বিশেষ প্রকাশনা:
ঘ্যাঁচর ঘ্যাঁচ শব্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে ত্রিচক্রযান। তিন চাকার রিকসায় যাত্রীও তিনজন। তিনজন না বলে ‘সোয়া দুই জন’ বলাই ভালো। আব্বা-আম্মা আর পুঁচকে আমি। আমার বয়স তখন কত? ছয় কি সাত। নব্বইয়ের গণ আন্দোলনে উত্তাল সারা দেশ। সেই আঁচ এসে লেগেছে এরশাদের দূর্গ রংপুরেও। তখন কি আর অত কিছু বুঝি? আমার ভাবনার ছোট্ট জগতে এসবের কোনো বালাই নেই।
কল্পনার সেই জগত তখন অন্য কিছুর দখলে। সেখানে আছে রাজপুত্র-রাজকন্যা। পঙ্খীরাজ ঘোড়া। সোনা কাঠি-রুপার কাঠি। আছে রাক্ষস-খোক্কস। সন্ধ্যা হলেই ভূতের ভয়। আছে শাওনদের পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা চুরির নির্বোধ সাহস। ভোকাট্টা ঘুড়ির পেছনে ছুটে ছুটে হয়রান হওয়া। আর? আর আছে একজোড়া চাকাওলা জুতার জন্য অসম্ভব জিদ।
আমরা তখন থাকি দিনাজপুরে। আমার নানা বাসার ঠিক পাশেই। ঘাসিপাড়ায়। সেখানেই কয়েকজন ছেলেমেয়ে চাকাওলা জুতা পরে কী সুন্দর ছুটে যায়! আমার খুব হিংসা হয় ওদের দেখে। স্কেটিং-মেসকেটিং তো তখন বুঝি না। শুধু বুঝি, নিচে ছোট ছোট চাকা লাগানো থাকে এমন জুতাও পাওয়া যায়। যে জুতা পরে হাঁটতে হয় না! এমনিতেই গড়গড়িয়ে ছুটে যাওয়া যায়। এই জুতাই আমার চাই।
প্রতিদিন মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করি, ‘আম্মা, আমাক চাকাওলা জুতা কিনে দ্যান। দ্যান না।’ উঠোনো হাত পা ছুড়ে চিৎকার করে কাঁদি। ভ্যা ভ্যা ভ্যা। লাভ হয় না। যাবতীয় আবদার মায়ের কাছেই করতে হয়। আব্বা রংপুরে কী একটা চাকরি নিয়ে চলে এসেছেন।
আব্বার অনুপস্থিতি অবশ্য মা বুঝতেই দেন না। ডাবল শাসনে রাখেন। মায়ের কড়া শাসন আর নানা-নানী মামা-খালাদের অপত্য ভালোবাসায় কাটছিল সেই সব শৈশব। সবচেয়ে বড় কথা, স্কুলে যেতে হয় না। আমার বয়সীরা সবাই স্কুলে যায়। এই তো আমাদের পাশের বাসার মুন্নাই তো কাস ওয়ানে ভর্তি হয়ে গেছে মিশন স্কুলে। মুন্নাকে দেখে মায়া লাগে। আবার হিংসাও হয়। শুধু জীবনে একটাই আপে, আমার চাকাওলা জুতা নেই!
তবে সুখের দিন দ্রুতই ফুরায়। কর্পূরের মতো উবে যায়। শোনা গেল, আমরা রংপুরে চলে আসছি। বাবার সঙ্গে থাকব। নানা-নানীদের ছেড়ে যেতে হবে। ঘাসিপাড়ার বড় বড় আম গাছগুলো ছেড়ে যেতে হবে! কী অসম্ভব মিষ্টি স্বাদের লিচু গাছগুলো ছেড়ে যেতে হবে! তার চেয়েও বড় দুঃখের কথা, রংপুরে গেলেই নাকি আমাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হবে স্কুলে!
দিনাজপুর ছেড়ে আসার আগে ‘প্রস্তুতি সফরে’র অংশ হিসেবে একদিন আব্বা-আম্মার সাথে আমিও চলে এলাম রংপুরে। আম্মা এখানে বাসা ঠিকঠাক করে রাখবেন। তার পর একদিন আমরা ট্রাকে সব মালপত্র গুছিয়ে চলে আসব।
দিনাজপুর থেকে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে বুড়োর মতো খুক খুশ কাশতে কাশতে থাকা একটা মুড়ির টিন বাস আমাদের নামিয়ে দিয়েছে রংপুরে। মেডিকেল মোড়ে। সেখান থেকে রিকশায়। ঘ্যাঁচর ঘ্যাঁচ শব্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে ত্রিচক্রযান। তিন চাকার রিকসায় যাত্রীও তিনজন। তিন জন না বলে সোয়া দুই জন বলাই ভালো। আব্বা-আম্মা আর পুঁচকে আমি...।
এক সময় বিশাল এক খেলার মাঠ দেখিয়ে আব্বা বললেন, ‘এইটার নাম জেলা স্কুল। বুজলি, খুব ভালো স্কুল। যদি ভর্তি হবার পারিস, তোকে আমি চাকাওলা জুতা কিনে দেমো।’
আমার চোখ চকচক করে ওঠে। জুতা! চাকাওলা জুতা!!
সেই বছরেই সম্ভবত স্বৈরাচার শাসকের পতন হয়। শাপলা চত্বরের (আগে এর নাম ছিল ভাটিখানা) পাশে শ্যালো মার্কেটের পেছনে আমাদের বাসা। তখনো শ্যালো মার্কেট এতটা জমজমাট হয়নি। অল্প কয়েকটা দোকান। আশেপাশে অল্প কয়েকটা বাসা। এখানেই প্রথম পরিচয় বন্ধু আদনানের সঙ্গে। আমাদের বাসার পেছনে ওর বড় আব্বুর বাসায় ও থাকে। অল্প সময়ের মধ্যেই আদনানের সাথে আমার বন্ধুত্ব এবং শত্রুতা গড়ে ওঠে। আদনান তার খেলনা ট্রেন দেখিয়ে আমাকে রীতিমতো হকচকিয়ে দেয়। অবিকল আসল, কিংবা তার চেয়েও সুন্দর আদনানের এই খেলনা ট্রেন। কী সুন্দর লাইন ধরে এঁকেবেঁকে যায়। সেই ট্রেনের আবার হেডলাইটও আছে!
তবে আদনানের চাকাওলা জুতা নেই। এটা খুবই সুখবর। তুই ট্রেনের দেমাগ দেখাইস! দাঁড়া সামনের বছর জেলা (জেলা স্কুলই বলতো সবাই, স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরেই জেনেছি ওটা হবে ‘জিলা’) স্কুলে ভর্তি হয়া নেই। আব্বা কয়া দিছে, চান্স পাইলেই চাকাওলা জুতা কিনে দেবে!
একদিন এই দুঃসংবাদও পেয়ে যাই, আদনানও নাকি জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে জেলা স্কুলে ভর্তি হওয়ার! আজহার স্যার নামের এক স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ছে। যে স্যারের কাছে পড়লে গরু-গাধাও জেলা স্কুলে নাকি চান্স পেয়ে যায় (পরে এই কথার প্রমাণ পেয়েছি আদনানের চান্স পাওয়ার খবর শুনে)!
আমার অবশ্য আজহার স্যারের কাছে পড়ার কপাল হয় না। টানাটানির সংসারে প্রাইভেট পড়া রীতিমতো বিলাসিতা। তবে সেই ঘাটতি পূরণ হয়ে যায় সেন্ট সাইমুন কিন্ডার গার্টেনের কোচিংয়ে।
কাস ওয়ানে আমি পড়িনি। সরাসরি কাস টুয়ে ভর্তি হয়েছি। শোনা কথা, আমার ইন্টারভিউ নিয়ে সেন্ট সাইমুনের প্রিন্সিপাল নাকি বলেছিলেন, ‘আরে এ তো ওয়ানের সব পড়াই পারে। একে টুতে ভর্তি করায় দেন।’ কাস টুয়ে পড়েই আমার শিাজীবন শুরু।
ক্লাস টুয়েও তখন একটা বৃত্তি পরীক্ষা হতো। সেই বৃত্তি পরীক্ষার জন্য সেন্ট সাইমুনে আমাদের আলাদা কোচিং করানো হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্য জায়গায়। বৃত্তি পরীক্ষা আর জেলা স্কুলের ভর্তি পরীক্ষা পড়ে গেল একই দিনে। আমাকে একই দিনে নামতে হবে দুই দুইটা যুদ্ধে! অসুবিধা নাই। চাকাওলা জুতা আমার চাই। চাকাওলা জুতার জন্য আমি দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে লাল রুমাল বেঁধে দিতে প্রস্তুত। বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনে দিতে পারি ২১৬টা নীলপদ্ম।
লায়ন্সে সকালে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে দেখি স্কুলের গেটে আম্মা নাই। এখানেই আম্মা আর আমার খালাতো বোন লিপি আপার অপেক্ষা করার কথা। লায়ন্স থেকে ওরা আমাকে জিলা স্কুলে নিয়ে যাবেন। সেখানেই আবার পরীক্ষা দেবো। আমার তো টেনশনে ঘাম দিতে শুরু করল। আম্মা যদি ঠিক সময়ে না আসে? চাকাওলা জুতা এভাবে হাত থেকে ফসকে যাবে!
আমি আম্মার জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই বাসার উদ্দেশে হাঁটা দিলাম। এখন ভেবে শিউরে উঠি, কী ভয়াবহ ঝুঁকিই না নিয়েছিলাম চাকাওলা জুতার লোভে অন্ধ হয়ে যাওয়া এই আমি। লায়ন্স থেকে গুপ্তপাড়ায় আমাদের বাসা খুব বেশি দূরে ছিল না। যদিও কাস থ্রিতে ওঠার অপেক্ষায় থাকা একটা ছেলের জন্য দেড়-দুই কিলোমিটার অনেক লম্বা পথ। সমস্যা নেই। বাসার রাস্তা আমি ভালোভাবেই চিনি। তবে ঝুঁকি অন্যখানে। লায়ন্স স্কুল থেকে আমাদের বাসা দুদিক দিয়ে যাওয়া যায়। পূর্ব গুপ্তপাড়ার রাস্তা দিয়ে। আবার ইলেভেন স্টার কাবের পাশ দিয়েও।
আমি ইলেভেন স্টার কাবের পাশ দিয়ে গেছি। কিছু না ভেবেই গেছি। ওই রাস্তাই হয়তো আমি ভালো চিনতাম। মনে আছে, সালমা স্কুলের সামনে আম্মার সাথে দেখা হলো। আম্মা রিকসায় করে ছুটছেন লায়ন্সের দিকে। সঙ্গে লিপি আপা।
হায়, আম্মা যদি এই পথে না গিয়ে পূর্ব গুপ্তপাড়ার রাস্তা দিয়ে যেতেন! আমার সঙ্গে তাঁর দেখাই হতো না! ভর্তি পরীক্ষাটাও দেওয়া হতো না আমার! জিলা স্কুলে চান্স পেতাম না। এত এত অসাধারণ সব বন্ধুর সঙ্গে পরিচয়ও হতো না! বিতর্ক করা হতো না। সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে রাজশাহী-ঢাকায় যাওয়া হতো না। এসএসসিতে ভালো ফল হতো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারতাম না। লেখক-সাংবাদিক কোনোটাই হতে পারতাম না। ভাবা যায়, কী ভীষণ ঝুঁকি নিয়েছিলাম স্রেফ একজোড়া চাকাওলা জুতার জন্য!
না, আব্বা কথা রাখেনি। জিলা স্কুলে চান্স পাওয়ার পরেও আমাকে চাকাওলা জুতা কিনে দেওয়া হয়নি। আমাকে ‘বুজ’ দেওয়ার জন্য একটা হাতঘড়ি কিনে দেওয়া হয়েছিল বটে। প্রথম প্রথম খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু ‘আশাহি’ নামের সেই ঘড়ি দেড় শ টাকা কেজিতে বিক্রি হয় এই খবর শোনার পর মেজাজ চড়ে গিয়েছিল। আব্বার প্রতিশ্রতি ভঙ্গের অপরাধ অনেক দিন মা করিনি।
চাকাওলা জুতা না-পাওয়ার আক্ষেপ আমাকে দীর্ঘদিন তাড়িয়ে বেরিয়েছে।
হায়, তখনো বুঝিনি, রংপুর জিলা স্কুলটাই একটা চাকাওলা জুতা। একবার এই স্কুলে ভর্তি হলে আপনাকে আর হাঁটতে হবে না। আপনি নিজেই গড়গড়িয়ে এগিয়ে যাবেন!
লেখক:
রাজীব হাসান
উপ ক্রীড়া সম্পাদক,
প্রথম আলো।
ছবি- সংগৃহীত।
"আমার চাকাওয়ালা জুতা"- রাজীব হাসান।
Reviewed by সম্পাদক
on
শনিবার, আগস্ট ০৩, ২০১৯
Rating: