ব্রেক্সিটের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে পুরো দুনিয়া মেতে উঠেছিল এই ব্রেক্সিট নিয়ে। যুক্তরাজ্য বা ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কি না, সেটা নিয়ে একটা গণভোট হয়েছিল। তাতে ব্রিটিশ জনগণ যুক্তরাজ্যকে ই.ইউ থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে রায় দিয়েছিল। আরও দুই বছর আগে ২০১৪ সালে কাছাকাছি একটি গণভোট হয়েছিল স্কটল্যান্ডে। স্কটিশ জনগণের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তারা যুক্তরাজ্যের (ইউনাইটেড কিংডম বা ইউ.কে) অংশ হয়ে থাকতে চায় কি না। স্কটিশ জনগণের রায়ে স্কটল্যান্ড এখনো যুক্তরাজ্যের অংশ।
স্কটল্যান্ডকে তো একটা দেশ হিসেবেই জানি সেই ১৯৯৯ সালে যখন বাংলাদেশ দল তাদের হারিয়ে দিয়েছিল। এরা আবার ইউ.কে এর অংশ! তাহলে দেশ আসলে কোনটা?
কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, বাংলাদেশ ২০০৫ এ সেই যে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল, খেলাটা কোথায় হয়েছিল? ক্রিকেট স্টেডিয়াম সোফিয়া গার্ডেনের হয়ত অনেকেই বলতে পারবেন না, তবে শহরের নাম অর্থাৎ কার্ডিফ নামটা অনেকেই বলে ফেলতে পারবেন। এবার তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, কার্ডিফ কোথায়? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উত্তর পাবেন, ইংল্যান্ডে। কারণ, সেই ত্রিদেশীয় সিরিজে বাংলাদেশ আর অস্ট্রেলিয়ার বাইরে তৃতীয় দেশ হিসেবে ছিল স্বাগতিক ইংল্যান্ড। কিন্তু সত্যিতে কার্ডিফ একেবারেই আলাদা একটা দেশ ওয়েলসের রাজধানী।
ফুটবল নিয়ে খুব আগ্রহী দর্শকের কাছে ওয়েলস তেমন একটা অপরিচিত নাম না। ম্যানচেস্টার ইউনাটেড লিজেন্ড রায়ান গিগস কিংবা হালের মাদ্রিদ তারকা গ্যারেথ বেল দুজনই এই ওয়েলসের। এর সাথে কার্ডিফে হয়ে যাওয়া এবছরের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনাল ম্যাচ; সব মিলিয়ে ওয়েলস কিংবা কার্ডিফের নাম কমবেশি এখন সব ফুটবলপ্রেমীই জানেন। প্রশ্ন হতে পারে, সেই সিরিজের স্বাগতিক ইংল্যান্ড হলে অন্য একটি দেশে খেলা হয় কী করে?
আবার ধরুন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার জর্জ বেস্টের কথা। ইউরোপিয়ান ফুটবল নিয়ে মোটামুটি জানাশোনা থাকলেই যে কেউ বলে দিতে পারবে জর্জ বেস্ট কোন ক্লাবের হয়ে দুনিয়া মাতিয়েছেন। কিন্তু জর্জ বেস্টের দেশের নাম জিজ্ঞেস করে দেখুন, নানা রকম উত্তর পেতে পারেন। অনেকেই হয়ত বলে ফেলবেন ইংল্যান্ড, তবে একটা বিরাট অংশ যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আয়ারল্যান্ড উত্তর দিবে। সত্যি করে বলতে “আয়ারল্যান্ড” নামের কোন দেশ পৃথিবীতে নেই। আবার চাইলে এটাও বলায় যায়, আয়ারল্যান্ড নামের দুটো দেশ পৃথিবীতে আছে। সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে নিশ্চয়ই!
ইংল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন, ইউ.কে এই তিনটা নাম নিয়ে কমবেশি আমরা প্রত্যেকেই কখনো না কখনো ধাঁধায় পড়েছি সন্দেহ নেই। ফুটবল ক্রিকেট দেখতে গেলে দেখি সেখানে ইংল্যান্ড আবার অলিম্পিকে গেলে ইংল্যান্ড নামের কেউ নেই, পদক তালিকায় গ্রেট ব্রিটেনের নাম। আবার আপনি যদি বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী হন, তাহলে হয়ত জেনে থাকবেন জাতিসংঘে ইংল্যান্ড কিংবা গ্রেট ব্রিটেন নামের কোন দেশ নেই। জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে আছে ইউনাইটেড কিংডম বা যুক্তরাজ্য। তার সাথে আবার এই আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস আর স্কটল্যান্ডের একটা জট! সবকিছু আরও গুলিয়ে যাবার আগেই চলুন ব্রিটিশদের জট খোলার চেষ্টা করি।
২.
সবার আগে আয়ারল্যান্ডের গোলকধাঁধা থেকে বের হই। উপরের ছবিতে ইউরোপের মানচিত্রে সবুজ রঙে দুটো মোটামুটি বড় দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। বাঁ দিকের (অর্থাৎ পশ্চিমের) অপেক্ষাকৃত ছোট দ্বীপটিই হচ্ছে আয়ারল্যান্ড। একটা সময় পর্যন্ত এই দ্বীপটি পুরোটা নিয়েই আয়ারল্যান্ড নামের একটি দেশ ছিল। ১৯২১ সালে আয়ারল্যান্ড দু টুকরো হয়ে যায়। উত্তরের ছোট একটা অংশ নিয়ে গঠিত হয় নর্দান আয়ারল্যান্ড এবং বাকি অংশের নাম হয় রিপাবলিক অফ আয়ারল্যান্ড। কিংবদন্তী ফুটবলার জর্জ বেস্ট ঐ নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের ফুটবলার ছিলেন।
আর ছবিতে ডান দিকের (অর্থাৎ পূর্ব দিকের) অপেক্ষাকৃত বড় যে দ্বীপটি দেখছেন সেটা হচ্ছে গ্রেট ব্রিটেন। অনেকেই ঐ পুরো দ্বীপটিকে ইংল্যান্ড ভেবে ভুল করেন। সত্যিতে ইংল্যান্ড ওখানেই আছে এবং সাথে আরও দুটো দেশ আছে, স্কটল্যান্ড আর ওয়েলস। উত্তরের বড় একটা অংশ স্কটল্যান্ড, দক্ষিণের প্রায় পুরোটাই ইংল্যান্ড আর ইংল্যান্ডের পশ্চিম দিকের ছোট একটা অংশে ওয়েলস অবস্থিত।
অবশ্য এই তিনটা দেশ পুরোপুরি গ্রেট ব্রিটেনেরঅংশ নয়। ইংল্যান্ডের দক্ষিণে Isle of Wight (যা ইংল্যান্ডের অংশ), Isle of Anglesey (যা ওয়েলসের অংশ, স্কটল্যান্ডের দক্ষিণের Islands of the Clyde এবং স্কটল্যান্ডের উত্তরের Hebrides, Orkney Islands, Shetland Islands নামের বেশ কয়টি ছোট ছোট দ্বীপ গ্রেট ব্রিটেনের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয় না।
আর এই গ্রেট ব্রিটেনের সাথে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড মিলে হয় একটি দেশ, যুক্তরাজ্য বা ইউনাইটেড কিংডম। ইউ.কে এর পুরো নাম পড়লেই বুঝতে পারবেন। দেশটির পুরো নাম হচ্ছে, The United Kingdom of Great Britain and Northern Ireland. অর্থাৎ ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস আর নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড এই চারটি “দেশ” মিলে যুক্তরাজ্য বা ইউনাইডেট কিংডম। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই চারটি যদি নিজেরাই দেশ হয়, তারা সবাই মিলে আবার কেমন করে নতুন আরেকটা দেশ হিসেবে থাকে?
৩.
যুক্তরাজ্য অনেকটা “দেশের ভিতর দেশ” এর মতন একটা ব্যাপার। স্কটল্যান্ড, ওয়েলস, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড সবারই নিজস্ব জাতীয় পতাকা, পার্লামেন্ট, ভোটিং সিস্টেম, রাজধানী (যথাক্রমে এডিনবার্গ, কার্ডিফ এবং বেলফাস্ট) এবং স্বায়ত্বশাসিত প্রশাসন রয়েছে। কিন্তু সার্বোভৌমত্বের প্রশ্নে এখনো তারা পুরোপুরি সার্বভৌম নয়। পৃথিবীর মানচিত্রে সার্বভৌম দেশটি হচ্ছে যুক্তরাজ্য। গত প্রায় ৫০০ বছরের ইতিহাসে নানারকম বদলের মধ্য দিয়ে আজকের এই যুক্তরাজ্য।
ইংল্যান্ড আর ওয়েলস একত্র হয় ১৫৩৬ সালে। এরপর ১৭০৭ সালে এসে স্কটল্যান্ড যুক্ত হয় ইংল্যান্ডের সাথে। তখন ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড আর ওয়েলস মিলে গঠিত হয় দ্য কিংডম অফ গ্রেট ব্রিটেন। আরও প্রায় একশ বছর পর ১৮০১ সালে আয়ারল্যান্ড যুক্ত হয় গ্রেট ব্রিটেনের সাথে। তাতে নাম বদলে নতুন নাম হয় দ্য ইউনাইটেড কিংডম অফ গ্রেট ব্রিটেন এন্ড আয়ারল্যান্ড। এরপর গত শতাব্দীর শুরুর দিকে এসে আয়ারল্যান্ডের দক্ষিণের অধিকাংশ মানুষ গ্রেট ব্রিটেন থেকে সরে আসতে চাইলে আয়ারল্যান্ড ভেঙে দুটো দেশ হয়ে যায়। দক্ষিণের রিপাবলিক অফ আয়ারল্যান্ড একটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রকাশিত হয় আর নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড ব্রিটেনের সাথেই থেকে গেলে আবারো নতুন নাম নিতে হয় যুক্তরাজ্যের যেটি এখনো বিদ্যমান।
যতটা সহজে “যুক্ত হয়ে যায়” আর “আলাদা হয়ে যায়” লিখে ফেললাম, ইতিহাসটা ততটা সহজ ছিল না। দুটো প্রক্রিয়াতেই দীর্ঘদিনের আন্দোলন, সংগ্রাম, যুদ্ধ আর রক্তপাত হয়েছে।
৪.
স্বায়ত্তশাসিত হলেও আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস আর নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড সার্বভৌম দেশ না হবার কারণ হচ্ছে, ব্রিটিশ রাজতন্ত্র। কাগজে কলমে বাকিংহাম প্যালেসই যুক্তরাজ্যের সব ক্ষমতার অধিকারী। গত ৬৫ বছর ধরে পুরো ব্রিটেনের রাণী হয়ে আছেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তার আগে আরও ৬৫ জন রাজা এবং রাণী শাসন করেছেন ব্রিটেনকে।
যুক্তরাজ্যে দীর্ঘদিন ধরেই সংসদীয় শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান যেখানে একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের অধীনে যুক্তরাজ্য পরিচালিত হয়। রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ পুরো সাম্রাজ্যের প্রধান আর রাষ্ট্র এবং সরকারের প্রধান হচ্ছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে।
এই চারটি দেশ রাণীকে রাজ্যের প্রধান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নিজেরা স্বায়ত্বশাসন এবং স্বাধীন প্রশাসনের অধিকার পেয়েছে। অন্তত, কাগজে কলমে এখনো ব্যাপারটা তাই রয়ে গিয়েছে। যদিও চাইলেই যেকোনো রাজ্য এই রাজ্য পরিচয় থেকে বেরিয়ে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। ২০১৪ সালে স্কটল্যান্ডে এই নিয়েই গণভোট হয়, শুনতে অবাক লাগলেও সেখানে খানিক ব্যবধানে ব্রিটেনের অংশ হয়ে থাকতে চাওয়া মানুষেরাই জয়ী হয়ে যান।
এখনো স্কটল্যান্ডে এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের অনেক জনগণ মনে করেন, তাদের যুক্তরাজ্য থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত। হয়ত আরও বছর কয়েকের মধ্যেই দেশ দুটিতে আবারো গণভোট অনুষ্ঠিত হবে।
৫.
চারটি দেশে বসবাসকারী মানুষের আলাদা চারটি জাতির নাম, ইংলিশ, স্কটিশ, ওয়েলশ এবং নর্দার্ন আইরিশ। ভাষাও পুরোপুরি এক না, অথচ তাদের কারোই আলাদা পাসপোর্ট নেই। এদের সবাইই ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী, ব্রিটিশ নাগরিক। ঠিক করে বলতে সবাই, এমনকি নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের মানুষেরাও ইউনাইটেড কিংডমে বসবাসরত ব্রিটিশ নাগরিক।
আসলে পুরো বিষয়টা হয়ত জটিল হত না যদি না বিভিন্ন খেলায় বিভিন্ন রকম রূপ না থাকত। ফুটবল বিশ্বকাপে চারটি দেশ আলাদা আলাদা আন্তর্জাতিক দল নিয়ে অংশগ্রহন করে। সবার নিজেদের আলাদা আলাদা বোর্ড এবং লীগ আছে। ক্রিকেটে আবার হিসেবটা অন্যরকম। সেখানে চারটি আলাদা জাতীয় দল থাকলেও ক্রিকেট বোর্ড তিনটা। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডের আলাদা আলাদা বোর্ড আর ওয়েলস আর ইংল্যান্ড মিলে ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড। এজন্যই ইংল্যান্ড স্বাগতিক হলেও খেলা ওয়েলসের স্টেডিয়ামে হতে পারে।
আবার জাতিসংঘের মতো অলিম্পিকেও পুরো ইউনাইটেড কিংডম একসাথে একই পতাকার নিচে অংশগ্রহণ করে, তবে বিশ্ব খেলাধুলার এই সর্বোচ্চ আসরে তাদের নাম হয় গ্রেট ব্রিটেন। এইসব জটিলতার মধ্যে আবার রয়েছে চারটি দেশের আলাদা পতাকা এবং সম্মিলিত পতাকা “ইউনিয়ন জ্যাক”! এই গোলমেলে বিষয় নিয়ে আরেকদিন কথা হবে! কারণ এটা নিয়ে কথা বলতে গেলে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের আরও অনেক জটিল বিষয় আর অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডের মতন বাকি দুনিয়ার অসংখ্যদেশের নাম এসে পড়বে।
সূত্র: এগিয়ে চলো।
দেশ নিয়ে যত জট; ওয়েলস,আয়ারল্যান্ড,স্কটল্যান্ড কি দেশ নাকি রাজ্য।
Reviewed by সম্পাদক
on
সোমবার, এপ্রিল ০১, ২০১৯
Rating: