"বসন্তের কোকিল" - শফিয়ার রহমান।
বিশেষ প্রকাশনা:
কোকিল মিষ্টি সুরে গান গায় ৷ কবি সাহিত্যিক বা গীতিকার এই সুর এর প্রশংসা করেছেন ৷সাধারনত শীতকালে যখন গাছের পাতা ঝরে যায় , গাছপালা শীতে কাতর হয় , সৌন্দর্যহীন হয় , ফুল ফল থাকে না কোকিল গাছের এই দু:সময়ে অনেকটা নীরব থাকে ৷ ক্রমে সরব হয়ে বসন্তে অবিরাম ডাকে ৷ কোকিলের সুরে বসন্তকালের আগমন বার্তা জানান দেয় ৷ প্রকৃতি যখন নতুন সাজে সজ্জিত হয় , নতুন পাতা , ফুলে বৃক্ষ যখন শীতের তীব্রতা কেটে উঠে তখনই বসন্তের আগমন ৷ আর এই সুখের বসন্তেই কোকিল মধুর সুরে ডাকে ৷ অন্য সময় বা ঋতুতে কোকিলের ডাক সেভাবে শোনা যায় না ৷ কোনো কোনো ঋতুতে একবারেই শোনা যায় না ৷ এইজন্য প্রবাদ আছে বসন্তের কোকিল ৷ যে গাছ - পালার আশ্রয় নেয় , খাদ্য সংগ্রহ করে তাদের সুদিনেই কোকিল আনন্দে গান গায় , অন্য সময়ে খোঁজ নেয় না৷
কাকের কণ্ঠ বেশ কর্কশ এবং কঠোর ৷ কাক খুবই উপকারি পাখি ৷ এরা মরা পচা আর বাসী জিনিসপত্র খেয়ে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখে ৷শহর পরিচ্ছন্ন রাখার ক্ষেত্রে কাকের কোনো বিকল্প নাই ৷ আমাদের মত দেশে সুসভ্য নাগরিক জীবন যাপন কাকবিহীন কল্পনা করা যায় না ৷ কাক প্রকৃতি বান্ধব , চালাক ও বুদ্ধিমান ৷
কোকিল নিজের বাসা নিজে তৈরি করতে পারে না ৷ কাকের ডিম ধ্বংশ করে চুপিসারে ডিম পাড়ে ৷ নিজের সন্তানকে কাকের দ্বারা লালন পালন করে ৷ যে পাখি নিজের বাসা তৈরি করতে পারে না , নিজের সন্তানকে স্নেহ মমতায় লালন পালন করতে পারে না , শুধুমাত্র সুরেলা কণ্ঠের জন্য তাকে পছন্দ করা কতটুকু গ্রহনযোগ্য ৷ মানুষের উপকার করে , এমন কিছু কোকিলের মাঝে দেখি না ৷
কাক ও কোকিলের কর্ম বিবেচনা না করে আমরা কোকিলকে পছন্দ করি, তেমনি অনেক মানুষের মিষ্ট কথায় আমরা আকৃষ্ট হই ৷ তাদের অতীত বর্তমানকে আমরা বিবেচনায় নেই না ৷
একটি কাককে কোনো ব্যক্তি আঘাত করলে বা হত্যা করলে কাকেরা চুপ করে থাকে না ৷ শত শত কাক তার প্রতিবাদ করার জন্য একত্রিত হয় ৷ জোড়ালো প্রতিবাদ করে ৷ যে ব্যক্তি ঐ কাকের ক্ষতি করে তা দেখে ফেললে অন্য কাকেরা ঐ ব্যাক্তিকে হামলা করার চেষ্টা করে ৷ তাদের প্রতিবাদের মিছিলের শব্দে পাড়া মহল্লা কাঁপিয়ে তোলে ৷ কাক স্বজাতির বিপদে এগিয়ে আসে ৷ একে অপরের ক্ষতি করে না ৷ এজন্য প্রবাদ আছে " কাক কাকের মাংস খায় না ৷"
যে পাখি মানব জাতির এত উপকার করে , স্বজাতির বিপদে পাশে দাঁড়ায় , ঐক্যবদ্ধ হতে এতটুকু সময় নেয় না ৷ নিজেরা নিজেদের ক্ষতি করে না , সেই কাকের কর্কশ কণ্ঠের জন্য আমরা পছন্দ করি না ৷ কাকের থেকে আমার শিক্ষার অনেক কিছু আছে ৷
সৃষ্টির সেরা মানুষ ৷ অথচ আমরা একে অপরকে খুন করতে, অপরের ক্ষতি করতে দ্বিধাবোধ করি না ৷ঐক্যবদ্ধ হয়ে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দ্বিধা দ্বন্দ্বে থাকি ৷
নিউটনের তৃতীয় সুত্র মতে , " প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে ৷" কাকের কর্মের ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে ৷ ক্রিয়া আছে বলেই প্রতিক্রিয়া আছে ৷ যার ক্রিয়া নাই তার বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকবে কিভাবে ৷ ক্রিয়াহীন ব্যক্তি, বস্তু, প্রাণি আমাদের কি প্রয়োজন ? যার কোনো কাজই নাই তার কি প্রয়োজন? বিপরীত প্রতিক্রিয়ার ভয়ে ক্রিয়াকে অপছন্দ করে দূরে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয় ৷ বিপরীত প্রতিক্রিয়াকে সামাল দিয়ে ক্রিয়াকে কাজে লাগানোই বুদ্ধিমানের কাজ ৷ আবার বিপরীত প্রতিক্রিয়াকেও বুদ্ধি খাটিয়ে নিজের কাজে লাগানো যায় ৷ এজন্য ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াহীন মানুষ সমাজে গুরত্বহীন ৷ যে মানব সন্তান এদের পছন্দ করে তারা মানব জাতির কলংক ৷ রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায়, যে ব্যক্তির ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া নাই ,সে ব্যক্তি নির্লিপ্ত ৷ নির্লিপ্ততা কারোই কাম্য হওয়া উচিৎ না ৷
হাঁস, মুরগি, গরু , ছাগল প্রভৃতি প্রাণির সারাদিন একটিই কাজ নিজের পেট ভর্তি করার জন্য খাদ্য গ্রহন করা ৷ মানুষের মধ্যে অনেকেই আছে যারা সারাজীবন নিজের সুখের জন্য যে কোনো উপায়ে অর্থ সম্পদ উপার্জন করে ৷ এরা মানুষ নয় গরু ছাগল,হাঁস মুরগির মত প্রাণি ৷
যাঁরা নিজেদের সন্তানের জন্য টাকা দিয়েই মনে করে বড় দায়িত্ব পালন করলাম , টাকা দিয়েই শিক্ষিত করে গড়ে তুলেন তাঁদের ক্ষেত্রে বলব টাকা দিয়ে বড় করা সম্ভব,তবে সন্তানের সাথে স্নেহের যে সম্পর্ক তা ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে যায় ৷ একসময় বাবা মায়ের টাকা থাকলে সন্তানও কাছে থাকে , টাকা পয়সা বা সম্পদ না থাকলে সন্তান দূরে চলে যায় ৷ পিতামাতার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় ৷ এরুপ ক্ষেত্রে আমরা সন্তানকেই অমানুষ ভেবে থাকি ৷ আসলে কি তাই ? বাবা মায়ের কি কোনো ভুমিকা নাই ৷ কোকিল যেমন তাঁর সন্তানকে কাকের দ্বারা বড় করে , কোকিল যেমন কাককে ঠকিয়ে নিজের সন্তানকে বড় করে নিয়ে ভাবে আমি কি বুদ্ধিমান , তেমনি টাকা দিয়ে সন্তানকে মানুষ করে , নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবা বোকামি ছাড়া কিছুই না ৷ কোকিল কাকের বাসায় সন্তান বড় করে , সেই সন্তান বড় হয়ে কাক হয় না কোকিল হয় ৷ সেও তার বাবা মায়ের পথেই চলে ৷ পিতা মাতা যদি সন্তানের সাথে মধুর সম্পর্ক তৈরী করে , সন্তানের খাওয়া, পোশাক পরিচ্ছদ পরিষ্কার করা, অসুখ হলে পাশে থেকে যত্ন নেয়া , ছোটবেলা থেকে নিজেই পড়ানো , এভাবে সন্তানের পাশে থাকলে সন্তানও তা শিখে এবং সে যখন মানুষ হয় তখন তাঁর কাছ থেকে সেই আচরণ প্রত্যাশা করা যায় ৷ কিন্তু আমরা অনেককেই দেখি নিজের সন্তানকে কাজের লোকের কাছে রেখে নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে ৷ সন্তানের গোসল করানো থেকে শুরু করে সব কাজ টাকার বিনিময়ে লোক রেখে করাতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করেন ৷ অনেক বাবা মা শিশু সন্তানকে রাতের বেলা ডায়পার পরিধান করে ঘুমিয়ে রাখেন ৷ সন্তান পায়খানা প্রসাব করে ঐ অবস্থায় ঘুমিয়ে থাকেন ৷ পায়খানা প্রসাব সহ রাতভর ঘুমিয়ে থাকা ঐ শিশুর উপর নির্যাতন ছাড়া কিছুই নয় ৷ যে বাবা মা এভাবে সারারাত ডায়পার পড়িয়ে নিজেকে ঝামেলা মুক্ত রাখেন তাঁদেরকেও যদি শুধুমাত্র একটি রাত ডায়পার পরিয়ে পায়খানা প্রসাব সহ রাখা যায় তাহলে বুঝতে পারবেন এটি শিশুর জন্য যন্ত্রনাজনক কি না ৷ মানুষ বৃদ্ধ হলে শিশুর মত হয়ে যায় ৷ বার্ধ্যক্যের কারনে পরনের কাপড় ও বিছানা পত্র নষ্ট করলে একসময়ের শিশু সন্তানের কাছ থেকে সেই আচরণ পাওয়া অসম্ভব কিছু না ৷ কথায় আছে , "ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয় ৷" সন্তান যখন বিদ্যালয়ে যাওয়ার যোগ্য হয় তখন তার শিক্ষার দায়িত্ব পড়ে গৃহ শিক্ষক এর উপর ৷ অনেক বাবা মা সন্তানকে বিদ্যালয়ে , শিক্ষকের বাড়িতে অথবা কোচিং সেন্টারে আনা নেয়া করে থাকেন ৷ এটাই দায়িত্ব মনে করেন ৷ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া সন্তানকে বাসায় একটু পড়াতে পারেন না এমন বাবা মা এখন কম আছে ৷ যে সময়টুকু কোচিং এ রেখে অপেক্ষা করেন কিংবা প্রাইভেট স্যারের বাসায় বসে থাকেন তার অর্ধেক সময়ও যদি বাবা মা সন্তানকে পড়ার টেবিলে একটু দেখেন তাতে সন্তানের লেখাপড়ার মনোযোগী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে ৷ কথায় আছে , "পরার হাতের রান্নার চেয়ে মায়ের রান্না ভালো ৷" বাবা মা ছোটবেলা থেকে সন্তানকে লেখাপড়ায় সময় দিলে তাদের মধ্যে স্নেহের বন্ধন সুদৃঢ় হয় ৷ বাবা মায়ের কাছ থেকে গৃহীত এই শিক্ষা সন্তানকেও অনুপ্রাণিত করে ৷ এই সন্তান বড় হয়ে বাবা মায়ের সুখে দু: খে পাশে থাকবে এবং তাঁর সন্তানকে সেভাবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করবে ৷ বাবা মা কোকিল হলে সন্তান ও কোকিল হবে ৷ কোকিলের সন্তান কোকিলই হবে ৷ বৃদ্ধ কোকিলকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হবে নতুবা সন্তানের দেয়া টাকায় কেনা অন্যের স্নেহ ভালোবাসায় বাকি জীবন কাটাতে হবে ৷
কোকিল কাকের ডিম নষ্ট করে নিজের সন্তান মানুষ করে নিলেও কাকের চেয়ে কোকিলের সংখ্যা বেশি নয় ৷ কাক শুধু নিজের সন্তানকেই মানুষ করে না কোকিলের সন্তান কেও মানুষ করে ৷ এক্ষেত্রে কাককে যত বোকা ভাবি না কেন কাক কোকিলের মত স্বার্থপর নয় ৷ কাক কোকিলের বাচ্চাকে মেরে ফেলে না ৷ কোকিল নিজের স্বার্থের জন্য কাকের ডিম ধ্বংস করে ৷ কাক স্বার্থপর নয় বলেই আমরা বোকা বলি ৷
অনেক বাবা মা সন্তানকে আগলে রেখে মানুষ করে ৷ তাদেরকে বেশি নম্বর পেয়ে সর্বোচচ সনদধারী মানুষ হিসাবে গড়ে তূলেন ৷ মেধাবী সনদধারী হিসাবে গড়ে তুলতে পাড়া প্রতিবেশি, আত্মীয় স্বজন থেকে দূরে রাখেন ৷ বলতে গেলে অসামাজিক মেধাবী মানুষ তৈরি করেন ৷ এরা কাকের বাসায় কোকিল হয়ে বড় হন ৷ একসময় দেশে বা বিদেশে বড় চাকুরী করেন ৷ তাদের একটাই লক্ষ্য থাকে বড় থেকে আরো বড় হওয়া যায় ৷মাঝে মাঝে হয়তো কেউ কেউ টাকা পাঠিয়ে দেন বাবা মাকে ৷ একসময় বড় হওয়ার নেশায় নিজের দেশ, পাড়া পড়শি, আত্মীয় স্বজন দূরের কথা বাবা মাকেই ভুলে যান ৷ বাবা মা মারা গেলে শেষ দেখাটাও করার মত মানসিকতা থাকে না ৷ অসামাজিক মেধাবী গুনধর এই সন্তান আসলেই বাবা মায়েই নিজ হাতে অসামাজিক করে গড়ে তুলেছেন ৷ যার ফল নিজেরাও শেষ বয়সে পেয়ে থাকেন ৷ বসন্তের এই কোকিলের কাছে এর বেশি আশা করা বোকামী ছাড়া কিছুই নয় ৷
আমাদের সন্তানকে কোকিল নয় কাকের মত গড়ে তুলতে হবে ৷ কোকিলের মত সুসময়ে পাশে থাকবে আর দু:সময়ে লুকিয়ে থাকবে- এমন মানসিকতা থেকে বের করে আনতে হবে ৷ মুখে মিষ্টি কথা বলবে অথচ নিজের বাসা বা সন্তান লালন পালন করার জন্য অন্যের মুখাপেক্ষি থাকবে তা যেন না হয় সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে ৷ নিজের পরিবারে সর্বোপরি দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকবে সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে ৷ সেটিই সবার লক্ষ্য হউক ৷ আবারও বলছি কোকিলের সন্তান কোকিলই হয় ৷ আমরা কোকিল হব না , সন্তানকেও কোকিল হতে দেব না ৷ কাকের মত নিজের সন্তানকেও মানুষ করব, অন্যের সন্তানকেও নিজের সন্তানের মত যত্ন করব।
লেখা: শফিয়ার রহমান।
সহকারী শিক্ষক,
রংপুর জিলা স্কুল ৷
"বসন্তের কোকিল" - শফিয়ার রহমান।
Reviewed by সম্পাদক
on
মঙ্গলবার, জুলাই ০৯, ২০১৯
Rating: 5
