শিশু-কিশোর২৪ডেস্ক:
যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশে সবচেয়ে সস্তা দ্রব্য বা বস্তুর নাম কী? উত্তরে অনেকেই বলবেন, দিয়াশলাই। কারণ, ২৫টি দিয়াশলাইয়ের একটি বাক্স এখনও মাত্র এক টাকায় পাওয়া যায়। আবার এর উল্টোটিও বলা যায়। বাংলাদেশে সবচেয়ে দামি দ্রব্য বা বস্তু হচ্ছে দিয়াশলাই। কারণ, প্রায়ই মাত্র একটি দিয়াশলাই বাঁচাতে কোটি টাকার গ্যাস পুড়িয়ে ফেলি আমরা। শুধু চুলা নয়; আগুন জ্বালাতে হয় এমন যেকোনো কাজে দিয়াশলাইয়ের ব্যবহার এখনও অদ্বিতীয়। দামি হোক আর সস্তা হোক, দিয়াশলাই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ, এ নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই।
দিয়াশলাই শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Match (ম্যাচ), যা এসেছে প্রাচীন ফরাসি শব্দ 'মেসে' থেকে। দিয়াশলাই শব্দের উত্পত্তি সংস্কৃত দীপশলাকা, হিন্দি দিয়াশলাই থেকে। অভিধান মতে, ঘষে আগুন জ্বালানোর জন্য মাথায় বারুদ-দেওয়া সরু কাঠি ও তার বাক্স-কে বলে দিয়াশলাই। এই দিয়াশলাই বা ম্যাচের কাঠির আবিষ্কারের পেছনে আছে বেশ মজার একটি ইতিহাস। আসুন জেনে নেই, দেখতে সামান্য কিন্তু ব্যবহারিক দিক থেকে অপরিহার্য বস্তুটির আবিষ্কারের সেই ইতিহাস।
জন ওয়াকারকে (১৭৮১-১৮৫৯) বর্তমান ম্যাচের কাঠির উদ্ভাবক বলা হয়। কর্মজীবনের শুরুতে এই ইংরেজ ভদ্রলোক প্রথমে সার্জন অ্যাসিস্টেন্ট পদে কাজ করতেন। কিন্তু খুব অল্প সময়ে তিনি বুঝে ফেলেন যে, মানুষের শরীর নিয়ে এসব কাজ তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হবে না । তাই ওয়াকার তার জীবনের পথকে পাল্টানোর চিন্তা করলেন, নজর দিলেন রসায়নের দিকে। রসায়ন বিষয়টির প্রতি তার বেশ ঝোঁক ছিল। তার উৎসাহ কাজ করছিল সহজে আগুন জ্বালানোর একটি কৌশল আবিষ্কারের দিকে। আর এর পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণও ছিল। কেননা তখন পর্যন্ত আগুন জ্বালানোর জন্য তেমন কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি, যা দিয়ে ঘর্ষণের মাধ্যমে আগুন জ্বালিয়ে সাথে সাথেই সেটিকে জ্বলতে থাকা অবস্থায় অন্য কোথাও স্থানান্তর করা যাবে।
সুতরাং জন ওয়াকার তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তিনি একদিন গবেষণাগারে অ্যান্টিমনির সালফাইড, পটাশের ক্লোরেট এবং আঠার মিশ্রণ নিয়ে কিছু গবেষণা করছিলেন তিনি। এই মিশ্রণটিতে তিনি সালফারের প্রলেপ দেওয়া একটি কাঠের টুকরা ডুবিয়ে দেখছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে কাঠের টুকরাটির সাথে তার ঘরের ফায়ারপ্লেসের একটু ঘর্ষণ হয় আর সাথে সাথেই জ্বলে উঠে আগুন। তখনই জন ওয়াকার বুঝতে পারলেন যে, এতদিন পর অবশেষে তার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পেতে যাচ্ছে। ঘটনাটি ঘটে ১৮২৬ সালে। তিনি তার নতুন উদ্ভাবিত আগুন জ্বালানোর কৌশলটিকে বাজারে সকলের জন্য ছেড়ে দেন।
ওয়াকার যে ম্যাচবাক্সগুলো বাজারে বিক্রি করতেন, তার প্রতিটিতে পঞ্চাশটি করে কাঠি থাকত, ১ শিলিং দাম ছিল প্রতিটি বক্সের। প্রতিটি কাঠিতেই সালফারের আস্তরণ দেওয়া হতো। আর একেবারে মাথার দিকে সেই মিশ্রণটির একটি প্রলেপ দেওয়া থাকতো। এই সালফারই মূলত আগুনকে কাঠের সংস্পর্শে আনতে সাহায্য করতো। সেই সাথে প্রতি বক্সের সাথে একটি করে শিরীষ কাগজ দেওয়া হতো যার উপর কাঠিটি ঘষে আগুন জ্বালানো যায়।
ইংরেজ উদ্ভাবক ও আর্টিলারি রকেটের গবেষণায় অগ্রদূত স্যার উইলিয়াম কনগ্রেভ-এর সম্মানার্থে জন ওয়াকার তার এই ম্যাচের নাম দিয়েছিলেন ‘Congreves’।
তড়িঘড়ি করে তিনি তার এই যুগান্তকারী আবিষ্কার জনসমক্ষে আনতে গিয়ে এর পেটেন্ট করেননি। কয়েকদিনের মধ্যেই, জন ওয়াকার যাদের কাছে এই পদ্ধতিটি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, তাদেরই একজন স্যামুয়েল জোনস এতবড় একটি সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করেননি। তিনি নিজের নামে এর পেটেন্ট নিয়ে নেন। তিনি অবশ্য এই মিশ্রণ ব্যবহার করে লুসিফার নামক দিয়াশলাই তৈরি করেন। এই দিয়াশলাই এর বিক্রি ছিল অবিশ্বাস্যরকমের বেশি। এমনকি দিয়াশলাইয়ের এই সহজপ্রাপ্যতা তখন ধুমপানের হার বাড়িয়ে দিয়েছিলে! তবে লুসিফারের খারাপ দিকও ছিল। সবচেয়ে খারাপ দিক ছিল এর চরম দুর্গন্ধ এবং জ্বালানোর সময়ে আতশবাজির মতো আগুনের ঝলকানি। লুসিফার প্রকৃতপক্ষে এমন এক সতর্ক সংকেত বহন করেছিল যে, শুধু এর দ্বারা জ্বালানো সিগারেটই ক্ষতিকর না বরং এটি নিজেও স্বাস্থ্যের পক্ষে চরম হুমকি।
১৮৩০ সালে চার্লস সাওরিয়া নামক একজন ফরাসি রসায়নবিদ এই দুর্গন্ধ দূর করার জন্য লুসিফারের গঠনপ্রণালী পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সাদা ফসফরাস যোগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তৈরি করেন ঘর্ষণ দিয়াশলাই। এ দিয়াশলাইয়ের সুবিধা এবং অসুবিধা দুটিই ছিল। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়াতে এটি জ্বালানো গেলেও পকেটে রাখা যেত না। একটু বেশি তাপমাত্রাতেই (৩৫ ডিগ্রি সে.) নিজে নিজে জ্বলে উঠত এটি। এর ধোঁয়া ছিল বিষাক্ত। চার্লস না জেনেই সাদা ফসফরাসের মিশ্রনের মাধ্যমে এক ভয়ংকর মহামারীর জন্ম দেন। এর প্রাদুর্ভাবে দিয়াশলাই কারখানার কর্মীরা দাঁত ও চোয়ালের রোগে আক্রান্ত হতো।
এই ফসফরাস ফোজি জাও নামক এক ভয়ঙ্কর রোগের কারণ ছিল। এই রোগে দিয়াশলাই কারখানায় কর্মরত কর্মচারীদের হাড় হয়ে পড়ত বিষাক্ত। এক প্যাকেট দিয়াশলাইতে যে পরিমান সাদা ফসফরাস থাকত, তা ছিল একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। এরপর ১৮৪৪ সালে লাল ফসফরাসের আবিষ্কার ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। কারণ, এটি দাহ্য হলেও বাতাসে জ্বলে উঠত না। আর এর বিষক্রিয়াও ছিল কম। লাল ফসফরাস ব্যবহার করার পর থেকে বন্ধ হয়ে যায় সাদা ফসফরাসের দিয়াশলাই। ১৮৫৫ সালে নিরাপদ দিয়াশলাইয়ের প্রচলন করেন সুইডেনের জে.ই লুন্ডস্ট্রম।
দুর্ভাগ্যক্রমে ফসফরাস দিয়ে দিয়াশলাই তৈরির ফলে ব্যবহারকারী 'ফসি জ' এবং অন্যান্য হাড়ক্ষয়জনিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এছাড়াও, শ্বেত ফসফরাস ব্যবহারে মানুষের প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটতে থাকে। দিয়াশলাইয়ের সম্মুখাংশ গলাধঃকরণ করে মৃত্যু ও আত্মহত্যাজনিত ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে। ১৮৪৫ সালে ভিয়েনায় প্রথমদিকে এ ধরনের ঘটনা ঘটে।
১৯১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে 'ডায়মন্ড ম্যাচ কোম্পানি' নামক একটি কোম্পানি সর্বপ্রথম অবিষাক্ত দিয়াশলাই এর পেটেন্ট করায়। তারা যে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে অবিষাক্ত দিয়াশলাই উদ্ভাবন করেছিল তা হলো 'সেসকুইসালফাইড অব ফসফরাস'। এই আবিষ্কারটি এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি উইলিয়াম এইচ. টাফট ডায়মন্ড ম্যাচ কোম্পানিকে অনুরোধ করেন তাদের পেটেন্ট তুলে নিতে এবং বিশ্বমানবতার স্বার্থে সবার কাছে তাদের এই অবিষাক্ত দিয়াশলাই এর প্রস্তুত প্রণালী উন্মুক্ত করে দিতে, যাতে সব কোম্পানিই তা অনুসরন করতে পারে। যদিও ব্যাপক মুনাফাগত সম্ভাবনা ছিল কিন্তু তারপরও ডায়মন্ড ম্যাচ কোম্পানি এই মানবিক আহবানে সাড়া দিয়ে ১৯১১ সালের ২৮শে জানুয়ারি তাদের পেটেন্ট তুলে নেয়। এরপর থেকেই মানুষের মধ্যে আরও ব্যাপক হারে ম্যাচ ব্যবহারের প্রচলন লক্ষ্য করা যায়।
বাংলাদেশে দিয়াশলাইয়ের প্রচলন শুরু হলো যেভাবে-
১৯৫২ সালে ব্যাংক ঋণ নিয়ে সাড়ে চার লাখ টাকা ব্যয়ে জনাব জুবের আলী চট্টগ্রামের কালুরঘাটে সর্বপ্রথম একটি দিয়াশলাই কারখানা স্থাপন করেন এদেশে। এর ৪ বছর পর খুলনার রূপসা নদীর তীরে ১৮ একর জমির উপর সুন্দরবনের গেওয়া কাঠ নির্ভর দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে। তবে এই কারখানাটি ২০১০ সালে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এ.কে. খান ম্যাচ ফ্যাক্টরি। বর্তমানে বাংলাদেশে ক্যামেল, পান্ডা, রুপচাঁদা, মৃগেল, রেডফিস, হাঙর, পেংগুইন, পিকক, কাঠবিড়ালি, খরগোশ, রোবট, রকেট, স্কাট, ফুটবল, সুপার সনিক, সুপার পাওয়ার, সুপার ফায়ার, ডলফিন, ঈগল, কবুতর, কিংফিসার, গোল্ডলিফ, উইলসন কোং, মেরিন, সানমুন, বনানী গোল্ড, সুপার স্টার, সুপার গোল্ড, সুপার গ্লোব, গোল্ড স্টার, ফায়ার বক্স, ভরসা, ভরসা গোল্ড, ওমেকা, চ্যাম্পিয়ন, ফিলিপস, গ্রামীন, দেশ, টু স্টার, টুয়েলব স্টার সহ আরো রয়েছে অনেক ব্রান্ডের ম্যাচ। সুন্দরবনে জন্মানো গেওয়া কাঠ দিয়ে মূলত দিয়াশলাইয়ের কাঠি ও বাক্স তৈরি করা হচ্ছে।
রেকর্ড
মানুষের হরেক রকম শখের মধ্য দিয়াশলাইয়ের বাক্স ও মার্কা জমানো অন্যতম একটি শখ। দিয়াশলাইয়ের বাক্স ও মার্কা জমানোর শখকে বলা হয় ফিলুমেরি। যারা এগুলো সংগ্রহ করেন তাদের বলা হয় ফিলুমেনিস্ট।
১৯৯২ সালে জাপানের তেইচি ইয়েসি জাওয়া ৭৫ বছর ধরে ১৫০টি দেশের ৭ লাখ দিয়াশলাই মার্কা জমিয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে নাম লিখিয়েছেন।
আমরাও পিছিয়ে নেই। ঢাকার অদূরে শিল্পাঞ্চল সাভার ইউনিয়ন পরিষদের বাসিন্দা আজিম উদ্দিনের সংগ্রহে রয়েছে বিভিন্ন মডেলের দেশি-বিদেশি প্রায় ২ হাজারের বেশি ম্যাচবাক্স ও লাইটার। এসব ম্যাচ ও লাইটার দিয়েই তিনি গড়ে তুলেছেন এক ব্যতিক্রমী সংগ্রহশালা।
লেখা: সংগৃহীত
তথ্যসূত্র:(ইন্টারনেট)
জানা-অজানা: কীভাবে আবিষ্কৃত হলো ম্যাচের কাঠি?
Reviewed by সম্পাদক
on
বৃহস্পতিবার, আগস্ট ২৯, ২০১৯
Rating: