-->

গল্প: রূপাদের স্বপ্ন।


গল্প: রূপাদের স্বপ্ন
লেখা: উম্মে ফাতেমা মেধা,(কুুমিল্লা)

আগে রুপা আর আমি একই গ্রামে থাকতাম। জেএসসি পরীক্ষার পর বাবার ট্রান্সফারের কারণে আমাকে মফস্বলে চলে আসতে হয়। কিন্তু ইদ বা যেকোনো বন্ধে যখন গ্রামের বাড়ি যেতাম, রূপাই ছিলো আমার সময় কাটানোর সঙ্গি। কতো ধরনের খবর যে পেতাম রূপার কাছে। তার কাছেই আমি প্রথম জানতে পারি টেলিপ্যাথি, টেলিকাইনেটিক্স এসব সম্পর্কে। টেলিপ্যাথি নাকি এমন এক ক্ষমতা যার দ্বারা কেউ মনে মনেই অন্য কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারে। অনেকের ধারণা প্রাচীনকালে যখন ভাষা আবিষ্কার হয়নি তখন মানুষ একে অপরের সাথে এভাবেই যোগাযোগ করতো। কিন্তু বিজ্ঞান এই ক্ষমতাকে সমর্থন করে না। বিজ্ঞানিরা বলে এ ক্ষমতা কাল্পনিক, বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। তবু অনেক মানুষ বিশ্বাস করে এই ক্ষমতা আছে। কেউ কেউ বলে, কোনো ঘটনা ঘটার আগেই নাকি সে টের পেয়ে যায় কিংবা তার অনুভব হয় কিছু একটা ঘটবে। একে বলা হয় Intuition, বাংলায় যুক্তিতর্ক বা বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই কোনো কিছুর অব্যবহিত জ্ঞান। 
এতো জ্ঞানের কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে রূপাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুই এগুলো কোত্থেকে জেনেছিস? 
-একটা বই থেকে পড়েছি। তুই পড়বি বইটা?
-না না। আমার পড়তে একদম ভালো লাগে না।
-আমার বই পড়া খুব পছন্দ। আমি যখন খুব বড় কিছু হয়ে যাবো তখন আমি শুধু বই কিনে পড়বো।
সেবার বাসায় ফিরে যাওয়ার পর আমিও একটু একটু করে বই পড়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু যতকিছুই করি বইয়ে আমার মন বসে না। ভেবে রেখেছিলাম পরবর্তীতে আবার যখন গ্রামে যাব রূপার কাছ থেকে বইয়ে কিভাবে মন বসাবো তার পদ্ধতি জেনে নিবো। কিন্তু পরবর্তীতে যখন আমি গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাই তখন এক নির্মম ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারি। রূপাদের পরিবার তেমন স্বচ্ছল না। রূপার বড় দুই ভাইয়ের একজন শহরে চাকরি করতে গিয়ে পরিবারের আর কোনো খোঁজই রাখে না। অন্যজন গ্রামের কলেজে পড়ে।রূপার ছোট ভাই প্রাইমারিতে পড়ে আর ছোট বোন তখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। একসাথে এতোজনের ভরণপোষণ, পড়াশোনা করানো তার বাবার পক্ষে সম্ভব না। তাই তিনি রূপাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। এ ঘটনা জানার পর আমার প্রচন্ড মন খারাপ হয়। আমি বাবার কাছে আবদার করি রূপাকে দেখতে যাবো। বাবা প্রথমে রাজি হয়নি কিন্তু আমার মন খারাপ দেখে আমাকে সেখানে নিয়ে যায়। আমার এখনও মনে আছে, রূপা আমায় দেখে আগের মতো দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেনি। মলিন মুখে জোর করে একটি হাসি ফুটানোর চেষ্টা করেছিলো। আমি ওকে বললাম, 
-তুই কি আর পড়ালেখা করবি না?
-আমার আর বড় হওয়া হবে না। আমার পড়ালেখা করাও আর হবে না।
-তুই আমাদের সাথে চলে আয়।
আমার এই কথা শুনে রূপা শুষ্ক মুখে একটু হাসলো। সেদিন বাড়িতে ফিরে আমার বার বার রূপার কথা মনে পড়ছিলো। গ্রামের সাধারণ একটা মেয়ে হয়েও ওর কতো প্রতিভা, কতো জ্ঞান! ওর পড়ার শখ, বড় কিছু হওয়ার শখ। অথচ তার কোনো স্বপ্নই পূরণ হবে না? আমার কানে রূপার কথাগুলো বাজছিলো। তার কথায় যে কান্না, যে কষ্ট ঝড়ে পড়েছে তা আমি কোনোভাবেই ভুলতে পারছিলাম না। তার শুষ্ক মুখের কথা ভেবে চোখের পানি আমি আটকে রাখতে পারিনি। ও যে আমার খুব ভালো বন্ধু। এক পর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে গিয়ে বললাম,
-বাবা, আমাদের কি কিছুই করার নেই রূপার জন্য?
-না রে মা।
-রূপা পড়তে খুব ভালোবাসে বাবা। চলো আমরা ওকে নিয়ে আসি।
- ওর বাবা মা, আত্মীয়স্বজন ত সেটা মানবে না।
-কিন্তু ওরা রূপার প্রতি অন্যায় করেছে।
-আমরা এখন কিছুই করতে পারবো না। যখন ওকে বিয়ে দিচ্ছিলো তখন যদি কেউ এর প্রতিবাদ করতো তাহলে হয়তো আজ ওর স্বপ্নগুলো এভাবে ভেঙ্গে যেত না।
-কেউ প্রতিবাদ করেনি কেন?
-কারণ গ্রামের অশিক্ষিত মানুষের কাছে ছোট মেয়েটিকে বিয়ে দেওয়া খুবই সাধারণ বিষয়। তাদের কাছে রূপার স্বপ্নের কোনো মূল্য নেই রে মা।
আমি কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বললাম, রূপার প্রতিভা এভাবে হারিয়ে যাবে আমি মানতে পারছি না বাবা। কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। তুৃমি প্লিজ কিছু করো। 
বাবা আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন, আরও অনেক অনেক রূপার স্বপ্ন, সম্ভাবনা এভাবেই শেষ হয়ে যায়। তাদের জীবনের ছন্দ হারিয়ে যায়। আমি এর জন্য একা কিছুই করতে পারবো না। কিন্তু তুই, আমি, এই গ্রাম, আমরা সবাই, যদি এগিয়ে আসি তাহলে ওদের স্বপ্নগুলো পূরণ হবে। ওদের সম্ভাবনা সত্য রূপ নেবে। ওরাও একদিন বড় হতে পারবে।

গল্প: রূপাদের স্বপ্ন। গল্প: রূপাদের স্বপ্ন। Reviewed by সম্পাদক on বুধবার, অক্টোবর ০৯, ২০১৯ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.