"গবেষণায় চিকিৎসা"- শফিয়ার রহমান।
বিশেষ প্রকাশনা:
কেউ অসুস্থ হলে ডাক্তার এর কাছে যান। ডাক্তার রোগীর সমস্যা শুনে, দেখে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। সুনিশ্চিত হওয়ার জন্য রক্ত, মল-মূত্র, এক্সরে, ইসিজি, আল্ট্রাসনো ইত্যাদি প্রয়োজন অনুসারে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য ল্যাব এ পাঠান। ল্যাব এর রিপোর্ট, নিজের শোনা ও দেখার ভিত্তিতে দাযিত্ববান চিকিৎসক রোগ নির্ণয় করে রোগীকে সুচিন্তিতভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র দেন।
জটিল রোগীর কোনো প্রতিনিধি যদি ডাক্তার এর কাছে গিয়ে রোগীর জন্য ঔষধ লিখে চান, সেক্ষেত্রে ডাক্তার এর পক্ষে চিকিৎসা দেয়া অসম্ভব। ধরুন, এমতাবস্থায় ডাক্তার নিরুপায় কিংবা অতি উৎসাহী হয়ে ঔষধ লিখে দিলেন, এক্ষেত্রে এ অনুমান নির্ভর চিকিৎসা রোগীর রোগ নিরাময়ে কতটুকূ ফলপ্রসূ হবে তা নিশ্চিত করে বলাও অসম্ভব। আমি তো মনে করি এক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হওয়ায় সমূহ সম্ভাবনা থেকেই যায়।
অনুমান ভিত্তিক চিকিৎসায় কাজ না হলে একজন রোগীর ক্ষতি হবে। একটি পরিবার নানা দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। অনেক সময় তাতে দেশের সাময়িক ক্ষতি হতে পারে।
প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা দিয়েই শিশুর শিক্ষা শুরু ৷ প্রাথমিক শিক্ষা ছাড়া মাধ্যমিক শিক্ষা সম্ভব না ৷ এই সময় শিক্ষার্থীরা প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হলে তার প্রভাব পরবর্তী স্তরে পড়বেই ৷ সুস্থ-সবল শিশুর জন্ম না হলে সেই জাতি উৎপাদনশীল ও সৃজনশীল নাগরিকহীন হবে ৷ আর সুস্থ শিশুর জন্য সুস্থ মা জরুরি ৷ একমাত্র সুস্থ মায়ের গর্ভে সুস্থ শিশু জন্ম লাভ করতে পারে ৷ গর্ভকালীন মা'দের রাখা ও পুষ্টির অভাব পূরণের জন্য সকলেই সচেতন ৷
শিশুর শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গর্ভধারীনি মা ৷ ওই মা সুস্থ্ সবল হলে এবং পুষ্টিহীনতায় না ভুগলে সুস্থ সন্তান জন্ম দিবে ৷ আর যদি পুষ্টিহীন , প্রতিবন্ধী কিংবা অটিস্টিক সন্তান জন্ম দেয় , সেক্ষত্রে তাদের কর্মঠ নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলা অতি কষ্টের ও ব্যয়বহুল ৷ প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরাসরি সরকারি তদারকির মধ্যে রাখা গুরুত্বপুর্ণ ৷ কিছুদিন পূর্বেও এদেশে প্রশিক্ষণবিহীন ধাত্রীরা সন্তান প্রসব করাতেন ৷ এতে অনেক মা ও শিশু অকালে ঝরে যেত ৷ এক্ষেত্রে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি ৷ এখন প্রশিক্ষিত নার্স , ডাক্তারগণ সন্তান প্রসব করান ৷ ফলে মা ও শিশুর মৃত্যুহার কমে গিয়েছে ৷ কিন্তু মজার ব্যাপার প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্টো অবস্থা ৷ প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দোকান ছড়িয়ে পড়েছে ৷ উদ্দেশ্য হলো মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে রুটি-রুজির ব্যবস্থা করা। এই শিশুদের জন্য বয়স উপযোগী কতটুকু শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন তার কোনো বালাই নাই ৷ রোগীর অভিভাবকের ইচ্ছামত চিকিৎসা চলে অনেক প্রতিষ্ঠানে ৷ অভিভাবকের ইচ্ছামত প্রতিষ্ঠান না চালালে ব্যবসায় মুনাফা অর্জন সম্ভব নয় ৷ দেখা যায় প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণিতেই ১০ থেকে ১৮ টি বই পড়াচ্ছেন ৷ বছর শেষে অধিকাংশ শিশুই বইগুলোর নাম পর্যন্ত বলতে পারে না ৷ গ্রাম্য ধাত্রীর তত্বাবধানে সন্তান প্রসব চলছেই ৷ সারাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা সময়ের দাবি।
মাধ্যমিক শিক্ষা প্রাথমিক শিক্ষা ও উচ্চ শিক্ষার সেতু। সেই সেতু যদি ভেঙ্গে যায় বা দুর্বল হয়, সেই ক্ষতি উচ্চশিক্ষায় কতটা পুষিয়ে নিতে পারবে তা বুঝতে অসুবিধা হবে না।
মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর রোগী হলে রোগ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসক প্রয়োজন। রোগ নিরাময়ের জন্য চিকিৎসক চিকিৎসা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। চিকিৎসক রোগীর কাছে বর্ণনা শুনে বা দেখে অর্থাত্ মাধ্যমিক স্তরের উপর গবেষণা করে ব্যবস্থাপত্র দিবেন। বাস্তবে রোগী দেখে, শুনে এবং বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা (গবেষণা) ছাড়াই চিকিৎসা চলছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ কখনও ছাত্ররা মানববন্ধন করছে, শিক্ষকগণ, শিক্ষাবিদ সমস্যা তুলে ধরছেন। সমস্যার কারণ উদঘাটন ও সমাধানের দিকগুলো মাঠ পর্যায় থেকে যাচাই বাছাই না করে নিরাময় করা কঠিন। একেক সময় একেক রকম ঔষধ প্রয়োগ হচ্ছে। ফলে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক, শিক্ষার্থী বিভিন্ন ধরণের সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। আপাত:দৃষ্টিতে শিক্ষকগণই দায়ি হচ্ছেন। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে।
মাধ্যমিক স্তরকে সুস্থ্-সবল ও দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করতে হলে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষা ভাবুকগণকে নিয়ে মাধ্যমিকের শিক্ষক দ্বারা গবেষণা করলে মাঠ পর্যায়ের ক্ষতগুলো চিহ্নিত সহজ হবে, সমাধানের পথগুলো বাস্তবসম্মত ও প্রায়োগিক হবে।
চিকিৎসারত রোগীর উন্নতি দৃশ্যমান না হলে, রোগীর অভিভাবকগণ হতাশ হয়ে পড়েন, ডাক্তার পরিবর্তন করেন। এরপরও অবনতি হতে থাকলে বা আরোগ্য লাভের সম্ভাবনাই নেই, এরকম মনে হলে অভিভাবকগণ হতাশ হয়ে পানিপড়া, ঝারফুক, তাবিজ ইত্যাদিরও আশ্রয় নিয়ে থাকে। এককথায় চিকিৎসকের উপর আস্থা হারালে যে যা করতে বলে তাই করার চেষ্টা করে।
শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর অভিভাবকগণ দিন দিন আস্থা হারাচ্ছেন। সে কারণে অভিভাবকগণ সন্তানদের বিভিন্ন দোকান ও দোকানদার এর কাছে শিক্ষার জন্য পাঠাচ্ছেন।দিন দিন ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে পর্যাপ্ত মূলধন বিনিয়োগ করে, আকর্ষিত করার ভিন্নমুখী উপায় অবলম্বন করে নতুন নতুন দোকান খোলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমস্যার সমাধান নেই, অন্যদিকে দোকান বন্ধের কথা বলা হচ্ছে আবার নিবন্ধনও দেযা হচ্ছে। কী বাজে অবস্থা!
সারা দেশে কত শিক্ষার দোকান নিবন্ধিত হয়েছে, কত অনিবন্ধিত আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান আছে মনে হয় না। শিক্ষার দোকানগুলোর দোকানদার কারা তাদেরও সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর। দোকানদাররা অধিকাংশ শিক্ষক নন, তা ঠিক। কিন্তু প্রচারণার সময় দেখা যায় যে শিক্ষকগণই দোকানদার। ফলে ঢালাও ভাবে শিক্ষকগণকেই দায়ি করা হচ্ছে।
ঔষধের দোকানের লাইসেন্স দেয়ার আগে দোকান চালানোর মত যোগ্যতা আছে কি না তা যাচাই করা নিয়ম। কিন্তু শিক্ষার দোকানের নিবন্ধন দেয়ার সময় তা যাচাই করা হচ্ছে না। ফলে শিক্ষা দোকানে দোকানদার শিক্ষার্থীদের ঠিকমত পড়াতে পারছে কি না, ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা কত হলে দোকানদারির অনুমতি পাবেন, তা নির্ধারণ করা হয় নাই। তবে কোনো শিক্ষক দোকানদার হতে পারবেন না, সে ব্যবস্থা আছে।
কোনো দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি একদিনে গড়ে উঠেনি । আবার আইন করে একদিনে পরিবর্তন করাও সম্ভব না। ধীরে ধীরে পরিবর্তন করার জন্য প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হয়। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস দেখলে দেখা যায় শিক্ষকগণ প্রাইভেট পড়াতেন। কেউ অর্থ, ডিম, মুরগি, লাউ ইত্যাদির বিনিময়ে, কেউ কেউ ইচ্ছেমত যা দিবে তার বিনিময়ে, যশ খ্যাতির জন্য কিংবা প্রকৃত মানুষ তৈরির নেশায় নিজেকে উজাড় করার জন্য। এখনও প্রাইভেট পড়ানো থেকে শিক্ষকগণ বের হয়ে আসতে পারেননি।। সরকারও পরোপুরি বন্ধ করে নাই। প্রতিদিন ভিন্ন বিদ্যালয়ের ১০ জনকে পড়ানোর সুযোগ রেখেছেন। তাছাড়া বিদ্যালয়েও অতিরিক্ত ক্লাসের সুযোগ রেখেছেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী ' গ্রন্থে লিখেছেন, "আমাদের হেডমাস্টার তখন ছিলেন বাবু রসরঞ্জন সেনগুপ্ত। আমাকে তিনি প্রাইভেটও পড়াতেন। " আর একজায়গায় লিখেছেন,"১৯৪১ সালে আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেব। পরীক্ষায় পাস আমি নিশ্চয় করব, সন্দেহ ছিল না। রসরঞ্জন বাবু ইংরেজির শিক্ষক, আমাকে ইংরেজি পড়াতেন। আর মনোরঞ্জন বাবু অঙ্কের শিক্ষক, আমাকে অঙ্ক করাতেন। " ( পৃষ্ঠা ১৫)
প্রাইভেট ছিল, আছে। তখন শিক্ষকগণই পড়াতেন। নিয়ম মেনে বর্তমানে কিছু শিক্ষক পড়াচ্ছেন না তা নয়। তবে তার চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি শিক্ষক নন (ভাইয়া) বা আত্মস্বীকৃত শিক্ষকগণ পড়ান। তাঁদেরও যোগ্যতার মাপকাঠি দরকার।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ধারাবাহিক গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষা সুনিয়ন্ত্রিত করা না গেলে সুপরিকল্পিত জাতি ও দেশ আশা করা যায় না ৷ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকের মধ্য থেকেই গবেষণা প্রয়োজন ৷ যেখানে রোগ ও রোগী সেখানেই হাসপাতাল নির্মাণ হোক ৷ তাতে সেবার মান ও রোগীর দুর্ভোগ কমবে ৷ অবহেলা করলে আগামীতে দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে।
মো:শফিয়ার রহমান
মো:শফিয়ার রহমান
সহকারী শিক্ষক,
রংপুর জিলা স্কুল,রংপুর
"গবেষণায় চিকিৎসা"- শফিয়ার রহমান।
Reviewed by সম্পাদক
on
শুক্রবার, আগস্ট ০২, ২০১৯
Rating: 5