-->

গল্প- একটি চাপা আর্তনাদ



প্রতীক ভাষ্কর ,(রংপুর):
কলেজ ছুটি হয়ে আমি আর কয়েকটা বন্ধু মিলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছি।
বাস আসবে; বাসে করে বাড়ি ফিরব । রোজ রোজ এই শহরের লোকাল বাসে ঘরে ফিরতে ভালো লাগে না । অবশ্য একদিক দিয়ে ভালোই। মাত্র দশ টাকা করে লাগে যেতে! বাবার একটু কষ্টখানি কম হয় ।
দুটো বাস আমাদের দিকে খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমরা দেখেও না দেখার ভান করছি। ভাবছি দুটো বাসই তো এই স্ট্যান্ডেই দাঁড়াবে । একটায় না একটায় উঠে পড়ব।
কিন্তু বাস দুটোর মাঝে কে আগে আসবে তা বোঝা মুশকিল। দুজনেই আগে আসার চেষ্টা করছে। যে আগে আসবে তারই তো বেশি যাত্রী হবে। তারই তো বেশি লাভ!
একটা বাস রাস্তা থেকে চেপে আমাদের দিকে আসছে। এবং খুব জোরে। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাসটা আমাদের উপর দিয়ে চলে গেল। কিছুদূর যাবার পর ড্রাইভার সাহেব গাড়ি থামালেন।উফ! এখন পালাতে হবে যে।
আমি রাস্তার মাঝেই শুয়ে আছি। রক্তে আমার শরীরটা ভিজে যাচ্ছে ।আচ্ছা মানুষের রক্ত কি গরম হয়? আমার কেন জানি খুব গরম লাগছে।
আমি আমার ডান পা দেখতে পেলাম না। ডান হাঁটুর নিচে আর কিছু নেই। হাঁটু দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। আমার ডান পা টা কোথায়?
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ।কষ্টে প্রচুর চিৎকার করতে ইচ্ছা করছে কিন্তু আমি চিৎকার করতে পারলাম না। চিৎকার করতে আরো কষ্ট লাগছে আমার!
আমার থেকে একটু দূরেই জহির পড়ে আছে। কি কাতরটা না কাতরাচ্ছেই ও।আগে কখনো আমি ওকে এতো কষ্ট পেতে দেখি নি । ওর কাতরানিটা আরও বাড়ছে। একটা সময় ও একদম চুপ হয়ে গেল। ও আর কাতরাচ্ছে না কেন?
আমার ঠিক পাশেই অদ্রিজার কালো ফ্রেমের মোটা চশমাটা পড়ে আছে। একটা চশমা যে কখনো এতো দুমড়ে-মুচড়ে যেতে পারে আমি আগে জানতাম না।
আচ্ছা অদ্রিজা কোথায়? ও তো চশমা ছাড়া চলতেই পারে না।
আমার থেকে অল্পখানি দূরে স্বপ্ন শুয়ে আছে। একটুও নড়ছে না। ওর সাদা কলেজ শার্টটা রক্তে একদম লাল হয়ে গেছে। অর মুখটা পুরো থেতলে গেছে ঠিকমতো চেনাও যাচ্ছে না ওকে। কি বিভৎস লাগছে ওকে দেখতে। ওর পাশেই একটা হাঁটুর নিচের অংশ পড়ে আছে। আমার ডান পা হবে হয়তো ওটা। কি ভয়ঙ্কর! মানুষের পা এতো ভয়ঙ্কর হয়??
আমার কষ্টটা বাড়ছে। এখন খুব কষ্ট লাগছে আমার। আমি বর্ণ, ঋদ্ধি, সুহাস- এদের কাউকেই খুঁজে পেলাম না। ওদের মনে হয় বাসটা ধাক্কা মারে নি ।যাক ওরা বেঁচে গেল! আচ্ছা ওরা আমাদের বাঁচাতে আসছে না কেন? নাকি ওরা নিজেরাই পড়ে আছে রাস্তার মাঝে??
ঐ তো ঋদ্ধি। ওর দিকে একবার তাকিয়ে আর তাকাতে পারলুম না। পেটের নাড়িভুঁড়ি কিরকম ভাবে বেরিয়ে গেছে। ওর সাদা অ্যাপ্রোন টা নাড়িভুঁড়িতে পুরো মাখামাখি হয়ে আছে।
লোকজন আমাদের দিকে ছুটে আসছে।। একদল লোক আমাকে ঘিরে ধরল। আমি আর আমার ওদের দেখতে পারলাম না। লোকগুলো কিরকম আমারদিকে তাকিয়ে আছে। লোকগুলোর চোখে কি ভয়ানক একটা ভয় !
কিছু লোক আমাকে স্ট্রেচারে তুলল। আমার বেশ হালকা হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে আমি যেন হাওয়ায় ভাসছি!
ওরা আমাকে অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে ঢুকাল। আমার সাথে সাথে আরেকটা ছেলেকেও অ্যাম্বুলেন্সে তুলল। ঠিক আমার পাশেই শুয়ে দিল ওকে। ছেলেটা আমাদের কলেজেই পড়ে। বেশ কবার দেখেছি। কিন্তু আমি ওর নাম জানি না। ছেলেটা ব্যথায় গোঙাচ্ছে। আচ্ছা আমার জহিররা কোথায়? ?
অ্যাম্বুলেন্স টা চলতে শুরু করছে। কি কড়া সাইরেন বাজিয়ে চলছে অ্যাম্বুলেন্সটা! আমার শরীরটা আরও হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে আমি পড়ে যাব। শরীরের কষ্টটাও কমে আসছে।। খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না আর আমার।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনটার আওয়াজ ধীরে ধীরে কমছে আমি আর আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছি না । না একটুখানিও শুনতে পারছি না।
আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। ঘুমের চোটে চোখ মেলে রাখা যাচ্ছে না।
অ্যাম্বুলেন্সে যে কয়টা লোক আছে আমি তাদের একজনকেও চিনি না।
আমার খুব মায়ের কথা মনে পড়ছে। ছোটবেলায় কি সুন্দর করে মা ঘুম পাড়িয়ে দিতেন।
মা! ও মা! মা গো!
মা, তুমি শুনছ না কেন? মা! ও মা!
আমি মাকে ডাকছি। সেই ডাক মায়ের কানে যাচ্ছে না।
ইস এখন যদি মা পাশে থাকতো! 
গল্প- একটি চাপা আর্তনাদ গল্প- একটি চাপা আর্তনাদ Reviewed by সম্পাদক on বুধবার, আগস্ট ০১, ২০১৮ Rating: 5
Blogger দ্বারা পরিচালিত.