর মতো হয়ে গেছে। আর আমাদের ক্লাসের প্রতিজনের চেহারা পাল্টে "মার্ক টোয়েন,সুকুমার রায়,আনিসুল হক,জসীম উদ্দিন,রবীন্দ্রনাথ,নজরুল,জীবনানন্দ,শরৎচন্দ্র,সেকশপিয়ার,নির্মেলেন্দু গুণ,হুমায়ন আজাদ,জাফর ইকবাল" ইত্যাদি দেশী-বিদেশী কবি-স্যাহিত্যিক এর চেহারা হয়ে যাচ্ছে। আমি হতভম্ব হয়ে বসে সকলকে দেখছি। মাথা ঝিমঝিম করছে। রাতের স্বপ্নটা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। কাল রাতে ঠিক এই স্বপ্নটাই দেখেছি আমি! এই স্বপ্নটাই! স্বপ্ন আর বাস্তব এতো মিলে যাচ্ছে কি করে? নাকি আমি এখনো ঘুমের মধ্যে আছি স্বপ্ন দেখছি? মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনা শুরু হয়েছে প্রচন্ড যন্ত্রনা। মাথাটা ভারী হয়ে গেছে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তারপর বিকট একটা চিৎকার করে আমি ভরা ক্লাসের মধ্যে জ্ঞান হারালাম।

যখন জ্ঞান ফিরলো…
চেয়ে দেখি আমি বাড়িতে আমার বিছানায় শুয়ে আছি আমার মাথার পাশে আম্মু বসে কাঁদছে আর আমার মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। পাশের ঘর থেকে ছোটবোন শোভার কোরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ আসছে। নিশ্চই পাগলিটা আমার সুস্থতার জন্য কোরআন খতম দিতে বসেছে।
কি অদ্ভুদ! আম্মুর চেহারাও পাল্টে সেলিনা হোসেনের চেহারা হয়ে গেছে কি অদ্ভুত! কি আশ্চর্য!
গল্প: ঘোর। গল্প: ঘোর। Reviewed by সম্পাদক on বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ১৪, ২০১৯ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.