জেবা সামিহা,(রংপুর):
শিল্পসাহিত্য, আচার-আচরণ, বেশভূষা প্রভৃতি দ্বারা কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর যে রূপ ফুটে ওঠে তাই সংস্কৃতি। অতএব প্রত্যেক জাতির মতো বাঙ্গালি জাতির ও কিছু নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। আর এ সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব বাঙ্গালির। আমাদের পূর্বপুরুষ বা আমাদের সময়ে এ ধারা এখনো অব্যহত রয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে কতটুকু থাকবে এ নিয়ে একটু ভাবতে হচ্ছে। এখন প্রশ্নটা হলো কেনো ভাবছি। ভাবছি এ কারনেই ভবিষ্যৎ যারা অর্থাৎ এ প্রজন্মের শিশু-কিশোররা কতটুকু নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে জড়িত তা নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে।
কিশোর বয়সে পা দেয়নি এমন একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম "তুমি বাংলা গান শোনো?" উত্তরে বললো "না"। তারপর জিজ্ঞেস করলাম "কোনো বাংলা গায়কের নাম জানো বা চিনো?" উত্তরে বললো "না"। তবে কিছুদিন আগে বিখ্যাত গায়কের মৃত্যু খবর শুনেছে বিধায় শুধু তার নাম জানে। যার কথা বলছি সে শহরের খুব ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে। এবং আধুনিক যুগের অনেক বিখ্যাত ইংরেজি গান তার মুখস্থ। ব্যাপারটা ব্যথিত করলো আমায়। এই কিশোর/বালকটি যে জাতীয় সংগীত প্রতিদিন গায় সেই জাতীয় সংগীতের লেখক যে বিশ্ববিখ্যাত তা হয়তো এই কিশোর/বালকের জানা নেই।
শুধু একজনকে দিয়ে বিচার করছি তা নয়। বেশ কয়েকজনকে দেখেছি, তারা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে নিজের সংস্কৃতি অর্থাৎ বাংলা সংস্কৃতি থেকে ছোট থেকেই দূরে চলে গিয়ে অন্য সংস্কৃতি ধারণ করছে। যদি এ প্রজন্মের বেশিরভাগ শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি ঝোঁক চলে আসে তবে ভবিষ্যতে বাংলা সংস্কৃতি কোথায় হারিয়ে যাবে তা জানা নেই। এখন আপনারা বলবেন কয়েকজন শিশু-কিশোর তো আছেই যাদের বাঙ্গালির সংস্কৃতির ঝোঁক রয়েছে। তাহলে বাংলার সংস্কৃতি হারিয়ে যাবার ভয় করছি কেনো? আচ্ছা বলেন তাহলে কোটি কোটি মানুষের যা কাজ তা মুষ্টিমেয় কয়েকজন করে কয়দিন বা টিকিয়ে রাখতে পারবে?
এ প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের যে বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি ঝোঁক, তার কারণটা শুধু প্রজন্মের বিবর্তন নয়। আরও অনেক কারণ রয়েছে। যেমন সবচেয়ে প্রধান কারনগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিবার, পরিবেশ, সমাজ। যদি ছোট বয়স থেকেই পরিবার নিজের সংস্কৃতির সাথে সঠিক পরিচয় করিয়ে দেয় তাহলে একটা শিশু/কিশোর নিজের সংস্কৃতি বিমুখ সহজে হতে পারে না। এ প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় "কেনো নিজের সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকছে?" তাহলে একটাই উত্তর আসবে "ভালো লগে না"। একটু গভীরে গিয়ে দেখা যায় তার মনে কেউ ভালো লাগানোর চেষ্টা করেওনি। ধরে নিলাম ব্যস্ততার কারনে তা করা হয়ে ওঠে না। কিন্তু একটা শিশুর বিকাশের সময়ে সে যা দেখবে অর্থাৎ তার চারপাশে যা থাকবে তার ভালোলাগাতেও কিন্তু সেই জিনিসগুলো খানিকটা প্রভাব ফেলবে। একটি শিশু জন্মের পর থেকে জ্ঞান আসা পর্যন্ত বা ভালো-মন্দ বোঝার বয়স পর্যন্ত যদি দেখে তার পরিবার বা সমাজের মানুষ গুলো বিদেশি সংস্কৃতি নিয়ে মেতে আছে, তাহলে সে শিশুর বড় হয়ে বা কিশোর বয়সে বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি ঝোঁক থাকা অস্বাভাবিক বা দোষের কিছু না।
আর আজকের যুগের প্রযুক্তির জিবন। আজকাল বাচ্চারা কাপড় বা মাটির পুতুল খেলার চেয়ে স্মার্টফোনে বিদেশি পুতুলের গেম খেলা বেশি পছন্দ করে। আর বাবা-মায়েরাও সন্তানের মন রাখতে কিছুটা বাধ্য হয়ে দিয়ে দিচ্ছে তাদের ফোন। অবশ্য এ প্রযুক্তির যুগে নগরায়ণের সময়ে এগুলোই স্বাভাবিক। কারন এখানে অন্যভাবে সংস্কৃতি চর্চা সুযোগ খুব কম।
এ প্রজন্মের কিছু কিশোর রয়েছে যাদের নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা দেখে আমি সত্যিই খুব মুগ্ধ হই। তারা তাদের এ সংস্কৃতি চর্চার কাজ প্রযুক্তির সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এসব দেখে অবশ্য খুব ভালো লাগে। অনেক অল্প বয়সে তারা তাদের অসাধারণ মেধাশ্রমকে যে নিজের সংস্কৃতি চর্চার পিছনে ব্যয় করেছে। এখনকার সময়ে এটাই অনেক জাতির কাছে।
বিদেশি ভাষায় বা বিদেশি সংস্কৃতিতে বিশেষ দক্ষতা থাকা দোষ বা অপরাধের কিছু না। বরং বেশি জিনিসে দক্ষতা থাকাটা অনেক ভালো। তবে সেই বিশেষ দক্ষতা যেনো নিজস্ব সংস্কৃতির থেকে বেশি না হয় সেদিকে শিশু-কিশোর সহ সকলেরই খেয়াল রাখা উচিত। কারণ নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে গেলে নিজের পরিচয় টাই হারিয়ে যাবে। প্রত্যেকটা জাতির সংস্কৃতি তাদের নিজস্ব জাতি সত্তার পরিচয়।
ভালো থাকুক পৃথিবীর প্রতিটি শিশু-কিশোর তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে নিয়ে।
বাংলা সংস্কৃতি ও আজকের শিশু-কিশোর
Reviewed by সম্পাদক
on
শুক্রবার, মে ১৭, ২০১৯
Rating: